আমার এখনকার বন্ধু বা শুভাকাঙ্খীর সকলে আমার চেয়ে বয়সে হয় অনেক বড়, নয় অনেক ছোট। সমবয়সী কোনও বন্ধু নেই আমার। আমার বাড়িতে যেমন অখ্যাত মানুষের আনাগোনা, তেমন বিখ্যাত মানুষের। সকলেরই সমান আদর এ বাড়িতে। মনে যদি মেলে, তবে বয়স কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বন্ধু হতে গেলে কবি বা লেখক হতে হবে, এমন কোনও নিয়ম আমার নেই। গার্মেণ্টেসএর কাঠখোট্টা ব্যবসায়ী ইয়াহিয়া খান যেমন বন্ধু, আপাদমস্তক কবি নির্মলেন্দু গুণও তেমন বন্ধু। ইয়াহিয়া খানের তবু সাহিত্যজ্ঞান কিছু আছে, মাঝে মাঝে কবিতাও লেখেন। কিন্তু খসরু সাহিত্যের ধারে কাছে নেই। শুরু থেকে শেষ অবদি তিনি ব্যবসায়ী, তিনি আমার ভাল বন্ধু। মিলনের বড় বোন মিনা স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, রুমি নামের এক ছেলের সঙ্গে দীর্ঘদিন তার প্রেম, রুমিকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেছে, এ সময় তার একটি চাকরি দরকার। জীবনে কখনও চাকরি করেনি, সেই কতকাল আগে বিএ পাশ করেছে। এখন কে দেবে তাকে চাকরি। খসরুকে বললে তিনি মিনাকে তাঁর আপিসেই সেক্রেটারির একটি চাকরি দেন। স্বামীর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এসে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, এরকম মেয়ের সংখ্যা অনেক। অনেক মেয়ের কেবল সুযোগ নেই বলে মুখ বুজে পড়ে থাকে ভালবাসাহীন সংসারে। আমার ইচ্ছে করে একটি কর্মজীবী হোস্টেল তৈরি করতে মেয়েদের জন্য। কিন্তু অত টাকা কোথায় পাবো। খসরু সাহিত্যিক নন, ডাক্তার রশীদও সাহিত্যিক নন, কিন্তু রশীদের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা যে কোনও বিষয়ে আমি কথা বলতে পারি। কেবল খুব বিখ্যাত মানুষই যে জ্ঞানী হন বা উদার হন, তা নয়। এই জীবনে অনেক অখ্যাত মানুষের মহানুভবতা আর প্রশস্তচিত্ততা আমাকে অভিভূত করেছে। এত ছোট লেখক হয়েও এত তুচ্ছ প্রাণী হয়েও আমার সৌভাগ্য যে অনেক বড় বড় লেখকের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। এ বাড়িতে শিব নারায়ণ রায়ের মত পণ্ডিত লোকও এসে থেকেছেন। শিব নারায়ণ রায় আর অম্লান দত্তকে বক্তৃতা করার জন্য এক অনুষ্ঠানে ডেকেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন অম্লান দত্তকে নিয়ে। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর জন্য আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা। কিছু কিছু মানুষ আছেন দেশে, যাঁদের আলোয় আমরা আলোকিত। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার দেশটিতে নক্ষত্রের মত জ্বলছেন তাঁরা। অম্লান দত্ত ছোটখাটো মানুষ, অতি সস্তা অতি মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরেন, অতি সাধারণ জীবন যাপন তাঁর, হেঁটে গেলে যে কেউ ভাববে কোনও সদাগরি আপিসের ছাপোষা কেরানি বুঝি। কথা কম বলেন, কিন্তু যখন বলেন, এত সুন্দর বলেন, যে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ব ভারতীর উপাচার্য ছিলেন অম্লান দত্ত অথচ অহংকারের একটি কণাও তাঁর মধ্যে নেই। অম্লান দত্ত ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। দুজনের অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্ব। ফেরদৌসী জাত শিল্পী। গাছের মরা ডাল শেকড় তিনি কুড়িয়ে আনেন, সেগুলোর দিকে তন্ময় তাকিয়ে থেকে থেকে আবিস্কার করেন সৌন্দর্য, শিল্প। