‘বউ তো বেশ সুন্দর!’
হাবিবুল্লাহ হেসে বলে, ‘আগে আরও সুন্দর ছিল। এখন তো বাচ্চা টাচ্চা হওয়ার পর ..’
আমার লেখার ঘরে, এমন কী শোবার ঘরেও দুজনে নিরালায় বসে থেকে দেখেছি হাবিবুল্লাহ আমার দিকে কখনও প্রেম চোখে তাকায়নি। কখনও সে পুরোনো সেই দিনের কথা তোলেনি। যত আমি অতীতে ফিরি, সে তত বর্তমানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে, একদিকে ব্উ আরেকদিকে দুই বাচ্চা। এই হাবিবুল্লাহ সেই হাবিবুল্লাহই, কিন্তু এই হাবিবুল্লাহ সেই হাবিবুল্লাহ নয়। তার প্রেম আমার জন্য আর একফোঁটা অবশিষ্ট নেই। আমার ইচ্ছে গুলোকে আমি নিঃশব্দে সরিয়ে রাখি।
হাবিবুল্লাহ আমাকে সেই আগের মত লাজুক হেসে বলে, ‘তোমাকে একটা কথা বলব, রাখবে?’
‘কি কথা?’ সোৎসাহে জানতে চাই। তার বুকের ভেতর আমার জন্য আগের সেই ধুকপুকুনি এখন যে আছে সে কথাই বলবে বোধ হয়।
‘জানি, তুমি পারবে, যদি চাও।’ বলে হাবিবুল্লাহ আবার সেই মিষ্টি লাজুক হাসিটি হাসে।
‘কি কথা, আগে তো শুনি।’ হৃদয় আমার চঞ্চল হয়ে ওঠে। শান্ত প্রকৃতিতে দোল লেগেছে। জলে ঢেউএর কাঁপন উঠেছে।
হাবিবুল্লাহর ঠোঁটে অপ্রস্তত হাসি। কথাটি সে শেষ পর্যন্ত বলে, যে কথাটি বলতে চায়। ‘আমাকে তুমি আমেরিকা পাঠানোর ব্যবস্থা কর।’
মুহূর্তে কাঁপন থেমে যায়। থেমে যায় সব আলোড়ন। আমার জন্য এটি এক অপার বিস্ময়। যে বিস্ময় মনকে বড় তিক্ত করে।
নিস্পৃহ কণ্ঠে প্রশ্ন বলি, ‘আমি? আমেরিকা পাঠাবো? কি করে পাঠাবো?’
‘তুমি পারবে। তোমার তো অনেক বিদেশে যোগাযোগ আছে। তুমি চাইলেই পারবে। এই দেশে ডাক্তারি করে কোনও টাকা পয়সা বানানো যায় না। এখন যদি আমেরিকায় যেতে পারি, তবেই ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।’
আমি কাউকে আমেরিকা পাঠানোর ক্ষমতা রাখি না, এ কথাটি হাবিবুল্লাহকে বললেও সে মানে না। তার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার দ্বারা এখন সবকিছুই সম্ভব। আমি অসম্ভব ক্ষমতাধারী একজন কেউ।
মা হাবিবুল্লাহকে সেই আগের মত পাতে বেড়ে বেড়ে খাওয়ান। এই মার চোখে হাবিবুল্লাহ আর আমাকে নিয়ে একসময় কত স্বপ্ন ছিল। খেতে খেতে হাবিবুল্লাহ বলে, জ্ঞআমার ওয়াইফও খুব ভাল রাঁধে খালাম্মা।’
এত ওয়াইফের গল্প শুনতে মারও বোধহয় ভাল লাগে না। মা সম্ভবত জানেন, হাবিবুল্লাহর সঙ্গে আমি দেখা করতে চেয়েছি তার ওয়াইফের গল্প শোনার জন্য নয়। আমার ইচ্ছেগুলো কাউকে আমি বলিনি। কিন্তু মার নিরুত্তাপ চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, মা আমার ইচ্ছেগুলো কখনও গোপনে পড়ে নিয়েছেন।
চলে যাওয়ার আগে হাবিবুল্লাহ বলে, ‘দেখ, তোমার এই ভাইটার জন্য কিছু করতে পারো কি না।’
প্রেমিক কি না শেষ পর্যন্ত ভাই এ নেমেছে। হা কপাল!
