পরদিন বাবা খবর দিলেন রেহানার ছোট ভাই ব্যারিস্টারকেও ধরেছে কলেরায়। সুস্থ ভাইটিকেও ধরেছে। তিন ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে হাসপাতালে। রেহানা আর রেহানার বাবা দৌড়োদৌড়ি করে সব করছে। এর পরদিন বাবা যা বললেন, তা শুনে আমরা বিশ্বাস করিনি যে বাবা আদৌ সত্য কোনও কথা বলছেন। বললেন, রেহানার তিন ভাই হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফেরত এসেছে, কিন্তু রেহানা আর রেহানার বাবা মারা গেছে। দুজনকেই তড়িঘড়ি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল শেষ রাতের দিকে, কিন্তু লাভ হয়নি। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা গেছেন রেহানার বাবা। রেহানা মারা গেছে হাসপাতালে পৌঁছোনোর আধঘণ্টা পর। রেহানা যখন ভাইদের সেবা করছিল, কাউকে বলেনি যে তারও বাস্তু বমি হচ্ছে। সে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লে ভাইদের সেবা করবে কে! হাসপাতালে নেবে কে! তাই বলেনি। রেহানা চায়নি তাকে নিয়ে কেউ ব্যস্ত হোক। তার বাবাও গোপন করেছেন নিজের বাস্তু বমির কথা। তিনিও কাউকে বুঝতে দিতে চাননি। ছেলেরা সুস্থ হোক, তারপর তিনি নিজের কথা ভাবতে চেয়েছিলেন।
রেহানার বাবাই ছিলেন সংসারের একমাত্র রোজগেরে লোক। নীতিবান লোক ছিলেন বলে উকিলের চাকরি করেও সংসারের অভাব দূর করতে পারেননি। রেহানা যখনই পেরেছে, স্বামীর উপার্জন থেকে যাই হোক কিছু বাঁচিয়ে বাপের সংসারে দিয়েছে। এখন কী হবে সংসারের মানুষগুলোর! এ নিয়ে অবকাশের আর সবাই আলোচনা করতে বসলেও আমি নিস্পন্দ বসে থাকি, আমার ভাবনায় স্থির হয়ে আছে রেহানার ফর্সা গোল মুখটি, উদ্বিগ্ন কিন্তু উজ্জ্বল সেই মুখটি, মলিন কিন্তু মায়াবী মুখটি। নিজেকে বার বার আমি প্রশ্ন করতে থাকি, রেহানার ওই টাকা আমি কেন নিয়েছিলাম? কী প্রয়োজন ছিল আমার টাকার? অভাবের সংসারে ষাট টাকা অনেক টাকা। রেহানার নিশ্চয়ই প্রয়োজন ছিল ওই টাকার। নিশ্চয়ই সে ভেবেছিল, টাকা আমি নেব না, আমি তার বান্ধবীর বোন, আমার বাবা ও বাড়ির সবাইকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করেন। যখন আমি লোভীর মত, অবিবেচকের মত, কলেরা আক্রান্ত একটি বাড়ির চরম দুঃসময়ে, বড় টালমাটাল অস্থির সময়ে টাকাটা নিয়েছি, নিশ্চয়ই রেহানা অবাক হয়েছিল, কষ্ট পেয়েছিল। দুদিন পর মরে যাবে মেয়ে, তাকে কেন আমি কষ্ট দিয়েছি! কি দরকার ছিল কষ্ট দেওয়ার! ওই ষাট টাকা নিশ্চয়ই অনেক কষ্টে তার নিজের জমানো টাকা থেকে দিয়েছিল আমাকে। কত টাকা উল্টোপাল্টা খরচ করি আমি। টাকার হিসেব করি না কোনওদিন। আর ওই অভাবের সংসার থেকে ওই কটা টাকা আমার না নিলে কী এমন হত! আমি কি মরে যেতাম! না খেয়ে থাকতে হত আমাকে! না হত না। আমি মরেও যেতাম না। আমার তো এমন কোনও প্রয়োজন ছিল না টাকার! শখে নিয়েছি, সুখে নিয়েছি। ডাক্তারির গর্বে নিয়েছি। কলে গেছে ডাক্তার, ফি না নিলে তো নিজেকে ডাক্তার ডাক্তার মনে হয় না, তাই নিয়েছি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। আয়নায় নিজের চেহারাটি বড় কুৎসিত লাগে, ঘৃণা ছুঁড়ে দিই। নিজের কুৎসিত নিষ্ঠুর হাতটির দিকে ঘৃণা ছুঁড়তে থাকি, যে হাত ওই টাকা স্পর্শ করেছিল। নিজের অপকর্মের জন্য নিজেরই ভুরু কুঞ্চিত হয়, নিজের দিকেই তাকিয়ে বলি, ‘তুই নিতে পারলি টাকা? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এত লোভ তোর! ছিঃ!’
