সৈয়দ হক হয়ত কোনও কুমতলব নিয়ে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাননি, বেড়াতে যাওয়ার জন্যই বেড়াতে যাওয়া কিন্তু আমাকে কন্যা হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যপারটি আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। তাঁর কোনও প্রয়োজন ছিল না আমার পরিচয়টি লুকোনোর। আমি তাঁর মত বড় কবি বা লেখক নই, কিন্তু আমার তো একটি পরিচয় আছে। আমি কবি না হলেও কবিতা লিখি। লুকোছাপা তবে কী কারণে! তাঁর সঙ্গে আমার, সমাজ যা বৈধ বলে মানেনা সেই পরকীয়া প্রেমও চলছে না বা যৌনসম্পর্কও নেই।
সৈয়দ হক যখন ময়মনসিংহে গিয়েছিলেন, শামসুর রাহমানকে ফোন করে খামোকা কথা বলেছেন, শামসুর রাহমান কেমন আছেন, কি করছেন জানতে চাওয়ার পরই তিনি বলেছেন তিনি এখন ঢাকার বাইরে, ঢাকার বাইরে কোথায় শামসুর রাহমানকে তিনি অনুমান করতে বলেছেন, অনুমান সম্ভব না হলে তিনি বলেছেন খুব নয়, মাত্র একশ কুড়ি মাইল-মত দূরে এবং এখানে তিনি সুন্দরী রমণী দ্বারা বেষ্টিত। খবরটুকু জানিয়ে তিনি হেসে আমাকে বলেছেন, ‘শুনেছো তো, আমি কিন্তু বলিনি আমি ঠিক কোথায় কার আতিথেয়তা ভোগ করছি।’ আমার ঠিক বোধগম্য হয়নি, কেন এ বিষয়টি লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন তাঁর।
‘আপনি বললেই তো পারতেন আপনি আমার বাড়িতে আছেন।’
‘বলছ কী, সারা ঢাকা রাষ্ট্র হয়ে যাবে তো!’
‘রাষ্ট্র হলে অসুবিধে কী!’
সৈয়দ হক অদ্ভুত করে হেসেছিলেন। জানি না কি অসুবিধে সৈয়দ হকের। তবে তিনি কোন কোন রমণীর সঙ্গে শামসুর রাহমানের প্রেম হয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা করেন, যখন বর্ণনা করেন তাঁর চোয়ালে একটি ভাঁজ পড়ে, ভাঁজটি দেখে আমার মনে হয়েছে এ ঈর্ষা। ঈর্ষা তাঁকে মুঠোর ভেতর নিয়ে খেলছে। তাঁরও ইচ্ছে করে শামসুর রাহমানের মত বড় কবি হতে, তাঁরও ইচ্ছে করে রূপসী রমণীদের থরথর আবেগের স্পর্শ পেতে। ঈর্ষা শব্দটিও তাঁর প্রিয়, বন্যায় ভেসে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রে বেড়াতে বেড়াতে তিনি জলমগ্ন চরাচরে একটি ছোট্ট গাছ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ওই গাছটির নাম কি জানো? ওর নাম ঈর্ষা।’ ঈর্ষার মুঠো থেকে বেরিয়ে অথবা ওই মুঠোর ভেতরে নিজে যখন হাঁসফাঁস করেন, তখন তিনি নিজের প্রেমের কথা বলেন, তাঁর নিজের শ্যালিকা যেটি তাঁর বাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছে, তার সঙ্গে গভীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল তাঁর, কেবল প্রেমই নয়, যতদূর প্রসারিত হতে পারে ঘনিষ্ঠতা, সবই। তার সেই শ্যালিকা পরে অল্প বয়স্ক এক যাচ্ছেত!