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার চোখ সবার নেই। ফেরদৌসীর এই অসাধারণ গুণের কথা তখনও খুব বেশি কেউ জানে না। আমার বিশ্বাস, এই শিল্পটি একদিন আদর পাবে, এ দেশের একজন বড় শিল্পী হিসেবে তিনি সম্মান অর্জন করবেন। ফেরদৌসির যে গুণটি আমার সবচেয়ে ভাল লাগে, তা তাঁর সারল্য, তাঁর মুক্ত হৃদয়। তিনি কিছু লুকোতে, কিছু আড়াল করতে পছন্দ করেন না। অবলীলায় বলে যাচ্ছেন নিজের দোষের কথা, নিজের অক্ষমতার কথা, নিজের অপারগতার কথা। কজন সাধ্য রাখেন তা বলতে! ফেরদৌসীর তিন মেয়ে, রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনী, চন্দ্রেশ্বরী প্রিয়দর্শিনী, ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী। ফেরদৌসীও নিজের নামের সঙ্গে প্রিয়ভাষিনী যোগ করে নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তাঁর স্নেহ পেয়ে আমি ধন্য হই। শিবনারায়ণ রায়ের জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, হোটেল ছেড়ে দিয়ে তিনি আমার অতিথি হয়েছেন। নির্মলেন্দু গুণ আর মহাদেব সাহা এসেছিলেন শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। ‘এই যে ফতোয়া দেওয়া হল তসলিমাকে, এই যে মাথার মূল্য ঘোষণা করা হল, এর প্রতিবাদ কি কিছু করছেন আপনারা?’ শিবনারায়ণ রায় জিজ্ঞেস করলেন। নির্মলেন্দু গুণ বললেন, ‘প্রতিবাদ তো অনেক হয়েছে।’ ধমক দিয়ে উঠলেন শিবনারায়ণ, ‘অনেক হয়েছে মানে? কী হয়েছে? কতটুকু আন্দোলন হয়েছে এসবের বিরুদ্ধে? কিছুই করছেন না আপনারা। কিছুই না।’ শিবনারায়ণের সঙ্গে নির্মলেন্দু গুণের আলাপ বহু বছরের। তাঁর মেয়ে মৈত্রেয়ী রায়ের প্রেমে একসময় খুব উতলা হয়েছিলেন গুণ, মৈত্রেয়ী গুণের প্রেমে পড়েনি, গুণ শেষ পর্যন্ত নীরা লাহিড়ীর কাছেই নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। ধমক খাবার পর বেশিক্ষণ বসেননি গুণ আর মহাদেব। আমি খুব অপ্রতিভ বোধ করছিলাম। ফতোয়া ঠেকানোর সাধ্য কি ওঁদের আছে! আমার দুঃসময়ে কাছে আছেন ওঁরা, এই তো আমার জন্য অনেক বেশি। ওঁরা মানুষ হিসেবে বড় বলেই সকল ঈর্ষার উর্ধে। মাঝারি কবি বা লেখকরা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যান। সৈয়দ শামসুল হক আর হুমায়ুন আজাদের মত বড় লেখক যদি ঈর্ষা করেন, তবে মাঝারিরা করবেন না কেন! ঈর্ষা শুরু হয়েছে আমার বই যখন বেশি বিক্রি হতে শুরু হল তখন থেকে, আর আনন্দ পুরষ্কার তো ঈর্ষার আগুনকে আরও দপদপ করে জ্বালিয়ে দিল। আমার জন্মের আগে থেকে ওঁরা লিখছেন, আর কি না পুরষ্কার দেওয়া হয় আমাকে! এ কারও কারও সয়, সবার সয় না। কেবল হাতে গোনা কজন লেখক কবিই আমার সত্যিকারের বন্ধু। বন্ধু তো যে কেউ হতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের আর কজন হতে পারে! কবি রফিক আজাদকেই দেখেছি, সামনে প্রশংসা করেন, আড়ালে গাল দেন। সাহিত্য জগতে এধরনের লোকের সংখ্যাই বেশি। রফিক আজাদকে কবি হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি, প্রচণ্ড আমুদে লোক, আড্ডা জমিয়ে রাখেন চমৎকার চমৎকার সব কথা বলে। আমি কারও থেকে দূরে সরতে চাইনি, ধীরে ধীরে বুঝেছি আমি সব কবি বা লেখকের কাছে কাঙ্খিত নই। জনপ্রিয়তা আর পুরষ্কার আমাকে অনেকটাই নিঃসঙ্গ করেছে। ফতোয়ার কারণে আমার নামটি বিদেশে জেনেছে বলে দেশের ভেতর আমি আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়েছি। মাঝারিরা বলছেন, ফতোয়াটির ব্যবস্থা নাকি আমি নিজেই করেছি, যেন নাম হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, আসলে কি ওঁরা আমাকে ঈর্ষা করেন! নাকি এ নিতান্তই আমার আত্মাভিমান! নিজেকে আমি এত বড় ভাবছি যে মনে হচ্ছে আমি যেন ঈর্ষার বস্তু হয়ে গেছি। অন্য কিছুও তো হতে পারে, সম্ভবত আমি ভাল লেখক নই, ভাল কবি নই, সে কারণেই আমার নামটি কালো কালিতে ঢেকে দিয়েছেন ওঁরা। ছোট লেখক যদি বড় পুরস্কার হাতিয়ে নিতে পারে, সন্দেহ হবে না কেন ওঁদের! ওঁদের চোখ দিয়েও নিজেকে দেখি আমি, যদি বাজারে গুঞ্জন শোনা যায় যে আমি পঁয়তাল্লিশ লক্ষ টাকা ঘুস নিয়েছি একটি বই লিখে, আর সেই টাকায় নিজের সুখের জন্য বাড়ি গাড়ি কিনেছি, তবে কেন ওঁরা কুঞ্চিত চোখে কুপিত দৃষ্টি ছুঁড়বেন না! আমাকে কুটিল, কূলটা, কুচরিত্র বলেই তো মনে হবে। আমাকে ঘৃণা না করার, ভাবি, কোনও কারণ নেই।