পাঁচজনের কথা শুনতে শুনতে আমি লক্ষ করি, বাক্যগুলো চমৎকার তাদের। কিন্তু এও লক্ষ্য করি, বাক্যগুলো তাদের মন থেকে বেরোচ্ছে না, বেরোচ্ছে মাথা থেকে। চমৎকার চমৎকার বাক্যগুলো সবে যেন ওরা মুখস্ত করে এল। পাঁচজনের কেউ কারও সঙ্গে কোনও কিছুতে দ্বিমত পোষণ করছে না। একজন কথা বললে চারজন মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে। পাঁচজনকেই আমার সাদাসিধে রোবটের মত মনে হয়।
ওরা আমাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে টন টন উপদেশ দান করে বিদেয় হয়।
আমি বসে থাকি সোফায়, বসেই থাকি। টেলিভিশন ছেড়ে ইয়াসমিন জিটিভির হিন্দি গান শুনছে। টেলিভিশনের দিকে আমার চোখ। কিন্তু আমার মন অন্য কোথাও। যখন সাজু , লাভলি আর জাহেদা এসে আমাকে ডাকে, জিজ্ঞেস করে কেমন আছি, তখনও মন সেই অন্য কোথাও থেকে ফেরেনি। তবে ফেরে যখন জাহেদা আর সাজুর চাকরি গেছে, শুনি। চাকরি যাওয়ার কারণ গার্মেণ্টেসএর মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন। দীর্ঘদিন থেকে ওরা এই আন্দোলন করার কথা ভাবছিল। ওরা শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কী তাদের পাওনা, কী তারা পাচ্ছে না, কী করে মালিক তাদের ঠকাচ্ছে, এসব বলে বলে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কয়েক হাজার শ্রমিককে সচেতন তরে প্রতিবাদী করে রাস্তায় নামিয়েছিল। কিন্তু মালিকের ভাড়াটে গুণ্ডারা মিছিলের শ্রমিকদের পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছে, পুলিশ কোনও গুণ্ডার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেনি। পনেরো ঘন্টা কাজ করা, সপ্তাহের ছুটি, পরবের উৎসবের ছুটি,ঐচ্ছিক ছুটি কিছুই না পাওয়া, তিন হাজার শ্রমিকের জন্য দুটো মাত্র টয়লেট থাকা, তার ওপর দুবারের বেশি টয়লেট ব্যবহার করার নিয়ম না থাকা, কারও বাচ্চা পেটে এল তো চাকরি যাওয়া, কেউ একদিন অসুখে পড়ে কারখানায় আসতে না পারলে একদিনের মাইনে কাটা, অতিরিক্ত কাজের জন্য কোনও বাড়তি টাকা না দেওয়া — এসব আগেই আমাকে জানিয়েছিল ওরা। আমি লিখেওছি কারখানার শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে। কিন্তু লিখলেই কি সমস্যা যায়! ওরা যে আন্দোলনটি করছিল কারখানা বন্ধ করে দিয়ে, সেটিরই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের মেরে মাথা ফাটিয়ে, পা ভেঙে, হাত ভেঙে দিয়ে নেতাদের চাকরি খেয়ে মালিক বেশ আছে। মালিকের এই অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। আদালত কোনও মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। আমি বলি, ‘একটা জিনিস ভাল যে কারখানা বন্ধ থাকবে।’
জাহেদা বলে, ‘কালই কারখানা খুলবে আপা।’
জ্ঞকোনও শ্রমিক যদি কাজ না করে তবে কি করে খুলবে?’
‘অনেক শ্রমিকই মালিকের সঙ্গে আপোস করবে। মালিকের অধীনতা মেনে নেবে।’ জ্ঞকিন্তু সবাই তো মানবে না!’
জ্ঞযারা মানবে না, তাদের তো ছাটাই করেই দিয়েছে। কিন্তু মালিকের অসুবিধে হবে না। দেশে গরিবের সংখ্যা প্রচুর। চাইলেই শ্রমিক পাবে। যে কোনও কনডিশনে কাজ করার জন্য অনেকেই প্রস্তুত।’
জাহেদাকে আমি আমার চোখের সামনে দেখেছি ধীরে ধীরে সচেতন হতে, হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতে, দাঁতে দাঁত পিষতে। রাতে রাতে শ্রমিকদের সঙ্গে গোপন বৈঠক সেরে জাহেদার দলটি আমার বাড়িতে চলে আসত, ক্ষিধে পেট, তাড়াতাড়ি খাবার আয়োজন করতাম ওদের জন্য। খেতে খেতে বলত কতদূর এগোচ্ছে কাজ, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে দল ভারী হতে। আজ অনেকদিন হল চাকরি নেই জাহেদা আর সাজুর। লাভলীর চাকরিটি এখনও আছে, তবে এটিও যাবে যে কোনও একদিন। সাজু আর জাহেদা অন্য কারখানায় চাকরির জন্য গিয়েও পায়নি চাকরি। অভিজ্ঞতা আছে গার্মেন্টসএর কাজে, জানার পরও কোনও চাকরি জোটে না। অনেকক্ষণ শুনি তাদের কথা। অনেকক্ষণ বসে থাকি। একসময় উঠে গিয়ে আমি ব্যাংকের চেকবইএর শেষ পাতাটি ছিঁড়ে আনি। সাড়ে চার হাজার টাকা আছে ব্যাংকে, পুরোটাই লিখে দিই জাহেদার নামে।
জাহেদা অবাক, ‘টাকা কেন?’
