আমার ইশকুল বা কলেজ জীবনের কোনও বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। ঝুনু খালার মুখে শুনেছি, আমার ইশকুলের বান্ধবী সারা এখন ভিখারুন্নেসা ইশকুলের বাংলার শিক্ষিকা। শুনে আমি উত্তেজিত সারার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সারা একদিন আসে আমার বাড়িতে। আমরা দুজন মুখোমুখি বসি। কথা হয়। কিন্তু সে কথায় প্রাণ নেই। এই সারার সঙ্গে ছোটবেলার কত মধুর দিন কেটেছে আমার, আজ সারার সঙ্গে কথা বলার মত কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। আর বন্ধুরা কে কোথায় আছে জানতে চাওয়া, স্বামী কি করে, বাচ্চাদের বয়স কত এসবের পর আমরা দুজন চুপচাপ বসে থাকি। বিদ্যাময়ী ইশকুলের বান্ধবী পাপড়ি আমার শান্তিবাগের বাড়িতে একদিন এসেছিল, ওর সঙ্গেও কথা খুঁজে পাইনি বেশি। জীবন যাপনের পার্থক্য বড় বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। আমার কোনও স্বামী সন্তান নেই। সবাই এখন ঘর সংসার করছে। সবারই চাকরি বাকরি আছে। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। এখন পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ওঠা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না, বিশেষ করে সে বান্ধবী যদি একা হয়। ভয় তো খানিকটা কাজ করেই, স্বামী যদি আবার প্রেমে পড়ে যায় বান্ধবীটির। তার চেয়ে বিবাহিতাদের বিবাহিতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা স্বস্তিকর। আমার ডাক্তার বন্ধু বা বান্ধবীরা এখন কে কোথায় আছে, জানি না। ঢাকা শহরে নিশ্চয়ই অনেকে আছে, কিন্তু কারও সঙ্গেই আর দেখা হয় না। নাসিমুল যখন মিটফোর্ডে কাজ করত, দেখা হয়েছে কদিন। ও জাপানে যাবার চেষ্টা করছিল তখন। সবাই কেমন দূরে চলে গেছে। অথচ সেই দিনগুলি মনে হয় এত কাছে, যেন হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যাবে। যেন বন্ধুরা আবার সব একসঙ্গে হব। কোথায়! দিন তো কেবল চলেই যাচ্ছে। আমরা তো পরস্পরকে কেবল হারিয়েই ফেলছি। তিন বছর আগে হঠাৎ একদিন বইমেলায় শাফিনাজ এসেছিল হন্তদন্ত হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে, চেম্বার থেকে খানিকক্ষণের জন্য ছুটি নিয়ে ছুটে এসেছিল। বিদ্যাপ্রকাশের দোকানে ঢুকেই আমাকে বলল, কেমন আছ, তোমার জন্য চিন্তা হয়, সাবধানে থেকো কেবল এটুকুই বলার সময় ছিল ওর। রোগী বসে আছে, ফিরে যেতে হবে। শাফিনাজ, কী ঘনিষ্ঠই না ছিল আমার। ঢাকা শহরেই দুজন বাস করি, অথচ বছর চলে যায়, বয়স চলে যায়, দেখা হয় না। পিজি হাসপাতালে একবার শিপ্রার সঙ্গে গিয়েছিলাম, হালিদার সঙ্গে দেখা হয়েছে। খুব অল্প সময় কথা হয়েছে। হালিদা তখনও বিয়ে করেনি, বলেছে বিয়ে টিয়ে ও আর করছে না। এই একজনই বিয়ে না করা বান্ধবী আছে। শিপ্রা, খসরু একদিন জানালেন, রাজশাহী চলে গেছে। ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে যদি কোনও বড় হাসপাতালে চাকরি করা যায়, কোনও না কোনও সূত্রে যোগাযোগ হয়ত হত। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বিচ্ছিত হয়ে গেলে সেই যোগাযোগটিও আর থাকে না। একদিন আমার এক ইশকুলের বান্ধবী এসেছিল শান্তিবাগের বাড়িতে, সে মিটফোর্ড হাসপাতালে নার্সের চাকরি করে। আমাকে হাসপাতালে প্রতিদিনই দেখেছে, কিন্তু লজ্জায় পরিচয় দিতে পারেনি। আমি ডাক্তার, সে নার্স, তাই নাকি তার লজ্জা হয়েছে পরিচয় দিতে। এত অন্যরকম হয়ে গেছে লাকি, সেই আগের গাল ফোলা মুখটি আর নেই, চোখ বসা, গাল বসা মেয়েটি যে সেই লাকি, পরিচয়ের পরও আমার চিনতে কষ্ট হয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি দূরে চলে গেছি, নাকি ওরা দূরে চলে গেছে! নাকি সময় আমাদের দূরে সরিয়েছে! নাকি জীবনই এমন, পুরোনো ফেলে নতুনের দিকে যেতে চায় কেবল! পুরোনো দিনের কথা জানালায় বসে ভাবতে ভাল লাগে, দিনগুলো আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। যখন কল্পনা করি সেই জীবনে ফেরার, তখন এই বয়সে সেই জীবনে যাওয়ার কল্পনা করি না, মনে মনে আসলে সেই বয়সী, সেই পুরোনো পরিবেশের মানুষটি আমি যাই সেই জীবনে, সেই পুরোনো মানুষটিকে পুরোনো জীবনে ফেরানো আর এখন পুরোনোকে নতুন জীবনের মধ্যিখানে সত্যিকার দাঁড় করানো দুটো দু জিনিস। মেলে না। অবকাশ আমার কত আপন, অথচ এখন অবকাশে গেলে বেশিক্ষণ কাটাতে ইচ্ছে করে না, কী যেন বড় বড় নেই নেই লাগে। কী নেই! আমার শৈশব কৈশোরটি আমার ভেতরে আর নেই! নাকি আগের মানুষগুলো আর আগের মত নেই! বদলে গেছে। সবকিছুই বদলে যাচ্ছে। স্বীকার করতেই হয় যে আজ যে দিন চলে যাচ্ছে, সে দিন চলে যাচ্ছেই। আগামীকালের দিনটি নতুন একটি দিন। আজ যা হারাচ্ছি, কাল তা ফিরে পাবো না। আমরা খুব দ্রুত ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি, এত দ্রুত, যেন দৌড়োচ্ছি। আমরা বড় হয়ে যাচ্ছি, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, আমাদের সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, ভাবলে বুকের মধ্যে চিনচিন একটি ব্যথা হয়, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, জীবন এত ছোট কেন! কাকে বলব, সকলেই তো জানে জীবন খুব ছোট। সম্ভবত মিনু জানে না, মিনুর কাছে জীবন খুব দীর্ঘ বড় দীর্ঘ বলে মনে হয়, যেন ফুরোচ্ছে না। একটিই জীবন আমাদের, কেউ এটিকে হেলায় ফেলায় নষ্ট করে, কেউ এটিকে দুর্বিসহ বলে মনে করে, কারও কাছে জীবন বড় অমূল্য সম্পদ। এক আমার কাছেই জীবনকে মনে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন, কখনও এটি সুন্দর, কখনও কুৎসিত, কখনও সয়, কখনও নয়, কখনও আবার এর রূপ রস গন্ধে এত বিভোর হই যে আঁকড়ে ধরি যেন কোনওদিন পালিয়ে না যায়।
ঢোলের বাজনা শুনছি। রাস্তায় জমজমাট পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রা। ছেলেরা ধুতি পরে ঢোল বাজাচ্ছে, মেয়েরা আটপৌরে শাড়ি পরে কলসি কাখে নাচছে। রঙিন কাগজে বানানো বিশাল বিশাল হাতি ঘোড়া বাঘ ভালুক নিয়ে হাঁটছে মানুষ। রূপকথার চরিত্রদের মুখোশ পরেছে অনেকে। ছায়ানট সকাল থেকে বসে গেছে রমনার বটমূলে। চারদিকে গানের উৎসব হচ্ছে। সমবেত কণ্ঠে বাঁধ ভেঙে দাও এর সুর, জীর্ণ পুরাতন ছূঁড়ে ফেলে নতুনকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। পুরো ঢাকার মানুষ জড়ো হয়েছে রমনায়, রমনার আশে পাশে। নকশি কাঁথা পেতে বসেছে ঘাসে, তালপাখায় বাতাস করছে। মুড়িমুড়কি খাচ্ছে। সোহরওয়ার্দি উদ্যানে ফকির আলমগীর গাইছেন মানুষের মুক্তির গান। আগে অর্ধেক রাত পর্যন্ত ফকির আলমগীরের মঞ্চ বানানোর কাজ দেখতাম, গানের আড্ডায় কেটে যেত পয়লা বৈশাখের আগের রাতটি। প্রতি পয়লা বৈশাখে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে আমিও ছিলাম। ভোর বেলা থেকে শুরু করে মধ্য রাত পর্যন্ত উৎসবে, আনন্দে। আমার তো বছরে দুটো দিনই আছে উৎসবে মাতার। একুশে ফেব্রুয়ারি আর পয়লা বৈশাখ। আমার ঈদ নেই, শবে বরাত নেই, শবে কদর নেই, ফাতেহা এ দোয়াজদহম, ফাতেহা এ ইয়াজদহম, মিলাদুন্নবি নেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে কোনও ধর্মীয় উৎসবে আমি জড়িত হই না। আমার কেবল ছিল বাংলা আর বাঙালির উৎসব। আজ সবারই অধিকার আছে, কেবল আমারই নেই উৎসবের একজন হওয়ার, মাঠে ময়দানে কোথাও গিয়ে গান শোনার অধিকার আমার নেই। রমনায় আজ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে সানজিদা খাতুনের ছায়ানট। মাঠে মাঠে আজ মেলা বসেছে। চারদিকে কুটিরশিল্পের মেলা, বাংলা বইয়ের মেলা, গানের মেলা, নৃত্যমেলা, উৎসব উৎসব গন্ধ ভেসে আসছে চারদিক থেকে। কেবল আমিই, আমিই একা ঘরে, জীর্ণ পুরাতন আমি, বসে আছি একা একা, নতুনকে বরণ করার অধিকার আমার নেই। বিষণ্নতা আমাকে বিবশ করে রাখে।