সাহাবুদ্দিন চুপ। তিনি জানেন না যে আমি জানি কিসের মিছিল হচ্ছে।
‘কারা মিছিল করছে?’
‘ওরা ভাল লোক না।’
সাহাবুদ্দিনের সংক্ষিপ্ত উত্তর। ওদিকে ভাল লোকের মিছিল হচ্ছে না, ওদিকে আমার যাবার দরকার নেই।
‘গাড়িতে তেল লাগবে?’
‘না।’
গাড়ির তেল ধীরে খরচ হয়। যেটুকু চলে গাড়ি, সেটুকুই খরচ।
‘সাহাবুদ্দিন, আপনার টাকার দরকার আছে? টাকা লাগবে কিছু?’
‘না।’
‘আপনার ছেলে বলেছিলেন মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে। যদি কখনও দরকার হয় কিছু বলবেন।’
‘আমার লাগবে না।’
সাহাবুদ্দিন বড় অপ্রতিভ বোধ করেন টাকা পয়সার প্রসঙ্গ উঠলে। নম্রতা আর নির্লোভতার একটা সীমা আছে, সাহাবুদ্দিন সীমা ছাড়িয়ে যান। মাঝে মাঝে মনে হয় সাহাবুদ্দিন এই গ্রহের কেউ নয়, অন্য গ্রহ থেকে অন্যরকম একজন মানুষ এই নোংরা পৃথিবীতে এসে পড়েছেন। ভাবি, আজ যদি দেশের মানুষগুলো সাহাবুদ্দিনের মত সৎ হত, তাহলে হয়ত দেশটির চেহারা বদলে যেতে পারত। হাতে গোনা কিছু ধনী লোক কোটি কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বসে আছে, কোনওদিনই তা আর ফেরত দিচ্ছে না। সরকারের সঙ্গে বেশ খাতির তাদের, সরকার ঋণখেলাপিদের গোপনে ক্ষমা করে দেয়। যে সরকারই আসে, সে সরকারের সঙ্গেই এদের খাতিরের ব্যবস্থা আছে। সততা কোথায় আছে আর? শিক্ষকদের সৎ বলে জানতাম। শিক্ষকদের মধ্যেও অসততার বীজ রোপন করা হয়ে গেছে। তাঁরাও আজকাল মোটা টিউশন ফি নিয়ে ছাত্র পড়িয়ে পরীক্ষা পাশের নিশ্চয়তা দেন। পুলিশ ঘুষ খাচ্ছে। কৌশলী খাচ্ছে, প্রকৌশলী খাচ্ছে। রাস্তাঘাট আজ নির্মাণ হল, তো কাল ভেঙে যাচ্ছে। ভেজাল সবখানে। ডাক্তাররা হাসপাতালের রোগীকে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে টাকা আদায় করে অপারেশন করছে, অপারেশনের প্রয়োজন না থাকলেও পেট কাটছে টাকার জন্য। মন্ত্রী ঘুষ খাচ্ছে, আমলারা খাচ্ছে। যাদের খাবার আছে, তারাই আরও বেশি করে খেতে চাইছে। আর যাদের নেই, যারা খেতে পাচ্ছে না, তারা মুখ বুজে অন্যের খাওয়া দেখছে। সততা যদি টিকে থাকে কোথাও, দরিদ্রদের মধ্যেই আছে। কিন্তু মুখ বুজে আছে কেন সবাই! কেন নিজের অধিকারটুকুর দাবি তারা করে না। রিক্সাঅলারা রোদে জলে ভিজে অমানুষিক পরিশ্রম করে সামান্য কটি টাকা রোজগার করে, আরোহীদের মার খায় ধমক খায় কিন্তু প্রতিবাদ করে না। পাঁচতারা হোটেলের কিনারে, বারিধারার বড় বড় প্রাসাদের পাশে নোংরা বস্তিতে জীবন যাপন করছে মানুষ অথচ প্রতিবাদ করছে না। ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকেরা দেখছে বড় বড় রেস্তোরাঁয় লোকেরা পেট পুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে, দেখেও কেড়ে খেতে চাইছে না কোনও খাবার। একবার কাউরান বাজারে গিয়েছিলাম রাতে, ওখানে অনেক রাতে ট্রাক ভরে শাক সবজি আসে, ট্রাক থেকে শ্রমিকেরা নামায় সেসব, কিছু সবজি কিনে ফিরে আসার সময় দেখেছিলাম, শহরের শ্রমিকেরা ফুটপাতে ঘুমোচ্ছে, কারও কোনও ঘর নেই, ঘুমোবার জায়গা নেই, গরমে কোনও হাওয়া নেই, মশা কামড়াচ্ছে, কোনও মশারি নেই, সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত, রাস্তার কিনারে কোথাও একটু ঘুমোবার জায়গা পেলেই খুশি ওরা, ওরাও প্রতিবাদ করতে জানে না। ধনী আর দরিদ্রের প্রকট বৈষম্য দেখে আমার বড় রাগ হয়। নিজের কথা ভাবি, রাগ করার কী অধিকার আছে আমার! আমিই বা ধনীদের চেয়ে আলাদা কোথায়, আমাকে ধনী বলেই বিচার করবে যে কোনও উদ্বাস্তু উন্মুল মানুষ। আমি