‘সেলাই মেশিন কেনো। ঘরে বসে সেলাই করে আপাতত কিছু রোজগার কর।’
আমি গিয়েছি পল্লবির বস্তিতে জাহেদার ছোট্ট বেড়ার ঘরটিতে। ঘরটিতে কেবল একটি চৌকি আর একটি ছোট্ট টেবিলের জায়গা হয়। চৌকিতে পা তুলে আসন করে বসে গল্প শুনেছি জাহেদার সাজুর আর লাভলির জীবন সংগ্রামের। জাহেদা কি করে গ্রাম থেকে শহরে এসে বেঁচে থাকার লড়াই করেছে। মাত্র অষ্টম শ্রেণীর বিদ্যে নিয়ে গার্মেন্টসএর শ্রমিক হওয়া ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না তার। সাজু লেখাপড়া করতে পছন্দ করত, মেট্রিক পাশ করেছে, কিন্তু কলেজে পড়া সম্ভব হয়নি অভাবের কারণে, তাই চাকরি করা শুরু করেছে। লাভলিরও প্রায় একই অবস্থা। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারে সাহায্য করার জন্য তাকে চাকরি করতেই হচ্ছে। সাজু আর জাহেদা একসঙ্গে থাকে কয়েক বছর থেকে, দুজনের একটি বাচ্চাও আছে। বাচ্চাটিকে তারা গ্রামে জাহেদার মার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখানে তাদের দুজনই সারাদিন বাইরে, বাচ্চা রাখার কেউ নেই। সাজু খুব গর্ব করে বলে জ্ঞআমরা লিভ টুগেদার করি। বিয়ে জিনিসটা যুক্তিহীন।’
জ্ঞএখানে কোনও অসুবিধে হয় না বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকতে?’ আমি জিজ্ঞেস করি। সাজু বলে, ‘না। গরিব আর ধনীদের লিভ টুগেদারে কোনও অসুবিধা নাই। অসুবিধা হয় মধ্যবিত্তদের।’
তা ঠিক, ভাবি, সমস্ত অসুবিধে মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্তের লজ্জা বেশি, ভয় বেশি, যত সংস্কার আছে, সব মানার এবং মানার ভানও বেশি।
সাজুর লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে পত্রপত্রিকা যেখানেই যা পায়, পড়ে। পড়তে পড়তেই আমার লেখা ওর নজরে আসে। প্রতি সপ্তাহে তার পড়া চাইই আমি যা লিখি। লাভলী আর জাহেদাসহ অনেককে সে আমার লেখা পড়িয়েছে। এরপর সাজুই প্রথম জাহেদাকে নিয়ে আমার সঙ্গে একদিন দেখা করতে আসে, এরপর লাভলীকে নিয়ে জাহেদা আসে, এরপর ওদের সূত্র ধরে আরও গার্মেন্টসএ শ্রমিক আসে। ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার ভেতরে সাহসের জন্ম হয়। ওদের সঙ্গ আমাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সঙ্গের চেয়ে বেশি আনন্দ দেয়। ওদের সাহস এবং মনোবল আমাকে চমকিত করে। বাসের দরজায় ঝুলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে, বাসে চড়ার পয়সা না থাকলে মাইল মাইল পথ পায়ে হাঁটছে, দুপুরের কড়া রোদ মানছে না, রাতের অনিশ্চয়তা মানছে না, হেঁটে যাচ্ছে। ওরা পুঁজিবাদের সংজ্ঞা পড়েনি, সমাজতন্ত্রের কোনও তত্ত্ব কথা জানে না। কিন্তু নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ওরা জানে, কঠোর পরিশ্রম করতে জানে, এবং তার মূল্য কড়ায় গণ্ডায় আদায় করার জন্য যা কিছু করতে হয় তা করতে জানে। অভাব ওদের মাথাকে নত করেনি। কোনও ষড়যন্ত্র ওদের পিছপা করে না। কোনও আঘাত ওদের থামায় না। ওরা অনেক কিছুতে অজ্ঞ, কিন্তু কোনও কিছুতেই মূর্খ নয়। প্রচণ্ড উদ্যম ওদের। ভয় পেলে ওদের চলে না, কাতর হলে চলে না। ধর্মের ভেদ, নারী পুরুষের ভেদ মানা ওদের চলে না। কারও দেওয়া পথ বা মত মেনে চলে না, নিজেদের পথ ওরা তৈরি করে নেয়। প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করছে, অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জন্য সংগ্রাম। সংগ্রামী হিসেবে আমার নাম হয়েছে, কিন্তু আমি নিজে বুঝি, আমার মত দশটি তসলিমা যোগ করলেও এক জাহেদার মত সংগ্রামী হতে পারবে না। আমার সাহসকে দশ দিয়ে গুণ করলেও এক জাহেদার সাহসের সমান হবে না। নিজেকে নিয়ে যত গর্ব করি আমি, তার চেয়ে বেশি করি জাহেদাদের নিয়ে।