কী বলবা এই হল আমাদের পয়গম্বর ব্যাটার চরিত্র, আর তার জোব্বার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আল্লাহ নামের ধোঁকা। এই ইসলামকে পৃথিবীর কোটি কোটি বুদ্ধু আজও টিকিয়ে রাখছে, এর পেছনে আর কিছু না, আছে রাজনীতির খেলা।
বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ। তরী ডুবছে এরশাদের তাই উপায়ান্তর না দেখে ইসলাম কে আঁকড়ে ধরে তিনি কূলে ভিড়তে চাইছেন।
ঝুলিয়ে দিয়েছে সম্মুখে এক পারলৌকিক মুলো,
ভীতি ও লালসা নাকের ডগায় কেবলি ওড়ায় ধুলো। .
এইবার চোখে পরে নাও কালো অন্ধত্বের ঠুলি,
যে যত অন্ধ তার তত বেশি বিশ্বাসী বলে নাম।
বিশ্বাস কর, তাহলেই হবে, পেয়ে যাবে রোশনাই।
এই বিশ্বাসে চোখ দুটো খুলে ছুঁড়ে দাও ইহকালে,
আর মগজের সচেতন কোষে তালাচাবি এঁটে দাও।
এই তো সাবাস! এখনি তুমি প্রকৃত ঈমানদার।
০৬. অন্য ভূবন
১৯৮৯ সালে অনেক কিছু ঘটে। অনেক ভাল কিছু, অনেক মন্দ কিছু । কিছু ঘটে আবার ভালও নয়, মন্দও নয়। সকাল প্রকাশনী থেকে গাঁটের পয়সা খরচ করে নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে নামে নিজের একটি কবিতার বই বের করা পড়ে ভালও নয় মন্দও নয় তালিকায়। আজকের এই সকাল কবিতা পরিষদ গড়ার আগে সকাল নামে একটি প্রকাশনী গড়েছিলাম। প্রকাশনীর প্রথম বই যেটি বের করেছিলাম, সেটি কবি আওলাদ হোসেনের কাব্যনাট্য। আওলাদ হোসেনের কথা বলতে গেলে সময় দুবছর পিছিয়ে নিতে হয়। তখন সবে চাকরি হয়েছে ময়মনসিংহ শহরে। নকলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে দু সপ্তাহের মাথায় যাদুর মত বদলি হয়ে ময়মনসিংহ শহরে। কলেজের বন্ধুবান্ধবীরা নতুন চাকরিতে দেশের আনাচ কানাচে ছড়িয়ে গেছে। রুদ্র চিংড়ির ঘের নিয়ে ব্যস্ত মোংলা বন্দরে। কদাচিৎ ঢাকায় ফেরে।
তুমি যখন একা, তুমি যার তার সঙ্গে মেশো। তুমি আওলাদ হোসেনের সঙ্গে মেশো। আওলাদ হোসেনকে বড়জোর তুমি দুবার দেখেছো এর আগে, ঢাকায়। আওলাদ কবিতা লেখেন। কবিতা তুমি ছেপেছোও তোমার সেঁজুতি পত্রিকায়। রুদ্র পাঠিয়েছিল বেশ কিছু তরুণ কবির কবিতা, আওলাদ তার মধ্যে একজন। আওলাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বিসিএস পাশ দিয়ে রুদ্রর বেশ কিছু বন্ধু, কবিতা বা গল্প লেখায় ইতি টেনে, লম্বা চুলের সর্বনাশ ঘটিয়ে ভদ্র কাট কেটে, স্যুটেড বুটেড ক্লিন শেভড হয়ে, মদ গাঁজা ভাংএর দুর্গন্ধ দূর করে মুখে গম্ভীর গম্ভীর ভাব এনে রীতিমত ভদ্রলোক সেজে ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হয়েছেন। ইকতিয়ার চোধূরী, কামাল চৌধুরী, আওলাদ হোসেন, মোহাম্মদ সাদিক, ফারুক মইনুদ্দিন..। তুমি যখন সার্কিট হাউজের মাঠে সকালবেলা আন্তঃ জেলা খেলা প্রতিযোগিতায় গেছো, খেলা দেখতে নয়, চিকিৎসা করতে খেলতে গিয়ে চোট লাগা খেলোয়ারদের, তখন পেছন থেকে কেউ একজন তোমাকে ডাকল। কে ডাকল দেখতে যেই না ঘাড় ঘোরালে, দেখলে মিষ্টি মিষ্টি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা স্যুটেড বুটেড পরিপাটি চুলের একটি লোক। তাকে তুমি চিনতে পারো। শ্রীমান আওলাদ হোসেন।
আপনি এখানে?
