রাঙামাটির রাঙা-রূপ দেখে একজনের কথাই আমার বার বার মনে পড়েছে, সে চন্দনা। চন্দনা নিশ্চয়ই এই মাঠটিতে হেটেঁছে, এই পুকুরের পাশে নিশ্চয়ই ও বসেছে, ওই গাছতলায় নিশ্চয়ই ও শৈশব জুড়ে দৌড়েছে, খেলেছে, কী খেলা খেলত চন্দনা! কোনওদিন ও গোল্লাছুট খেলেছে কি? না খেলে থাকলেও ওর জীবনেই ও খেলেছে খেলাটি, গোল্লা থেকে ছুটে গেছে চন্দনা। রাঙামাটির চাকমা জীবনের গোল্লা থেকে বাঙালি জীবনে ছুটে গেছে। চন্দনা কি সুখে আছে! বড় জানতে ইচ্ছে করে। মনে হয় হাজার বছর পার হয়ে গেছে ওকে দেখি না। শেষ দেখা হয়েছিল রুদ্রর মুহম্মদপুরের ভাঙা বাড়িটিতে। ওখানে ও খোকনকে নিয়ে এসেছিল, ওকে আপ্যায়ন করার ক্ষমতাও আমার ছিল না, বাইরে যে দুপুরে একসঙ্গে খেতে যাব, সেও হয়নি। এর আগে অবশ্য ঢাকায় ওর স্বামীর বোনের বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম, বাড়িতে চন্দনা কেমন জবুথবু বসে থাকত, ছোট একটি ঘর ছিল যেখানে ও আর খোকন ঘুমোতো, আমার বিশ্বাস হয়নি চন্দনা কোনও পুরুষের সঙ্গে ঘুমোয় এখন, কোনও পুরুষকে খাবার চিবোতে দেখলে,খালি গায়ে দেখলে চন্দনার বমির উদ্রেক হত, সেই চন্দনা। সেই উচ্ছল উদ্দাম চন্দনা, জীবন নিয়ে গোল্লাছুট খেলা চন্দনা, চাকমা সমাজে শ্রাদ্ধ হওয়া চন্দনা। এখন সত্যিই কি ও নিপূণ সংসারী! আমার বিশ্বাস হতে চায় না। কেবল মনে হতে থাকে, চন্দনা যেখানেই যার আলিঙ্গনেই আছে, ভাল নেই। চন্দনা কি এখন আগের মত কবিতা লেখে আর!
রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই যাওয়ার পরিকল্পনা করেন সৈয়দ হক। কাপ্তাইএ তাঁর ভক্ত বৃন্দের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে, ওখানে ওদেরই অতিথি হবেন তিনি। কাপ্তাই পৌঁছে যে কাজটি করলেন, আমি তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি তাঁর ভক্তবৃন্দকে আমার পরিচয় দিলেন, তাঁর কন্যা। তাঁর কন্যাকে ভক্তবৃন্দ দেখেনি কখনও, সুতরাং কন্যা আমি তাঁর হতেই পারি। লেকের জলে বড় একটি নৌকোয় বসে সৈয়দ হক ভক্তবৃন্দের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন হাসিমুখে। নতুন কি বই লিখলেন, কবিতা লিখছেন নাকি উপন্যাস, নাকি কাব্যনাট্য, নাকি গল্প। আমার পাশে একজন ভক্ত ছিল বসা, যেহেতু সৈয়দ হকের কন্যার সঙ্গে বাক্যবিনিময় না করা অভদ্রতার লক্ষণ, লাজুক হেসে বলল, ‘কাপ্তাই এ প্রথম এসেছেন?’
‘হ্যাঁ প্রথম।’
‘আপনাদের বাড়ি তো ঢাকার গুলশানে, তাই না?’
বুকের ধুকপুক নিজের কানে শুনি, আমি জলের দিকে চোখ ফেরাই, যেন ভক্তের বাক্যটি আমি ঠিক ষ্পষ্ট শুনিনি।
এরপর আবার প্রশ্ন, ‘আপনার বাবার লেখা সব আপনি পড়েছেন নিশ্চয়ই।’
এবার তাকাই, ‘কি বলছেন?’
‘বলছিলাম, হক ভাইএর সব লেখা নিশ্চয় পড়েছেন?’
‘ও। সব না, কিছু পড়েছি।’
বলে আমি আবার জলের দিকে, চাইছিলাম মন দিয়ে আমার জল দেখা দেখে ভক্তটি ভাবুক আমি জল নিয়ে বড় বেশি মগ্ন, এ সময় প্রশ্নবাণে বিরক্ত হতে চাই না। কিন্তু সেই ভক্ত তো আছেই, আরও একটি ভক্ত যোগ দেয় আমাকে সঙ্গ দিতে।
নতুন ভক্তটির প্রশ্ন, ‘আপনি কি শিগরি লন্ডন ফিরে যাচ্ছেন?’