ই ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ তাঁর জীবনে আর নেই, তিনি সইতে পারেন না শ্যালিকার এই না-থাকা। নিজে তিনি শ্যালিকার বাড়ি গিয়ে টাকা পয়সা দেন নিয়মিত, তার নতুন সংসারে যা প্রয়োজন সবই তিনি কিনে দিয়েছেন। সৈয়দ হক অনর্গল বলে যান শ্যালিকা কি করে এই বিয়েটি করে তাঁকে চরম অপমান করেছে, হৃদয়ে যা কিছু ছিল সব ছিনিয়ে তাঁকে শূন্য করে দিয়েছে। আমি জানিনা কেন তিনি আমার কাছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সব খুঁটিনাটি খুলে বলেছেন। মাঝে মাঝে তাঁকে মনে হয়েছে বড় নিঃসঙ্গ মানুষ তিনি। তাঁর হয়ত কেউ নেই যার কাছে তিনি তাঁর সুখের কথা, তাঁর কষ্টের কথা বলতে পারেন। মায়া হয়েছে তাঁর জন্য। আবার মনে হয়েছে গল্প লেখকদের বোধহয় এমনই স্বভাব, গল্প লেখেন যেমন, বলেনও তেমন। সত্য ঘটনার সঙ্গে এর যে কোনও সম্পর্ক থাকবে তার কোনও কথা নেই। তিনি একদিন বলেছেনও, যখন তিনি ছোট, ঘুর পথে বাড়ির দ্বিতীয় দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে তিনি সবাইকে জানিয়েছেন, বড় দরজার পাশে বিশাল এক কুকুর দাঁড়িয়ে আছে, ভয়ে তিনি বড় দরজা মাড়ান নি। তিনি মিথ্যে বলেছেন, কোনও কুকুর বড় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল না, কিন্তু বলেছেন যে দাঁড়িয়ে আছে, বলার কোনও কারণ নেই, কাউকে ভয় দেখানোর জন্য নয়, এমনি বলা।
‘এমনি বলা?’
‘হ্যাঁ এমনি বলা।’
লেখক হওয়ার সম্ভাবনা সম্ভবত ওই কুকুরের গল্পটি দিয়েই শুরু হয়েছিল। সৈয়দ হক এরকম প্রায়ই মিথ্যে বলেছেন, কোনও কারণ নেই তারপরও বলেছেন। জীবনকে তিনি একটি ছোটগল্পই মনে করেন হয়ত। তবে তিনি যা খুশি তাই মনে করে যে কথাই বলুন বা যে গল্পই করুন না কেন, চমৎকার কথা তিনি বলেন, অসামান্য গল্প তিনি করেন, আমি তা অস্বীকার করি না। তাঁর এই একটি গুণ আমাকে সবসময়ই মুগ্ধ করেছে।
অবকাশের অসাধারণ খাতির যত্ন সৈয়দ হকের একবারই জুটেছে। যখন সকাল কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে এলেন ময়মনসিংহে, তখন। অবকাশেই তাঁর থাকার আয়োজন করেছিলাম। বাবার কি হবে মনের অবস্থা, চিৎকার করে বাড়ি ফাটাবেন কী না, সৈয়দ হককে আঙুল উঁচিয়ে কালো ফটক দেখিয়ে দেবেন কী না, কিছুই না জেনে তাঁর থাকার আয়োজন বাড়িতে। ভীষণ ঝুঁকি নেওয়া বটে। মাকে লেলিয়ে দিলাম বাবাকে বোঝাতে দেশের সবচেয়ে বড় লেখক, বড় বুদ্ধিজীবী এই সৈয়দ শামসুল হক, তাঁর সঙ্গে যেন জানোয়ারি না করেন। দাদাকেও লেলিয়ে সৈয়দ হকের যত রকম প্রশংসা করা যায় করিয়ে বাবাকে রাজি করিয়েছিলাম এ বাড়িতে সৈয়দ হককে দুদিনের জন্য অতিথি করার অনুমতি দিতে। বাবা দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাজ সাজ রব পড়ে গেল বাড়িতে। বাজারে মেলে হেন ভাল জিনিস নেই যে কেনা হল না। রান্নাঘরে ধুম পড়ে গেলে রান্নার। আমার ঘরটি ধুয়ে মুছে সাজিয়ে গুজিয়ে দেওয়া হল সম্মানীয় অতিথিকে। বাবা জানোয়ারি করা তো দূরের কথা, রীতিমত সৈয়দ হকের সঙ্গে স্যুট টাই পরে খেতে বসেছেন, বাড়িতে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করার অভ্যেসকে মাচায় তুলে রেখে দুদিন তিনি মানুষের মত আচরণ করেছেন।