একটি দামি আ্যপার্টমেন্ট কিনেছি, আমার একটি গাড়ি আছে। আমি ধনীই বটে। নিজেকে আমি সান্ত্বনা নিই এই বলে যে আমি কোনও অসততা করে টাকা উপার্জন করিনি, আমি কোনও অবৈধ ব্যবসা করি না, লোক ঠকাই না, একটিও কালো টাকা আমার নেই। তারপরও একটি গ্লানি আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। আমি কি এখন সব ছেড়ে ছুড়ে ফুটপাতে রাত কাটাবো, বস্তিতে ঘর তুলব? আমি কি সব টাকা পয়সা বিলিয়ে দিয়ে না খেয়ে বা আধ পেট দিন কাটবো? এতে কি ধনী দরিদ্রের বৈষম্য শেষ হবে? হবে না। আমি কি লিখে এই বৈষম্য দূর করতে পারব? আমি জানি, পারব না। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে দূর্নীতি। কোনও রাজনৈতিক নেতাই দরিদ্র মানুষের অবস্থা পরিবর্তনের কথা ভাবে না। চেষ্টা করে না। গণতন্ত্র ব্যবহার করে যে দলই ক্ষমতায় আসে, ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। দেশ এবং দেশের মানুষের মঙ্গল, ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার নীতি কারওরই নেই। একবার বারিধারার বস্তির এক হতদরিদ্র লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, চোখের সামনে এত যে ধনী দেখছেন, এত যে ওদের ধন দেখছেন, কি রকম লাগে আপনাদের? আপনারাও মানুষ, ওরাও মানুষ, কিন্তু ওরা সুখে থাকবে, আপনারা কষ্টে থাকবেন, এই নিয়মটি কেন মেনে নিচ্ছেন? কেন ধনীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন না? লোকটি বলেছিল, ‘আল্লায় তাদেরে দিছেন, আমাদেরে দেয় নাই। ইহলোকে যদি কষ্ট করি, পরলোকে আল্লাহ অনেক দিবেন। এই সময় ঈমান মজবুত রাখা জরুরি। আল্লাহ তো আমাদেরে দুর্দশা দিয়া আমাদের ঈমান পরীক্ষা করতেছেন। ঈমান যদি ঠিক রাখতে পারি, তাইলে আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।’ আমি নিশ্চিত, লোকটি নিজের বুদ্ধি থেকে এই কথা বলেনি। বলেছে সেই কথা যা তাকে শিখিয়েছে আমাদের নেতারা। আমাদের রাজনীতিকরা ধর্মকে ব্যবহার করেন গরিবদের দাবিয়ে রাখার জন্য। তা না হলে আজ বারো কোটি লোকের মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করা আশি ভাগ লোক যদি প্রতিবাদ করত, যদি পথে নামত, তবে ধনীর সাধ্য ছিল না আরাম আয়েশে জীবন যাপন করা। ধর্ম তাই ধনীদের আরামে রাখার একটি অস্ত্র। ধর্ম রাজনীতিকদেরও অস্ত্র। ধর্মের কথা বলে গরিবকে নিশ্চুপ রাখা যায়, ধর্মের কথা বলে ভোটে জেতা যায়। ধর্মের কথা বলে ধর্মীয় অনুভূতি উসকে দেওয়া যায়। ধর্মের কথা বলে উড়ির চড়ের ঘুর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুকে আড়াল করা যায়, হাজার হাজার ঘরহীন মানুষকে আকাশের তলে বাস করানো যায়। প্রতিবছর বন্যায় ঘরবাড়ি ভাঙা, জলে তলিয়ে যাওয়া সহায় সম্বলহীন মানুষকে বলা যায় আল্লাহ ঈমান পরীক্ষা করছেন। ঈমানের পরীক্ষা কেবল গরিবদেরই ওপরই কেবল? এই প্রশ্নটি করারও কারও সাহস নেই। এতে লাভ সকল বিত্তবান এবং মধ্যবিত্তর। মধ্যবিত্তের স্বপ্ন বিত্তবান হওয়া। বিত্তবানদের সব পন্থাই তারা অবলম্বন করে। অথচ কোনও সামাজিক দুরবস্থার বিরুদ্ধে যে আন্দোলনই গড়ে ওঠে, কিছু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সচেতন মানুষ দ্বারাই তা গড়ে ওঠে। তাই আন্দোলন কখনও খুব শক্ত হয়ে দানা বাঁধে না। থেমে থেমে যায়। এর পেছনে যে কারণটি আছে, তা নিশ্চয়ই, যেহেতু মধ্যবিত্তদের দলটি, সমাজ সচেতন হলেও, সমাজের মঙ্গলের জন্য আন্দোলন করলেও, সত্যিকার ভুক্তভোগী নয়।