জল থেকে চোখ তুলিনা আমি, ভয়ে আমার অনন্তরাত্মা কাঁপে। কী উত্তর দেব আমি এই প্রশ্নের আমি জানি না। যেন কারও কোনও প্রশ্ন শুনিনি আমি, আমি কানে খাটো, সৈয়দ হক বড় লেখক হতে পারেন, তাঁর নাকে কানে গলায় কোনও অসুবিধে না থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর কন্যার যে থাকবে না তার কোনও যুক্তি নেই। মনে হতে থাকে, এই নৌকো থেকে যদি জলে ঝাঁপ দিতে পারতাম, তবে কোনওরকম প্রশ্নের সামনে আমাকে পড়তে হত না।
‘আপনার মেয়ের নাম কি হক ভাই?’ কেউ একজন জিজ্ঞেস করল।
সৈয়দ হক মধুর হেসে বললেন, ‘ওর নাম অদ্বিতীয়া।’
‘বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো।’ সেই একজন বলল।
‘নামটি রেখেছি আমি।’
সৈয়দ হক বেশ স্নেহচোখে তাঁর অদ্বিতীয়াকে দেখছেন। অদ্বিতীয়ার করুণ চোখদুটো দেখছেন। চোখে জল জমতে চাইছে দেখছেন। দেখেও মধুর হাসিটি তিনি ঝুলিয়ে রেখেছেন ঠোঁটে। ঝুলে থাকা হাসির তল থেকে বললেন, ‘অবশ্য ওর মা ওকে অন্য নামে ডাকে। .. কী, কথা বলছ না কেন অদ্বিতীয়া, তোমার ভাল লাগছে তো?’
আমি মাথা নেড়ে ভাল লাগছে জানিয়ে, যেহেতু ভাল না লাগাটা অশোভন এই চমৎকার নৌকো ভ্রমণে, চোখ ফেরালাম জলে।
জলের চোখ জলে।
সৈয়দ হক প্রায়ই তাঁর শার্ট খুলে গলা থেকে পেট অবদি কাটা হৃদপিণ্ডে অস্ত্রেপাচার করার দাগ দেখিয়ে বলেন তিনি বেশিদিন নেই। বেশিদিন তিনি নেই বলে আমার একধরণের মায়া হয় তাঁর জন্য। ওই মায়ার কারণেই কি না জানি না আমি চেঁচিয়ে বাবাকে ভাই বলে ডেকে উঠছি না, খুব সতর্ক থাকছি মুখ ফসকে যেন কোনও সম্বোধন বেরিয়ে না যায়। অভিনয়ে পাকা হলে নৌকোভরা দর্শক শ্রোতার সামনে হয়ত বলে বসতাম, বাবা তুমি কি দুপুরের ওষুধদুটো খেয়েছো?
সৈয়দ হক নাটক লেখেন, নাগরিক নাট্যগোষ্ঠীর জন্য বেশ কটি নাটক লিখেছেন। ইদানীং আবার শেক্সপিয়ারের নাটক অনুবাদ করছেন, কোন এক ইংরেজ নাট্যকার সেই নাটক পরিচালনা করছেন। সৈয়দ হক কেবল নাটক লেখেন না, জীবনেও নাটক করেন। নাটক না হলে এ কী! তিনি আমাকে কন্যার মতো বললেও না হয় পার পাওয়া যেত, একেবারে কন্যাই বলছেন। এই যে তিনি এত সম্মান পাচ্ছেন এখানে, একটুও ভয় করছেন না যদি আমি বলে ফেলি যে আমি তাঁর কন্যা নই! মিথ্যুক হিসেবে প্রমাণিত হলে কোথায় যাবে তাঁর সম্মান! ফেলি ফেলি করেও তাঁর সম্মান জলে ছুঁড়ে ফেলতে আমার স্পর্ধা হয় না, সম্মান তো সৈয়দ হককে আমিও কম করি না। কিন্তু আমাকে মঞ্চে তুলে দিয়ে তিনি কি মজা করছেন! তাঁর নিজের নামটি খোয়াতে হয়নি, তাঁর পরিচয়েই তিনি আছেন, কেবল আমাকে রেখেছেন ঢেকে। আমি না পারছি তাঁকে হক ভাই বলে ডাকতে, না পারছি আপনি বলে সম্বোধন করতে। জিভের ডগায় শব্দগুলো যখনই আসে, তখনই আমাকে গিলে ফেলতে হয়, শব্দগুলো জিভের জলের সঙে গিলতে গিলতে দেখি জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। নৌকো ভ্রমণ শেষ করে কাপ্তাই বাঁধ দেখে তিনি নৌবাহিনীর আগপাশতলা ঘুরে দেখলেন, আমি পেছন পেছন, বোবা কালা অদ্বিতীয়া। রাতে এক নৌসেনার বাড়ি নেমন্তন্ন, ওখানে বাড়ি ভরা লোকের সামনে ওই একই পরিচয় আমার, সৈয়দ হকের কন্যা। নাম অদ্বিতীয়া। নৌসেনা আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করাতে সৈয়দ হক হা হা করে ছুটে এলেন, ‘ওকে আপনি বলছেন কেন! তুমি করে বলুন। বয়স তে একুশও পেরোয়নি, এই তোর কি একুশ হয়েছে?’ পঁচিশ ছাড়িয়ে যাওয়া মেয়ে আমি মাথা নোয়াই। পায়ের আঙুল গুনি, দশটি জেনেও গুনি আবার। গোনা শেষ হলে মনে মনে গুনি হাতের আঙুল, হাত শেষ হলে আবার পায়ের। সৈয়দ হক মদ্যপান করছেন তখন। ‘আচ্ছ! আপনার মেয়ে খুব কম কথা বলে বুঝি?’