গোপনে গোপনে ভালবসেন তিনি, যাকে ভালবাসেন, সে ই বোঝে না তিনি যে ভালবাসেন। একাকী বসে বেদনার জাল বোনেন তিনি, জানতে চান ভালবাসার মানুষটি কেমন আছে, যদি চিঠি না লেখে প্রেমিকা, তবে তিনি অভিমান করে বলেন,
..আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও, আপত্তি নেই।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরে নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়!
বোন নেত্রকোণাকে ভালবাসেন তিনি, কিন্তু যান না তিনি নেত্রকোনার কাছে, নেত্রকোনা আছে তাঁর মজ্জার আর মগজের কোষে অনুক্ষণ, যে রকম ক্যামোফ্লাজ করে থাকে জীবনের পাশাপাশি অদ্ভুত মরণ।
ত্যাগ বিরহ যন্ত্রণা কষ্ট সন্ন্যাস কবি হেলাল হাফিজের একধরনের সম্পদ কিন্তু ঘনিষ্ঠ আর একজন কবিকে জানি ভোগ যাঁর কাছে প্রধান, জীবন যাঁর কাছে নিছক খেলা ছাড়া কিছু নয়। জীবন রঙ্গমঞ্চের মত, তিনি সেই মঞ্চে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আমার বুঝতে কষ্ট হয় কোন কথাটি বা কোন ব্যবহারটি তাঁর সত্যি এবং কোনটি মিথ্যে, কোনটি অভিনয়। সরল মনে তাঁর সবটুকুকেই সত্যি বলে মনে হয়। মনে হয় বলেই সম্ভবত আমাকে তিনি খুব পছন্দ করেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যসের নাম খেলারাম খেলে যা। বড় দক্ষ তুলিতে এঁকেছেন খেলারাম বাবর আলীকে। লুইচ্চউ! বদমাইশ বলে যে বাবর আলীকে সকলে গাল দেয় সেই বাবর আলীর চরিত্রটি যে সৈয়দ শামসুল হকের ভেতরের চরিত্র, তা অনেকটা পথ তাঁর সঙ্গে না চললে আমার সম্ভবত অনুমান করা হত না।
রুদ্রর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আমার ভগ্ন হৃদয়ের শুশ্রুষা করার দায়িত্ব সৈয়দ শামসুল হক নিজে থেকেই নিয়েছিলেন। তিনিই একদিন আমাকে নিয়ে চলেন রাঙামাটি। রাঙামাটি কখনও যাইনি আমি আগে। বিশাল বিশাল পাহাড় আর পাহাড়ের পায়ের কাছে জলের পুকুর, সে পুকুরের ধারে ঘাসে বসে সৈয়দ হক তাঁর নিজেরও মাঝে মাঝে যে একা লাগে বলেন। বলার সময় এত চমৎকার চমৎকার শব্দ তিনি ব্যবহার করেন যে মুগ্ধ হই। আমার শব্দগুলো তুলনায় তুলোর মত, যে কোনও ঘাসপোকাও য়চ্ছন্দে অনুবাদ করে দেবে, বাক্যগুলো এত নরম যে প্রায়ই আমার মুখের কাছে তাঁকে কান এগিয়ে আনতে হয়। রাঙামাটির মধ্যিখানে রঙিন একটি হোটেলে ঢুকে আমার কানের কাছেই তাঁর মুখ এগিয়ে এনে বললেন, একটি ঘর নিলেই তো চলে, তাই না?
আমি যদি বলি, না চলে না, তবে মনে হতে পারে যে আমি তাঁকে কোনও কারণে বিশ্বাস করছি না, তাঁকে দৃশ্চরিত্র বলে সন্দেহ করছি, কিন্তু সন্দেহের প্রশ্ন ওঠার যেহেতু প্রশ্ন ওঠে না, আমার যে তাঁকে নিয়ে মোটেও আশঙ্কা করার কিছু নেই, তা প্রমাণ করতে চেয়ে অত্যন্ত নিস্পৃহ নির্লিপ্ত কণ্ঠে কেমন আছর উত্তরে ভাল আছি বলার মত করে বলি, হ্যাঁ চলে।
তোমার অসুবিধে হলে বল, তাহলে দুজনের জন্য দুটি ঘর নিই।
আমার সরল উত্তর, আমার কেন অসুবিধে হবে? আমার কোনও রকম অসুবিধে নেই।
‘ঠিক বলছ তো?’
