ভুক্তভোগীরা যখন আন্দোলনে নামে, জীবন দিয়ে নামে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের আন্দোলন মাটি করে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। দেশের কোনও কারখানায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন মেনে চলা হয় না। শ্রমিকদের খাটানো হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি, মাইনে দেওয়া হচ্ছে কম, তার ওপর সুযোগ সুবিধে যা তাদের প্রাপ্য তার কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। এসবের বিরুদ্ধে কোনও কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করতে চাইছে, সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক নেতাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে মালিকের পক্ষ থেকে দিয়ে দেওয়া হল মোটা অংকের টাকা। ব্যস, নেতা থামিয়ে দিল আন্দোলন। এভাবেই চলছে দেশ। সেই কত কাল আগে লাঙল ব্যবহার শুরু। কৃষি ব্যবস্থার কত উন্নতি হয়ে গেল কত দেশে, আর কৃষি-প্রধান দেশটিতে এখনও লাঙলই সম্বল জমি চাষ করার জন্য। যে কৃষকরা ফসল ফলাচ্ছে, সেই কৃষকদের হাতে ফসলের সঠিক মূল্য পৌঁছোচ্ছে না। কৃষক এবং ক্রেতার মাঝখানের ব্যবসায়ীরাই মূল্যের অধিকটা পকেটে পুরছে। এমন একটি ব্যবস্থা কি কখনও করা সম্ভব নয় যে ব্যবস্থায় ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে এই বিশাল পার্থক্যটি ঘুচবে! যখন ধনী অত বেশি ধন তৈরি করার সুযোগ পাবে না, আর দরিদ্রকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে না! কজন মানুষ সৎ পথে ধনী হতে পারে এ দেশে! খুব কম। যারা খুব ধনী, বেশির ভাগই অসৎ পথে ধনী হয়েছে, অন্যকে ঠকিয়ে ধন বানিয়েছে নিজের জন্য। উপার্জনের কর ফাঁকি দিয়ে চলছে অধিকাংশ ধনী। ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য ঘোচানোর ব্যবস্থাটি তৈরি করে মানুষের মধ্যে সমতা আনতে যে সততা আর নিষ্ঠা প্রয়োজন তা কজন মানুষের মধ্যে আছে! মানুষ নিজের কথাই ভাববে নাকি অন্যের! মানুষ যদিও সৎও হয়, সরকারের অসততার কারণে মানুষ অসৎ হতে বাধ্য হয়। ওপরতলায় দূর্নীতি বাড়লে নিচ তলাতেও দূর্নীতি বাড়ে। দেশটি দরিদ্র দেশ। দেশটির মাটির তলে এমন কিছু সম্পদ নেই যা দিয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে যেতে পারে। জনসংখ্যা উন্মাদের মত বাড়ছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বছর বছর মানুষ মরছে, বাস ট্রাক গাড়ি রেলগাড়ি যখন তখন উল্টো হয়ে পড়ছে, জাহাজ ডুবছে, লঞ্চ ডুবছে —একসঙ্গে তিনশ চারশ মানুষ এক মিনিটেই মরে যাচ্ছে। এত মরেও জনসংখ্যা রোধ হচ্ছে না। বাড়ছেই। অসুখে অপুষ্টিতে শিশু মরছে, শিশুর মৃত্যু হার বাড়লে শিশুর জন্মের হারও বাড়ে। অনিশ্চয়তা থেকে বাড়ে। চারদিকে অশিক্ষা বাড়ছে। কুশিক্ষা বাড়ছে। অভাব বাড়ছে। অন্ধত্ব বাড়ছে। সংশয় বাড়ছে, হতাশা বাড়ছে। হতাশা বাড়লে ধর্ম বাড়ে। দিনে কয়েকটি করে খোদ ঢাকা শহরেই ইসলামি জলসার আসর বসে। ধর্ম এখন বেশ বড় একটি ব্যবসা। ধর্মের ব্যবসা যাদের আছে, তারা ভাল কামাচ্ছে। লোক ঠকানোর ব্যবসা যারাই করে, ভাল কামায়। যত বেশি লোক ঠকাতে পারবে, তত বেশি কামাই। দেশে একজনও সৎ নেতা বা নেত্রী নেই, যার ওপর ভরসা করা যায়। কোনও নেতাই দেশ এবং দেশের মানুষের মঙ্গলের কথা ভাবে না। সবাই আছে নিজের স্বার্থ নিয়ে। ডঃ কামাল হোসেন গণফোরাম নামে একটি রাজনৈতিক দল শুরু করেছেন। তিনি একসময় শেখ মুজিবর রহমানের খুব প্রিয় লোক ছিলেন। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানটি তাঁরই লেখা। মুজিব আমলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর মতের মিল না হওয়ায় তিনি আওয়ামি লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন। গণফোরামের সদস্য সংখ্যা খুবই কম, বেশির ভাগ সদস্যই উচ্চজ্ঞশক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, আইনজ্ঞ। এই দলে বেশ কজন অভিজ্ঞ বাম রাজনীতির নেতা আছেন। কোনওদিন যদি ক্ষমতায় যেতে পারে গণফোরাম, তবে আমার বিশ্বাস দেশটির চেহারা পাল্টাবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ডঃ কামাল হোসেন এই গণফোরামকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করতে পারছেন না। সম্ভবও নয়। জনপ্রিয় রাজনীতি করতে হলে কর্মী পুষতে হয়, সন্ত্রাসী পুষতে হয়, জনগনকে ধোঁকা দিতে হয়। সেটা আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে যারা যুক্ত, তাঁরা পারেন না।গত নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে হেরে গেছেন অশিক্ষিত ট্রাক ব্যবসায়ী হারুন মোল্লার কাছে। কামাল হোসেন একজন বিখ্যাত আইনজ্ঞ, জাতিসংঘের উপদেষ্টা, শিক্ষিত, সৎ, সেকুলার, অথচ তাঁকে হেরে যেতে হয় রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ একটি লোকের কাছে। কি নাম এই দেশের গণতন্ত্রের যে গণতন্ত্রের ভোট টাকা দিয়ে কেনা হয়? এ আর যাই হোক সত্যিকার গণতন্ত্র নয়। দেশের আশিভাগ দরিদ্রর কাছ থেকে ভোট পাওয়ার জন্য তাকে মিথ্যে আশ্বাস দাও, কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দাও, ভোট পাবে, যত বদমাশই তুমি হও না কেন। যার যত টাকা বেশি, তার তত ভোট বেশি। যে যত বেশি মিথ্যে বলতে পারে, তত ভোট পাবে বেশি। আমি উদাস বসেছিলাম জানালায় মাথা রেখে। এলোমেলো ভাবনার মধ্যে ডুবে। সাহাবুদ্দিনের ডাকে আমি চমকে উঠি। বাড়ি এসে গেছে। সাহাবুদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন দরজা খুলে।
বেরিয়ে আসতে আসতে বলি, ‘আপনাকে না কতদিন বলেছি দরজা খুলে দেবেন না গাড়িতে ওঠার সময়, বেরোবার সময়!’
সাহাবুদ্দিন মাথা নত করেন।
ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবি, সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে এই যে আমি এই ভদ্রতা করছি, তা কেন করছি, আমার নিজের জন্য নাকি সাহাবুদ্দিনের জন্য! নিজের জন্য নিশ্চয়ই, নিজে আমি খানিকটা উদার হয়েছি ভেবে আমার ভাল লাগে, সেই ভাল লাগাটি আমি আমাকে দিতে চাই।