চেকটি নিয়ে যখন ওরা চলে যায়, হঠাৎ একটি জিনিস আমার মনে উঁকি দেয়, আমি কি ওদের আগুনে কিছুটা জল ঢেলে দিলাম। যে ক্রোধটি ওদের ছিল, তা কি খানিকটা নষ্ট করে দিলাম! এই সুবিধেটুকু দিয়ে ওদের কি আমি শান্ত করে দিলাম। ওরা কি গার্মেণ্টেসএর মালিকদের শোষণের কথা আর কোনও শ্রমিকদের বলবে না, ওদের একত্রিত করবে না! শ্রমিকের অধিকার আদায় করার জন্য ওরা কি আর আন্দোলন করবে না! ওরা কি এখন কেবল সেলাই মেশিন নিয়ে বসে বসে সেলাই করবে আর একটু একটু করে দুজনের, কেবল দুজনের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনার কথাই ভাববে! সম্মিলিত মানুষের সংগ্রাম থেকে আমি কি জাহেদা আর সাজুকে সরিয়ে দিলাম! একটি শীত শীত ভয় আমাকে কাঁপাতে থাকে।
বছর চলে যাচ্ছে। এ সময় ব্যস্ততার শেষ নেই। দিন রাত আমি লেখায় ব্যস্ত। প্রুফ দেখায় ব্যস্ত। সামনে ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি মানেই হচ্ছে বইমেলা। মেলায় বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকেরা উন্মাদ হয়ে ওঠেন। পত্রিকার কলামগুলো নিয়ে কাকলি প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে ছোট ছোট দুঃখ কথা। কাকলির সেলিম আহমদ আমার অনুরোধ রেখেছিলেন ফ্যান দাও বইটি বের করে। ফ্যান দাও পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় লেখা কবিতার সংকলন। সেই সময়ের পত্র পত্রিকা ঘেঁটে যে সব কবিতা পেয়েছি, সেই ভুলে যাওয়া কবিতা গুলো নিয়ে বই সম্পাদনা করেছি। এটি করার জন্য আমাকে প্রেরণা দিয়েছিলেন নিখিল সরকার। তিনজনের ওপর তিনটি বইয়ের কাজটি ভাগ করে দিয়েছেন তিনি। সে সময় গল্পলেখকরা মন্বন্তরের ওপর যেসব গল্প লিখেছিলেন, সেগুলো সংকলিত করার দায়িত্ব বেলাল চৌধুরীর ওপর, আমার ওপর কবিতার, আর নিখিল সরকার নিজে নিয়েছেন মন্বন্তরের ছবি নিয়ে বই করার দায়িত্ব। মন্বন্তরের সময় শিল্পীদের আঁকা আঁকা ছবিগুলো যোগাড় করেছেন, ছবি নিয়ে লেখা তাঁর বড় একটি প্রবন্ধ যাচ্ছে বইটিতে। বইটির নাম দায়। বইগুলো পুনশ্চ নামের ছোট একটি প্রকাশনী থেকে বেরোয়। ফ্যান দাও বইটি খুব একটা চলবে না জেনেও সেলিম আহমদ বইটি প্রকাশ করেন আমার অনুরোধে, অনুরোধে ঢেঁকি গিললে পরে আনুকূল্য লাভের সম্ভাবনা আছে বলে। কাকলি প্রকাশনী তাই নতুন একটি নতুন বই পেয়েছে আমার। পার্ল পাবলিকেশনের ভাগ্যে শিকে তেমন ছেড়েনি, তাঁকে দিয়েছি লজ্জা এবং অন্যান্য নামের একটি বই, এটি আমার লেখা বই নয়, তবে লজ্জা নিয়ে অন্য লেখকরা যা লিখেছেন, সেসবের সংকলন। পার্ল পাবলিকেশনের মিনু খুব মন খারাপ করেছেন, বলেছেন, ‘অরিজিনাল কিছু দেন।’
‘অরিজিনাল কোত্থেকে দিই এখন!’
ব্যস্ত ছিলাম কোরানের নারী লিখতে, বেদ বাইবেল কোরান ঘাঁটায়। আমার মেয়েবেলা নামে একটি উপন্যাস এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। অসম্পূর্ণ জিনিস তো কাউকে দেওয়া যায় না। মিনুকে শেষ পর্যন্ত পুরোনো চারটে উপন্যাস জড়ো করে ছাপতে বলি, চারকন্যা নাম বইয়ের। মিনুর মুখে একটু হাসি ফোটে, কিন্তু তারপরও আমাকে মনে করিয়ে দেন, নতুন বই কিন্তু আমি পাই নাই। খোকা যেসব বই ছেপেছিলেন, সেগুলো প্রকাশ করার দায়িত্ব এক এক করে বিভিন্ন প্রকাশককে দিয়ে দিই। দুঃখবতী মেয়ে নামে ছোট গল্পের একটি বই মাওলা ব্রাদার্সকে দিই। বহুদিন থেকে ঘুরছেন মাওলার প্রকাশক। কাউকে মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছে হয় না। সবাইকে মনে হয় কিছু না কিছু দিই। কিন্তু সাধ্য কোথায়! জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর প্রকাশক লোকটি অত্যন্ত অমায়িক, তাঁকে আমার নির্বাচিত কলামটি প্রকাশ করার অনুমতি দিয়েছি। এটি পেয়ে তিনি মহাখুশি, যদিও বইটি পুরোনো। সবাইকে আমার কথা দিতে হয় নতুন বই লেখা হলেই তাদের দেব। অংকুর প্রকাশনীর মেজবাহউদ্দিন আহমেদের করুণ মুখটি দেখে মায়া হয়। তিনি বলেন, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে মিলনকে উপন্যাস লেখার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছেন, আজও মিলন কোনও বই দেয়নি। তিনি সমীক্ষণ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাপতেন, সমীক্ষণে আমি নিয়মিত লিখতাম। সে কারণে মেজবাহউদ্দিনের সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি প্রকাশনা ব্যবসায় নামার পর থেকে বই চাইছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পরামর্শ দিই পত্রিকায় পক্ষে বিপক্ষে যেসব লেখা বেরিয়েছে, ওগুলো প্রকাশ করে যেন তিনি আপাতত সন্তুষ্ট থাকেন। কোনও নতুন বই নেই? আছে একটি বই। কোরানের নারী। সব প্রকাশকই নাম শুনে আঁতকে উঠেছেন। কেউ এই বইটি প্রকাশ করার সাহস পাননি।
প্রকাশকদের এমন ভিড়ে আমার বারবারই পুরোনো সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। যখন কেবল একজন লেখক এবং একজন প্রকাশকের মধ্যে কথা হত। পরিকল্পনা হত। দুজনের শ্রম এবং স্বপ্ন থেকে একটি বইয়ের জন্ম হত। খোকার সঙ্গে সেই আমার দিনগুলো। কী ভীষণ আবেগ ছিল তখন, কী প্রচণ্ড উত্তেজনা ছিল! সেই দিনগুলো এখনকার এই ভিড়ভাট্টার দিনের চেয়ে অনেক সুন্দর ছিল। খোকার কথা আমার খুব মনে পড়ে। আমার দুঃসময়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। সুসময় এল, সব আছে, তিনিই কেবল নেই। খোকার সঙ্গে কোনওদিন আমার সম্পর্ক নষ্ট হবে আগে ভাবিনি। কিন্তু হয়েছে। এর পেছনে কারণটি খোকাই। একদিন তিনি হঠাৎ আমার হাত ধরে জ্ঞআপনি কি কিছুই বোঝেন না, আমার ভালবাসা আপনি কেন বোঝেন নাঞ্চ বলে কেঁদে উঠেছিলেন, আমি হতচকিত বিস্ময়ে বোবা হয়ে ছিলাম, এও আমাকে দেখতে হল! জীবনে অনেক অপমানকর, অনেক লজ্জাকর, অনেক ঘৃণ্য দৃশ্য আমি কল্পনা করেছি, কিন্তু এই দৃশ্যটি আমার চরম দুঃস্বপ্নের মধ্যেও আসেনি কোনওদিন! আর সইছিল না আমার। মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে এক্ষুনি বুঝি আমি পড়ে যাবো, মুচ্ছগ! যাবো। দ্রুত নিজের হাত টেনে নিয়ে খোকার সামনে থেকে সরে গিয়ে তাঁকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছি। খোকা যে কখনও আমার প্রেমে পড়ে আমাদের চমৎকার বন্ধুত্বটির এমন সর্বনাশ করে দেবেন কোনওদিন, কে জানতো! খোকাকে বের করে দিয়ে আকুল হয়ে কেঁদেছি। স্বপ্ন ভেঙে গেলে মানুষ যেমন শূন্য বোধ করে, কাঁদে, আর্তনাদ করে, তেমন করে। এরপর থেকে খোকা আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি। এই ঘটনার বেশ কয়েকমাস আগে খোকার বউ আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন যে খোকার সঙ্গে বোধহয় আমার গভীর প্রেম চলছে, তখন খোকা নিজেই আমাকে বলেছিলেন তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর বউকে যেন আমি আমাদের সম্পর্কের ব্যপারে জানিয়ে আসি, যেন তাঁর ভুল ভাঙে। তাই করেছিলাম। করার পর খোকার বউ আমার বাড়িতে খোকার সঙ্গে অথবা একাই মাঝে মাঝে চলে আসতেন। গল্প হত। খাওয়া দাওয়া হত। পত্রিকায় সাংবাদিকরা আমার সঙ্গে খোকার বিয়ে দিয়েছে কতবার, বাংলাবাজারের প্রকাশকরা কত অপদস্থ করেছে খোকাকে। কিন্তু কিছুই আমাদের সম্পর্ককে এতটুকু ম্লান করেনি। কিন্তু খোকা নিজেই কী না শেষ পর্যন্ত সব তছনছ করে দিলেন!