আমি উদ্বেগের ঘাড় চেপে প্রশান্ত মুখে অতি নিস্পাপ-অতি নিস্কলুষ সম্পর্কটির ধারে কাছে কোনও ক্লেদ উড়ে আসার আশঙ্কা অবান্তর বলে, হেসে, ‘নিশ্চয়ই’ বলি।
সৈযদ হক আমার পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলেন, ‘তোমার একটি জিনিস আমার বেশ ভাল লাগে, তুমি না বল না কিছুতে।’
তা ঠিক। আমি না বলি না কিছুতে। সৈযদ হক, আমার বাবার বয়সী লোকটি, যাকে আমি বাবা বা দাদা বলে ভাবতে পারি অনায়াসে, অথবা কোনওরকম আত্মীয-সম্পর্কের তুলনা না করলে বন্ধুই ভাবতে পারি— তাঁকে না বলব কেন! আমি না বলব কেন, আমি তো তাবৎ অকবির মত ঘরকুনো রক্ষণশীল নই, সংসারবৃত্তে খাবি খাওয়া, সংকুচিত, সংকীর্ণ মনের কেউ নই! এর আগে আমাকে আর ইয়াসমিনকে নিয়ে সৈয়দ হক গিয়েছিলেন কুমিল্লার শালবন বিহারে, ওখানেও বন উন্নয়ন দপ্তরের একটি অতিথি ভবনে ছিলাম আমরা। আমি আর ইয়াসমিন ঘুমিয়েছিলাম এক ঘরে, তিনি আরেক ঘরে। সকালে বন উন্নয়নের নাস্তার ঘরে গিয়ে নাস্তা খেয়ে শালবন বিহারে হেঁটে বেরিয়ে ঢাকা ফিরে এসেছি। সারা পথই সৈয়দ হক মূলত একাই কথা বলেন, নিজের শৈশব কৈশোরের কথা, দারিদ্রের কথা, নিজের যক্ষা রোগের কথা, যক্ষা রোগীকে হাসপাতালে যে ডাক্তারটি ভাল করে তুলেছিলেন, সেই ডাক্তার আনোয়ারার কথা, তাঁদের প্রেমের কথা, কী করে তাঁদের বিয়ে হল সেই কথা, দুটি ছেলে মেয়ের কথা, নিজের লেখালেখির কথা, আশেপাশের মানুষের নির্লজ্জ আর নিষ্করুণ চরিত্রের কথা নির্দ্বিধায় বলে যান। লেখালেখির প্রসঙ্গ এলে বড় আগ্রহ নিয়ে আমি কী লিখছি জানতে চান। বড় অপ্রতিভ বোধ করি তখন। শরমে মিইয়ে যাই। মাঝে মাঝে শখের কবিতা লিখি, আমার কবিতা সৈয়দ হকের মত বিশাল মানুষের কাছে উপস্থিত করার মত দুঃসাহস আমি করি না। বরং বিভোর হয়ে তাঁর ধীরতা, উদারতা, তাঁর মহানুভবতা, তাঁর মমত্ব দেখি। তিনি বিলেতে থাকা লোক, ঢাকার গুলশানে বাড়ি গাড়ি নিয়ে সচ্ছঅল জীবন যাপন করেন। দেশের নামকরা লেখক। দেশময় ঘুরে বেড়ান। অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁর। এত জানেন, তবু জানার ইচ্ছে আরও। আরও তিনি দেখতে চান, খুঁড়ে খুঁড়ে খুঁটে খুঁটে। জীবনের স্বাদ সাধ তাঁর কখনও ফুরোয় না। আমাদের মত মফস্বলের দুটি মেয়েকে তিনি খাতির করছেন, তাঁর খাতির পেয়ে আমরা দুবোন উচ্ছসিত, কিছুটা কুণ্ঠিত। তাঁর একটি ব্যপার লক্ষ্য করে অবাক না হয়ে পারি না, এত তিনি উন্মুক্ত, এত তাঁর ব্যাপ্তি, ময়মনসিংহে আমাদের বাড়িতে তিনি আতিথ্য বরণ করেছেন, অভাবনীয় সমাদর পেয়েছেন কিন্তু ঢাকায় নিজের বাড়িতে তিনি কখনও আমাদের একবার যেতেও বলেন না, রাত কাটাতে বলা তো দূরের কথা। রাত বরং তিনি দূরে কোথাও কাটাতে ভালবাসেন। দূরে কোথাওএর শখ আমারও কম নয়, দেশটির কত কোথাও এখনও যাইনি, কত কি দেখার বাকি। ছোট্ট একটি দেশ, তার বেশির ভাগ অঞ্চলই না দেখা পড়ে আছে। এদিকে বিচ্ছিরিরকম বয়স বাড়ছে।