হ্যাঁ, আমি তো এখানে চাকরি করি। তথ্য অফিসার হয়ে এই কিছুদিন হল এই শহরে এসেছি। তা আপনার খবর কি? রুদ্র কোথায়, কেমন আছে?
আমি এখানে চাকরি করছি। রুদ্র কোথায়, কেমন আছে, জানি না।
আওলাদ হোসেন গুলকিবাড়িতে তাঁর তথ্য অফিসে তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দু গাল হাসলেন।
এরপর ইয়াসমিনকে নিয়ে প্রতিদিনকার অভ্যেসমত রিক্সা করে শহর চক্কর দিতে দিতে কোনও এক বিকেলবেলা গুলকিবাড়িতে আওলাদ হোসেনের তথ্য অফিসে ঢুঁ দিয়ে এসো। বড় একটি মাঠ নিয়ে হলুদ একটি একতলা বাড়ি। আওলাদ হোসেন অফিসের খাতাপত্তর গুটিয়ে রুদ্রর সঙ্গে তোমার সম্পর্কের সমাপ্তির কথা শুনলেন। নিজের কথা বলতে তাঁর কবিতার কথাই বললেন বেশি। কাব্য নাট্য লিখেছেন। সেটি নিয়ে তিনি খুব আশাবাদী। তিনি যে করেই হোক এটি ছাপতে চান। রুদ্র আওলাদ হোসেনের কবিতার খুব প্রশংসা করত। নিশ্চয়ই ভাল লিখেছেন তিনি। ডাক্তারির বাইরে আর কিছু করার না থাকলে তুমি তাই কর, একটি কবি-সংগঠন গড়ে তোলার কথা ভাবো, কবিতা পত্রিকা বের করার ইচ্ছে বুদবুদ করে, এমনকি পুস্তক প্রকাশনার কাজেও হাত দিতে হাত নিশপিশ করে। তুমি এখন উপার্জন কর, মাস গেলে মাইনে পাও, বাপের হোটেলে থাকছ, খাচ্ছ, নিজের টাকা পয়সা খরচ হতে থাকে শিল্প সাহিত্যের সেবায়। আহ, যেন শিল্প সাহিত্য কোনওরকম অসুস্থ ছিল যে তোমার সেবা প্রয়োজন! রোগীর সেবা কর হে বাপু, সাহিত্য বাদ দাও। বাদ দাও বললে বাদ দেওয়া যায় না। পুরোনো শখের শেকড় নতুন ঘটির জল পাচ্ছে। জল পাচ্ছে বলে ঢুঁ মেরে একদিন আওলাদ হোসেনের শখের কাব্য নাট্য নিয়ে জমান প্রিন্টার্সে দিয়ে এসো। আওলাদ হোসেন কথা দেন তিনিই বই বিক্রির ব্যবস্থা করবেন। কাব্য নাট্যটির আগা গোড়া কিছুই না বুঝে তুমি দিব্যি বই বের করে দিলে। তোমার প্রকাশনীর নাম সকাল। সকাল বলে এখন কেউ তোমাকে ডাকে না আর। তুমিই নিজেকে মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ সকাল বলে ডেকে ওঠো। এই সকালে কোনও রোদ নেই। মেঘ মেঘ অন্ধকারে ডুবে আছে তোমার সকাল। সকাল প্রকাশনী থেকে বন্দী দেবতা ছেপে বের করলে নিজে প্রুফ দেখে, গাঁটের পয়সা খরচা করে। আওলাদ হোসেন বলেছিলেন, দুশ বই তিনি নিজেই কিনে নেবেন। কোথায়! দুশ বই আওলাদ হোসেনকে দিলে, তিনশ বই তোমার খাটের তলায়। রুদ্র ময়মনসিংহে বেড়াতে এলে তাকেও কিছু বই দিলে বিক্রি করতে, আওলাদ হোসেনের হলুদ আপিস-বাড়িতে নিয়ে গেলে রুদ্রকে, দু বন্ধুর দেখা করাতে। কিন্তু দেখা তো হল, দেখা হয়ে রুদ্র কি মোটেও সুখ পেয়েছে! পায়নি। বরং সে ঢাকায় ফিরে গিয়ে ইতর নামে ইতরের মত একটি গল্প লিখেছে। সেই ইতরে সে সন্দেহ করেছে যে তুমি যার তার সঙ্গে শুয়ে বেড়াচ্ছে!, আওলাদ হোসেনের সঙ্গেও তোমার সেরকম সম্পর্ক। আসলে তুমি জানো, তুমি কারও সঙ্গে শোওনি। তুমি নিজে জানো যে আওলাদকে নিতান্তই একজন বন্ধু ছাড়া অন্য কোনও ভাবে তুমি দেখ না। তুমি কখনও কল্পনাও করোনি আওলাদের সঙ্গে এই বন্ধুত্বের বাইরে তোমার আর কোনও রকম সম্পর্কের কথা। বরং আওলাদকে বন্ধু বলতেও দিনদিন তোমার আপত্তি হচ্ছে, তাঁর অদ্ভুত আচরণ যে তুমি লক্ষ্য করছ না এমন নয়, করছ। লোকটি উদাসীন, আবার উদাসীনও নয়। কী এক দুর্ভেদ্য ঘোরের মধ্যে থাকেন তিনি। কখনও অনর্গল কথা বলেন, কখনও কোনও কারণ ছাড়াই হেসে ওঠেন, হারমোনিয়ামে মরমিয়া সব সঙ্গীতের সূর তোলেন, আবার কখনও একেবারে চুপ, কোনও কিছুই তাঁর নিমগ্নতা ভাঙতে পারে না। এই আছেন তিনি, এই নেই। আপিসের গাড়ি করে দূর দূরান্তে চলে যাচ্ছেন। গাড়ির চালককে রাতভর খাটাচ্ছেন, কখনও আবার খুব হাসিমুখে চালকের পকেটে টাকা গুঁজে ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন। এক আওলাদ হোসেনের অনেকগুলো চরিত্র। কোনটি আসল, তা তুমি বুঝতে পারো না। ক্রমে ক্রমে তুমি আবিষ্কার করছ যে শম্ভুগঞ্জের এক পীরের কাছে তিনি ঘন ঘন যাচ্ছেন, পীরের সংসারে টাকা পয়সা ঢালছেন, পীরের সঙ্গে বসে গাঁজা খাচ্ছেন। তুমি লক্ষ্য করছ যে আপিসে লোকটি দিন দিন অপ্রিয় হয়ে উঠছেন। নিজের সহকর্মীদের সঙ্গে মোটেও সম্পর্ক মধুর রাখতে পারছেন না তিনি। আওলাদ হোসেনের আপিসের সমস্যা তুমি সমাধান করতে পারো না, কিন্তু একটি সমস্যার সমাধান করতে চাইলে, যখন তাঁর রাঁধা বাড়া করার জন্য ষোল বছরের মরিয়মের সঙ্গে সত্তর বছরের এক বুড়োর বিয়ে ঠিক করলেন তিনি। বুড়োটি আপিসেই পিয়নের কাজ করে। আওলাদ হোসেনের বক্তব্য দুজনে চুটিয়ে প্রেম করছে, করছে যখন, তখন তিনি ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন। চাইলেও তোমার পক্ষে বিয়েটি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। মরিয়মকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে তুমি জিজ্ঞেসও করেছো, কী কারণ এই বুড়োকে বিয়ে করার। মরিয়ম হেসেছে, প্রেমিকারা যেমন করে লাজরাঙা হাসি হাসে তেমন করে। তোমার বিশ্বাস হয়নি মরিয়ম আর আবদুল হামিদ নামের ফোকলা বুড়োর মধ্যে কোনও প্রেম ছিল। সম্ভবত বুড়োর কিছু টাকা আছে আর এক টুকরো জমি আছে, তাই সহায় সম্বলহীন মরিয়মের বাবা এই বিয়েতে রাজি হয়েছেন, মেয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকবে, এই আশায়। বিয়েতে বাধা দেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হল না। নাতির বয়সী মেয়ের সঙ্গে আবদুল