হাবিবুল্লাহ চলে যাওয়ার পর আমি অন্ধকার বারান্দায় একা বসে থাকি তারা ফোটা আকাশের দিকে তাকিয়ে। বড় নিঃসঙ্গ লাগে। বাড়িভর্তি মানুষ, সকলে আমার আপন, আত্মীয়, তার পরও যেন আমার মত এত একা কেউ নেই। হাবিবুল্লাহকে আমি মনে মনে ক্ষমা করে দিই। তার এই জীবনটি সেই জীবন নয়। যে জীবন যায়, সে জীবন যায়ই। বারোটি বছর চলে গেছে। অবুঝ কিশোরীর মত আমি বারো বছর আগের পুরোনো প্রেম ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। দীর্ঘ বারো বছর। কম সময় নয়। সময় অনেকটা খুনীর মত। প্রেমকে খুন করে নিঃশব্দে চলে যায় সময়, আমাদের কারও বোঝার আগেই।
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত। যে প্রেম সত্যিকার প্রেম ছিল, তাকে অবহেলায় ছুঁড়ে দিয়েছিলাম, বুঝিনি কি হারাচ্ছি আমি। আজ বুঝি কি হারিয়েছি। আজ নিঃসঙ্গতা আমার কানে কানে বলে যায়, ‘তুমি খুব বোকা মেয়ে। তুমি আসল সোনা ছেড়ে নকল সোনা নিয়ে পড়ে ছিলে পুরো যৌবন।’ আজ আর সেই প্রেম আমি ফিরে পেতে পারি না। দেরি হয়ে গেছে। খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। কখন যে যেতে যেতে তিরিশ বছর চলে গেছে, খেয়াল করিনি। হাবিবুল্লাহ সুখে থাক বউ বাচ্চা নিয়ে। বিবাহিত পুরুষরো স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত হলে আমার ভাল লাগে। কায়সারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি মাঝে মাঝে আমাকে দেয়। কায়সারকে বলেওছি কদিন, ‘তুই আর আসিস না আমার কাছে, হেনুকে নিয়ে সুখে থাক। অন্য কোনও মেয়ের কাছে যাওয়ার তো দরকার নেই।’ কায়সার তবুও আসে। সপ্তাহে একদিন হলেও আসে, একঘন্টার জন্য হলেও আসে। অবশ্য মাঝে মাঝে সপ্তাহ দুসপ্তাহ পার হয়ে যায়, এমনকী মাসও পার হয়, মনে হয় কায়সার বুঝি আর আসবে না, কিন্তু ঠিকই উদয় হয়। একদিন কায়সারের বউ হেনু আমাকে ফোন করে বলেছে, ‘কি করে আমার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক করেন? আপনার লজ্জা হয় না? আপনি না মেয়েদের কথা লেখেন! তবে আরেক মেয়ের সর্বনাশ করেন কেন?’ আমি ক্ষণকাল বাক্যহারা বসে ছিলাম। হেনুকে কোনও উত্তর দিতে পারিনি। এরপর শুকনো গলায় বলেছি, ‘আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন, তাকে ফেরান। তাকে বলেন যেন আমার কাছে আর না আসে।’ বড় অপরাধী লাগে নিজেকে। কিন্তু কি করে ফেরাবো আমাকে। এই সঙ্গীহীন প্রেমহীন জীবনে কায়সার যদি কোনও কোনওদিন আমাকে সামান্য সঙ্গ দেয়, আমি কী করে বাধা দেব নিজেকে সেটি গ্রহণ না করার জন্য! আমাকে সন্যাসী হতে হবে যে! এত পিপাসা রেখে কী করেই বা জল ছোঁবো না! আমি তো মানুষ, দেবী নই। অবিবাহিত কোনও পুরুষ প্রেমিক যদি পেতাম অপরাধ বোধটি যেত। কিন্তু যেতে যেতে আমার যে তিরিশ বছর চলে গেছে। সমবয়সীরা সকলেই বিবাহিত। আমার জন্য কেউ বসে নেই এই দুনিয়ায়। হাবিবুল্লাহর মত উন্মাদ প্রেমিকও বসে নেই।