প্রেম করা কোনও দোষের ব্যপার নয়, প্রেমে মানুষ যে কোনও বয়সেই পড়তে পারে। আমারও মাঝে মাঝে খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করে। কোনও উতল প্রেমে যদি একবার ভাসতে পারতাম! ইচ্ছেটি আমার বুকের ভেতর কোথাও গোপনে লুকিয়ে থাকে, বুঝি না যে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ মন যখন খুব উদাস হয়ে আসে, একা বসে থেকে থেকে ইচ্ছেটিকে টের পাই, ইচ্ছেটিকে আলতো করে তুলে নিয়ে ইচ্ছেটির গায়ে আমি নরম আঙুল রাখি। জীবনের রূঢ়তা, ক্রূরতা থেকে ইচ্ছেটির পেলব শরীর আমি আড়াল করে রাখি। রূপবান রুচিবান রসজ্ঞ আলমগীরকে দেখে কদিন রঙিন হয়েছিলাম। আলমগীরের বিয়ে ভেঙে গেছে, এখন নতুন করে সে একটি প্রেম এবং একটি বিয়ের কথা ভাবছে। তার হৃদয়ের দরজা হাট করে খোলা। দরজা খোলা থাকলে যাতায়াত করা যায়, কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে গেলেই অস্থির লাগে। আলমগীরের প্রেমে আমি পড়তে পড়তেও পড়িনি। ভাল লাগে তার সঙ্গ, এটুকুই। কায়সারের সঙ্গে সম্পর্কটি এখন সাদামাটা শারীরিক সম্পর্ক। কায়সারকে আমার পেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তার জন্য আমার মন কেমন করে না। প্রেমের ইচ্ছেটি গুনগুন করে আমাকে গান শোনাচ্ছে যখন, মনে পড়ে সেই কলেজ জীবনের হাবিবুল্লাহকে। আমাকে কী উন্মাদের মতই না ভালবাসত হাবিবুল্লাহ ! যখন সে জানল যে আমি তাকে ভালবাসি না, ভালবাসি রুদ্রকে, সে নাওয়া খাওয়া লেখাপড়া সব ছেড়ে দিয়ে লাইলির জন্য যেমন হয়েছিল মজনু, তেমন হয়ে উঠেছিল। দাড়ি কাটে না, চুল কাটে না, ক্লাস করে না, পরীক্ষা দেয় না, দিলেও একের পর এক ফেল করতে থাকে। আমার নাম জপতে তার দিন যায়, রাত যায়। একদিন রুদ্রকে হাতের কাছে পেয়ে মাথায় রক্ত চেপেছিল ছেলের, রুদ্রকে সে মেরেছিল, সত্যিকার মেরেছিল, বলেছিল, আর যদি কোনওদিন তাকে সে দেখে কলেজ এলাকায়, তবে খুন করবে। সেই হাবিবুল্লাহ। এ জীবনে একজনই আমাকে সত্যিকার ভালবেসেছিল। এতটা জীবন পেরিয়ে, এতটা বয়স পেরিয়ে সেই ভালবাসা আমার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। হাবিবুল্লাহ যদি আমাকে আগের মত ভালবাসতে পারে, তবে আমি এবার আর তাকে ফিরিয়ে দেব না। আমিও বাসব ভাল। আসলে ভালবাসলে ওরকম ভাবেই বাসতে হয়। ওরকম তীব্র করে, ওরকম জগত সংসার তুচ্ছ করে। বাধভাঙা প্রেমের জোয়ারে ভাসতে আমার সাধ জাগে। হাবিবুল্লাহ কেমন আছে, কোথায় আছে কিছুই জানি না। আমার গোপন ইচ্ছেটি তার খোঁজ করে, করে করে একদিন মেলে খোঁজ। হাবিবুল্লাহ নামের একজন ডাক্তার ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চাকরি করে। ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে পাশ করেছে। এ নিশ্চয়ই সেই হাবিবুল্লাহ। পঙ্গু হাসপাতাল ফোন করে করে আমি তাকে পাই। ফোনেই কথা হয় হাবিবুল্লাহর সঙ্গে। এই হাবিবুল্লাহ সেই হাবিবুল্লাহই। আমার ফোন তার কাছে অপ্রত্যাশিত। বাড়িতে আসতে বলি তাকে। এক সন্ধেয় সুদর্শন যুবকটি আমার বাড়িতে এসে হাজির হয়। আগের মতই আছে। এতটুকু পরিবর্তন নেই। প্রথমেই সম্বোধন নিয়ে আড়ষ্টতা। আমরা তুই বলতাম পরষ্পরকে। কিন্তু হাবিবুল্লাহ তুমি বলে সম্বোধন করার পর আমার জিভে তুই তুমি আপনি কিছুই আর আসে না। অতপর ভাববাচ্যের আশ্রয় নিই। ভাববাচ্যে খুব বেশিদূর কথা এগোতে চায় না। থেমে থেমে যায়। দুচারটে কথা হওয়ার পর হাবিবুল্লাহ তার জীবনের দুটো সুখবর দেয়, সে বিয়ে করেছে, তার দুটো বাচ্চা আছে। যে তুফান বইছিল, সেটি হঠাৎ থেমে শান্ত হয়ে যায়। স্তব্ধ চরাচর জুড়ে কেবল জল পড়ার টুপটুপ শব্দ, কোথাও কেউ নেই, অসহ্য নির্জন চারদিক। কেন অবাক হই! আমি কি মনে মনে ভেবেছিলাম যে হাবিবুল্লাহ আমার বিরহে চিরকুমার থেকে গেছে। হ্যাঁ ভেবেছিলাম বৈ কি। দূরাশাকে আশার মত দেখতে লেগেছে।
‘তোমার ভাবীকে বললাম, পুরোনো এক কলেজ-ফ্রেণ্ডএর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি..’
‘আমার ভাবী?’ বিস্ময়ে তাকাই, হাবিবুল্লাহর সঙ্গে কখন হাসিনা বা গীতার দেখা হল! হাবিবুল্লাহ লাজুক হেসে বলল, ‘আমার ওয়াইফ।’
ও। মুখে আমার মলিন হাসি সামাজিক কথাবার্তার নিয়মের সঙ্গে বহুদিন আমার সম্পর্ক নেই। কী জানি, কখনও কি ছিল!
হাবিবুল্লাহ নিজের চাকরি, নিজের সংসার ইত্যাদির গল্প বলে। আর ক্ষণে ক্ষণেই আমার প্রসঙ্গে বলে, ‘তুমি তো খুব বড় হয়ে গেছ। অনেক টাকা পয়সা করেছো। আমাদের এই ডাক্তারি চাকরি করে আর কত পয়সা পাওয়া যায়! জীবন চলে না।’
বাড়িটি গোল গোল চোখ করে দেখতে দেখতে বলে, বাড়িটা কিনেছো বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’
‘অনেক দাম তো নিশ্চয়ই। আমার কি আর বাড়ি কেনার সামর্থ হবে?’
‘কেন হবে না, নিশ্চয়ই হবে।’
‘আরে নাহ! যে টাকা পাই, সে টাকা তো খাবার খরচেই চলে যায়। বাপের বাড়িতে থাকি.। তাই চলতে পারছি।’
‘বাপের বাড়িতে থাকলে অসুবিধে কি? নিজের বাড়ি হতেই হবে, এমন কি কোনও কথা আছে!’
‘তোমার তো গাড়িও আছে নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ আছে।’
‘বেশ টাকা করেছো।’
‘নাহ। খুব বেশি না। আর.. টাকা পয়সা কি সুখ দেয় নাকি? সুখটাই জীবনে বড়। সুখের সঙ্গে টাকা পয়সার সম্পর্ক নেই।’
‘তোমার ভাবী খুব ভাল মেয়ে। তাকে নিয়ে আমি সুখে আছি। তা বলতে পারো।’
‘এ কি প্রেমের বিয়ে?’
‘নাহ। অ্যরেঞ্জড ম্যারেজ।’
‘বউ কি ডাক্তার?’
‘না, ডাক্তার না। বি এ পাশ করেছে।’
‘চাকরি বাকরি করছে নিশ্চয়ই।’
‘না। তোমার ভাবী হাউজওয়াইফ।’
হাবিবুল্লাহ তার পকেটের মানিব্যাগ থেকে বউ বাচ্চার ছবি বের করে। দেখায়।