হামিদের বিয়ে দেখে এলে, খেয়ে এলে। আওলাদ হোসেনকে তখন থেকে তোমার মনে হয় যেন তিনি কিছু আড়াল করছেন। লোকটি তাঁর রহস্য কোনওদিন ভাঙেন না। ধোঁয়া ধোঁয়া কিছুর আড়ালে তিনি অনড় মূর্তির মত। একদিন তুমি এও জানবে যে আওলাদ হোসেন তাঁর বউকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ছেলে মেয়ে নিয়ে বউ চলে গেছে সিরাজগঞ্জ। অল্প বয়সে চমৎকার গান গাইত এক মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। বাচ্চা কাচ্চাও হয়ে গেছে আর সব বন্ধুদের চেয়ে অনেক আগেই। প্রায়ই যখন তুমি বউ ছেলে মেয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস কর, আওলাদ হোসেন ওদের খবর জানেন না বলে জানিয়ে দেন। তিনি কোনও টাকা পয়সাও পাঠান না ওদের জন্য। তুমি লক্ষ্য কর, ওদের জন্য লোকটির মোটেও কোনও মায়া হয় না। বউ তাঁর অবাধ্য হয়েছিল বলে তিনি শাস্তি দিয়েছেন। তিনি স্বামী, তিনি সে ক্ষমতা রাখেন। তিনি কবি, তিনি ভাবুক, তিনি এই, তিনি সেই। তিনি লাটসাব, তিনি জমিদার। জমিদারের খবর নিতে তুমি আগ্রহ হারাতে থাকো। না দেখা বউটির জন্য তোমার খুব মায়া হতে থাকে। তুমি বউটির কষ্ট অনুভব করতে থাকো। বছর চলে যায়, তুমি সকাল কবিতা পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুললে আর শহরের কবি আর আবৃত্তিকাররা যোগ দিচ্ছে তোমার সংগঠনে, এই সংগঠনে আওলাদ হোসেনকে যুক্ত করতে পারলে মন্দ হয় না, একজন কেউ প্রস্তাব করার পর তুমি খোঁজ নিয়ে দেখলে আওলাদ হোসেন আর ক্লিন শেভড স্যুটেড বুটেড ভদ্রলোক নন। তিনি শম্ভুগঞ্জে পীরের আসরে গাঁজা টেনে টেনে, পীরকে টাকা পয়সা যা ছিল সব দান করে এখন সর্বস্বান্ত। চাকরিটিও গেছে। মাথা পাগল লোক। খালি পায়ে হাঁটেন। ময়লা কাপড়চোপড়। চুল দাড়িতে মুখ ঢেকে গেছে। আরোগ্য বিতানে নেমে তোমার দাদার কাছ থেকে দু পাঁচ টাকা ভিক্ষে চান। তোমার কাছেও এলেন একদিন টাকা চাইতে। মায়া হল বলে দিলে। আওলাদ হোসেন বগলতলায় একটি বড় বাঁধাই খাতা নিয়ে ঘোরেন আর বলেন তিনি চমৎকার একটি কাব্যনাট্য লিখেছেন, এটি ছাপা হলে, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীতে হৈ চৈ পড়ে যাবে। আওলাদ হোসেনকে দেখে সত্যিই খুব মায়া হয় তোমার। সিরাজগঞ্জের জমিদারপুত্র আওলাদ হোসেন ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার থেকে এক বছরের মধ্যে এখন পথের ভিখিরি। যে মানুষ শখ করে নিজের এমন সর্বনাশ করেছে, তুমি কী ইবা করতে পারো তাঁর জন্য! কিছুই না। তুমি সিদ্ধান্ত নাও এই লোকের জন্য তোমার দরজা আর তুমি খুলবে না, লোককে টাকাও আর দেবে না। টাকা পয়সা অন্য খাতে ঢালা বরং ভাল।