মা কোনওদিন রেহানাকে দেখেননি। কিন্তু ইয়াসমিনের সঙ্গে মা গেছেন রেহানাদের বাড়িতে। আমিই যাইনি। যাওয়ার মুখ নেই বলে যাইনি। মা রেহানাদের বাড়ি থেকে কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে ফিরে এলেন।
ইয়াসমিন এর পর থেকে পানি দেখলেই ভয়ে দু হাত দূরে ছিটকে সরে যায়। ওকে জলাতংক রোগে ধরে। তেষ্টা পেলেও পানি খায় না, ঘামে গরমে শরীরের বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হলেও গোসল করতে যায় না। যতই ইচ্ছে করি, জীবনকে অতীতে ফিরিয়ে নিতে পারি না। অপরাধবোধ আমাকে নিবিড় করে আলিঙ্গন করে। আমি যেখানেই যাই, যায়। আমি স্থির হয়ে বসে থাকি, অপরাধবোধটিও থাকে, বসে থাকে। এই বোধটি কখনও আমার জীবন থেকে যাবে না আমি জানি।
একসময় কলেরার প্রকোপ দূর হয় শহর থেকে। কিন্তু বছর কুড়ি বয়সের রেহানা নেই আর এ শহরে। কেউ তাকে কোনওদিন ফিরে পাবে না। আমিও কোনওদিন নিজের ভূল শুধরে নেওয়ার জন্য একটি দিন ফিরে পাবো না। যে দিন যায়, যায়। আমি এক ঘোরের মধ্যে ডুবে থাকি। যদিও মার হাতে দুশ টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম রেহানার মার জন্য, আমার গ্লানিবোধ সামান্যও কমেনি। রেহানা তো জানেনি যে টাকা আমি ফেরত পাঠিয়েছি। কোনওদিনই সে জানবে না। ভাবতে থাকি, রেহানার হাত থেকে ওই টাকা নেওয়াটি ঘটেনি জগতে, ওটি কেবলই আমার দুঃস্বপ্ন। রেহানাদের বাড়ির সিঁড়ির কাছে একটি দৃশ্য আমার ভাবনার মধ্যে দোল খেতে থাকে। রেহানা আমাকে সাধছে টাকা, আমি তার কাঁধে হাত রেখে বলছি, ‘তুমি কি পাগল হইছ? আমি টাকা নিব কেন? টাকা রাইখা দেও,কাজে লাগবে।’ রেহানা হেসে বলছে, ‘অনেক ধন্যবাদ নাসরিন আপা। খুব উপকার করলেন আমাদের। ভাইটার চিকিৎসা করে দিলেন। আপনার এই ঋণ কোনওদিন শোধ করতে পারব না।’ চোখদুটোতে তার কৃতজ্ঞতা ছলছল করছে। দোল খেতে থাকে আরেকটি দৃশ্য। রেহারার ভাইদুটো সুস্থ হয়ে উঠেছে। রেহানা তার ভাইদের নিয়ে লুডু খেলতে বসেছে। রেহানার মেয়েটি পাশে বসে লুডু খেলা দেখছে। রেহানার ফর্সা চঞ্চল মুখটি থেকে বিষণ্নতা কেটে গেছে, মুখটি হাসছে, কাজল কালো চোখদুটো হাসছে।