‘না এই শাড়ি আমি ত আর পরি না।’
‘তারপরও কখনও যদি ইচ্ছা হয়, পরতে পারবা।’
‘না। না। এই শাড়ি এখন আমার আর পছন্দ না।’
মা অগত্যা নেন। সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘নাসরিনের পছন্দের একটা শাড়ি নাসরিন দিয়া দিল আমারে। শাড়িটা একদিনও ও পরে নাই।’
খরচ বাঁচানোর জন্য মাকে যদিও কোনওদিন আমি বলিনি, মা তবু আমার সংসারের খরচ বাঁচাতে চেষ্টা করেন। এক মুরগি একদিনের জন্য কেনা হল, তা দিয়ে দুদিন চালাতে চান। ভাগে কম পড়লে রাগ করি। তিনি নিজের ভাগেরটুকুও আমার পাতে তুলে দিয়ে কাজের মেয়েদের সঙ্গে বসে ডাল ভাত খেয়ে ওঠেন। আমার আর্থিক অবস্থা নিয়ে আমার চেয়ে মার দুর্ভাবনা বেশি। ভালবাসা হাঁটতে গেলে মার ভয়, পড়ে যাবে বুঝি। আমি বারান্দায় দাঁড়ালে মার ভয় কোনও ঘাতক বুঝি আমাকে দেখছে রাস্তা থেকে অথবা আশে পাশের কোনও বাড়ি থেকে। মার ভয় দেখতে বড় বিচ্ছিরি লাগে আমার। আগের মত এখন আর পুলিশ পাহারা নেই। দরজার পুলিশ হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেছে। মিছিল যখন শান্তিনগরের দিকে আসে, তখনই কেবল আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আমি সময় অসময়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ি, মা পেছন থেকে বলেন, ‘বাইরে যাইস না। কখন কি হয়, কে জানে।’
আমি পেছন ফিরি না। মা বলতে থাকেন, ‘যাইতে হইলে কাউরে নিয়া যা। একলা যাইস না।’
আমি তবুও পেছন ফিরি না।
বুকের মধ্যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভয় পুষে রাখতে রাখতে আমার এখন অসহ্য লাগে। কিন্তু এই যে বেরিয়ে যাই, যাই কোথায়? যাই শহর ছাড়িয়ে কোথাও। অতি বিনয়ী, অতি স্বল্পভাষী, অতি সৎ সাহাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করেন, ‘আপা কোনদিকে যাবো?’ ‘যান, যেইদিকে খুশি যান।’
আমার কোনও ঠিকানা নেই যাওয়ার। সাহাবুদ্দিন যেতে থাকেন দক্ষিণের দিকে। দক্ষিণের দিকে কোনও গন্তব্য নেই। শহর ছাড়িয়ে নির্জনতার দিকে, গ্রামের দিকে, বনের দিকে, নদীর দিকে। আমার ভাল লাগে এই গতি, এই ছুটে যাওয়া। জানালায় হাওয়া এসে চুল এলো করে দেয়, ভাল লাগে। ইচ্ছে করে বনের পথে একা একা হেঁটে যাই, কোনও কলাপাতার বেড়ার আড়ালে গ্রামের কোনও মাটির ঘরে যাই, পুকুরে স্নান করি, নদীতে সাঁতার কাটি, বিলে নেমে মাছ ধরি, গ্রামের ফ্রক পরা মেয়েদের সঙ্গে গোল্লাছুট খেলি। ইচ্ছেগুলোকে আমি দমন করি, আমি জানি আমার শহুরে ঢংএ শাড়ি পরা, আমার গাড়ি, আমার জুতো-পা, আমার ছোট চুল সবই উদ্ভট দেখাবে এ অঞ্চলে, সকলে সার্কাসের ক্লাউন দেখছে এমন চোখে আমাকে দেখবে। গাড়ি থামিয়ে সেদিন গাড়িতেই বসে থাকি। সাহাবুদ্দিনের ঘর বাড়ি বউ বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করি। সাহাবুদ্দিন সংকোচে সলাজে উত্তর দেন। যে টাকা তিনি মাইনে পান, তা দিয়ে সংসার চলে কি না জিজ্ঞেস করলে বলেন, চলে। কোনও অভাব নেই? না। অন্য ড্রাইভার দেড় দুহাজার মত পায়, সাহাবুদ্দিনকে আমি দিই মাসে আড়াই হাজার। ইচ্ছে করেই দিই, এই টাকা সাহাবুদ্দিন দাবি করেননি। দুপুরে আমার বাড়িতেই খান। যদিও দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত তাঁর চাকরির সময়, কিন্তু মাসে বেশির ভাগ দিনই তাঁকে আটটা নটা পর্যন্ত থাকতে হয়। কখনও কখনও রাত দুটো। কোনওদিন আপত্তি করেননি, যে, এত রাত পর্যন্ত থাকা সম্ভব নয়। বাড়তি সময়ের জন্য তাকে কিছু বাড়তি টাকা দিতে যাই, সে টাকা হাতে নিতে সাহাবুদ্দিন লজ্জায় মরে যান। জোর করে দিতে হয়। সব মিলিয়ে মাসে তাঁর তিন হাজার টাকার মত সম্ভবত হয়। সাহাবুদ্দিনের আগে একটি ড্রাইভার ছিল, অল্প বয়স ছিল সেই ড্রাইভারের, ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাত, আর কোথাও কাউকে তুলে আনতে পাঠালে পথে নেমে তেল বিক্রি করত গাড়ির। ওই ছোকরা ড্রাইভারকে বাদ দিয়ে সাহাবুদ্দিনকে চাকরি দেওয়ার পর আমার কখনও ভাবতে হয় না গাড়ির ব্যপারে। গাড়ি মুছে পরিস্কার করে ঝকঝকে করে রাখেন সাহাবুদ্দিন। ইস্টার্ন হাউজিংএর গ্যারেজএ গাড়ি রেখে ড্রাইভাররা আড্ডা পেটায়, তাস খেলে। সাহাবুদ্দিনকে ওই আড্ডায় কখনও দেখিনি। তিনি গাড়ির ভেতর বসে বসে নামাজ শিক্ষা জাতীয় পকেট বই পড়েন। একবার তিনি সভয়ে জানিয়েছিলেন, কিছু অচেনা লোক তাঁকে প্রতিদিন খুঁজতে আসে গ্যারেজে। সাহাবুদ্দিনের ভয় ওই অচেনা লোকগুলো আমার কোনও ক্ষতি করার উদ্দেশে আসে তাঁর কাছে। সাহাবুদ্দিনকে শাসিয়ে যেতে আসে, যেন আমার গাড়ি আর না চালায় বা গাড়ির ভেতর গোপনে বোমা রাখতে আসে। সাহাবুদ্দিন তাই নিজেই গাড়ি থেকে বের হন না, প্রহরীদের বলে দিয়েছেন যেহেতু ওই লোকগুলো তাঁর চেনা কেউ নয়, যেন ওদের গ্যারেজের দিকে যাওয়ার সুযোগ না দেওয়া হয়। সাহাবুদ্দিন, পাজামা পাঞ্জাবি পরা লিকলিকে ক্লিন সেভড পঁয়ষট্টি বছর, আমাকে রক্ষা করেন আমাকে না জানিয়ে। তাঁকে কোনওদিন বলিনি কি হচ্ছে দেশে আমাকে নিয়ে। তিনি খবর পান কি হচ্ছে। তিনি যে জানেন তা আমাকে জানতে দেন না। শহরের রাস্তায় আমার গাড়ির দিকে কোনও লোক বা কোনও দল এগোতে থাকলে তিনি দ্রুত গাড়ি চালান, আমাকে বলতে হয় না দ্রুত পার হয়ে যেতে। আমাকে বলতে হয় না যে রাস্তায় মিছিল বা সভা হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে সেদিকে না যেতে। তিনি নিজেই অন্য রাস্তা ধরেন। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ঘুরে যাচ্ছেন কেন?
বললেন, ‘ওদিকে আজকে মিছিল আছে।’
‘কিসের মিছিল?’