সাহাবুদ্দিনের জন্য দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও পরিশ্রমের কাজ নয়। এটি করে তিনি আমাকে সন্তুষ্ট রাখতে চান, আমি যেন তাঁকে খুব সহজে বলে না দিতে পারি, আপনার চাকরি আজকের মত এখানেই শেষ। চাকরিটি সাহাবুদ্দিনের দরকার। সাহাবুদ্দিন গাড়ির তেল চুরি করছে না, আমাকে ঠকিয়ে পয়সা কামাতে চাইছে না, কারণ তাঁর মধ্যে কোথাও কোনও সৎ একটি মানুষ লুকিয়ে আছে, ছোটবেলায় কখনও হয়ত শিখেছিলেন, অন্যায় করিও না, মানুষের মনে কষ্ট দিও না, অসৎ পথে চলিও না এসব নীতিবাক্য। বুড়ো হয়ে গেছেন, আজও শৈশবের উপদেশবাণী মেনে জীবন কাটাচ্ছেন যখন বেশির ভাগ মানুষই ওসব হয় ভুলে গেছে, অথবা ভুলে না গেলেও মেনে চলা জরুরি মনে করে না, অথবা মেনে চলতে চাইলেও নিজের চাহিদা আর চারপাশের দূর্নীতি তাদের ওসব মেনে চলতে দেয় না। ওসব এখন পুরোনো কথা, বাজে কথা।
লেখার ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি। মাথার ভেতর পোকার মত নানান ভাবনা কিলবিল করছে। কত লেখা অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে, শেষ করতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় কী হবে লিখে! কী দরকার লিখে! একটি বিচ্ছিরি হতাশা আমাকে গ্রাস করে রাখে। আমার এসব লেখায় সমাজের কোনও পরিবর্তন হবে না, তবে আর লেখা কেন! দেশের আশি ভাগ মানুষ লিখতে পড়তে জানে না। আমার লেখা শিক্ষিতরাই কেবল পড়ার সুযোগ পায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সমস্যা নিয়েই লিখি বেশি। কারণ আমি এদেরই দলের লোক। আমি খুব দরিদ্রের ঘরে পৌঁছতে পারি না, শারীরিক ভাবে না, মানসিক ভাবেও না। আমি কেবল কল্পনা করতে পারি তাদের জীবন, আমি তাদের সত্যিকার একজন হতে পারি না। আমি নূরজাহানের কথা লিখি, লিখি কারণ খবরের কাগজে নূরজাহানের যন্ত্রণা পড়ে সেই যন্ত্রণা আমি অনুভব করেছি। আমি কিন্তু নূরজাহানের জীবন যাপন করে সেই যন্ত্রণা অনুভব করিনি। দুই অনুভবের মধ্যে একটি বড় ফারাক আছে। আমি কি আসলে আমার নিজের জন্য নূরজাাহানকে ব্যবহার করছি! নাকি আমি সত্যি সত্যিই নূরজাহানের কষ্ট বুঝতে চাইছি। নূরজাহানের কথা আমি লিখি কেন! কজন নূরজাহান আমার লেখা পড়তে পারে,পড়ে মনে শক্তি পেতে পারে! একজনও না। আমি কি তবে আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের জন্য লিখি, যেন পড়ে আমাকে বাহবা দেয়, নাকি আমি তাদের ভেতরে আমার যে অনুভব সেই অনুভবটিকে ছড়িয়ে দিতে চাই, যেন তারা শোয়া থেকে বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়ায়, যেন কিছু ভাল কিছু একটা করার জন্য উদ্যোগী হয়! আমি ঠিক বুঝে পাই না, কী প্রয়োজন এই দেশটির জন্য। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলেই সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে, ধর্মের রাজত্ব যাবে, শিক্ষা চিকিৎসা সব ব্যবস্থার উন্নতি হবে! নাকি একটি সুস্থ রাজনৈতিক অবস্থা এলেই সমাজ সুস্থ হবে! নাকি ধর্মীয় আইনের অবসান হলেই সব সমস্যা দূর হবে! কোনটি? এর কোনটি নারী পুরুষের বৈষম্য, সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর বৈষম্য, ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে পারে! কেবল একটি পরিবর্তনই কি যথেষ্ট, যেহেতু একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক ওতপ্রোত! নাকি আলাদা আলাদা করে একই সঙ্গে সব কিছুর জন্য লড়াই করতে হবে! ধুত্তুরি বলে আমি উঠে পড়ি চেয়ার থেকে। চা খাওয়া দরকার। চায়ের জন্য মিনুকে ডাকি। মিনু দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায় আমার জন্য চা বানাতে। আজকে মিনু তো গার্মেন্টসএ কাজ করতে পারত। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু মিনুকে কেন দিচ্ছিন! গার্মেণ্টেসএ কাজ করতে! আমার আরামে আয়েসে অসুবিধে হবে বলে! নাকি মিনুর মঙ্গলের কথা ভাবছি আমি! গার্মেন্টসএর মেয়েরা যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, সেই নিরাপত্তাহীনতা এখানে মিনুর নেই, সেটি ভাবছি।
নাহ, চা না খেলে আমার মাথা থেকে এসব যাবে না, এই প্রশ্নগুলি।
আমি যখন চা খাচ্ছি, তখন আসে সেই পাঁচজন মেয়ে। আগেও একদিন এসেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে। সাদাসিধে শাড়ি পরা, সাদাসিধে চুলের বিনুনি, কিন্তু কথাগুলো এদের সাদাসিধে নয়। এদের কথা আগেরবারের মতই। আমি এই যে মেয়েদের স্বাধীনতার বিষয়ে লিখছি, এভাবে লিখে কোনও লাভই হবে না, যদি পুঁজিবাদী সমাজ টিকে থাকে। সুতরাং আমাকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে হবে, আমাকে পার্টিতে সক্রিয় হতে হবে, এই পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে, তবেই আমার স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
নাহ, আমি কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে চাচ্ছি না।
কেন?
যেহেতু রাজনীতি আমি বুঝি কম।
মেয়েরা আমার সঙ্গে অনেকটা একমত হয় যে আমি রাজনীতি বুঝি কম।
চা আসে। পাঁচজনের সামনে চা ঠাণ্ডা হতে থাকে। পাঁচজনই চা পানের চেয়ে বেশি আগ্রহী কথা বলতে।
আমি কেন আলাদা করে ধর্মহীনতার কথা বা নারী স্বাধীনতার কথা লিখছি! আমি কেন কেবলই কমিউনিজমের কথা লিখছি না, কারণ কমিউনিজম এলেই আপনা আপনি নারী স্বাধীনতা আসবে, ধর্ম দূর হবে। আমি যে সমস্যাগুলো তুলে ধরছি, সেগুলো সুপারফিসিয়াল সমস্যা। আমি লিখছি ঠিকই সমস্যা নিয়ে, কিন্তু কোনও সমস্যারই গোড়া পর্যন্ত যাচ্ছি না, সমস্যার মূলটিকে চিহ্নিত করছি না। মেয়েরা আরও আরও সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলে, সব কিছুর কারণই হল পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা।
খুক খুক করে হঠাৎ কেশে উঠি। কাশি পায় বলেই কাশি। কাশির সঙ্গে হঠাৎ হাসিও পায় কারণ পাঁচজনের একজন যখন জিজ্ঞেস করে, কাশি হয়েছে কেন?, আমি প্রায় বলতে নিচ্ছিল!ম, পুঁিজবাদী সমাজ ব্যবস্থাটিই আমার এই কাশির কারণ।