গৌরী রাণী দাসকে যখন আমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম, মা বলেছিলেন, ‘অজানা অচেনা কাউরে বাড়িতে জায়গা দিবি! এইটা কি ঠিক হবে!’ মাকে আমি এক ধমক দিয়ে থামিয়েছিলাম, বলে, যে, ‘আমার বাড়িতে আমি কারে জাগা দিব না দিব সেইটা তোমার ভাবতে হবে না। এইটা আমার বাড়ি।’ আমার কণ্ঠস্বর আমার কাছেই খুব বাবার কণ্ঠস্বরের মত ঠেকেছিল। বাবার এরকম দিনে দুবার করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতেন যে অবকাশ নামের বাড়িটি তাঁর বাড়ি।
গৌরী রাণী দাস গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল, তার পক্ষে এবং দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির দাবি করে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম পত্রিকায়। আমার কথা কোনও না কোনও ভাবে কানে যায় গৌরী রাণীর। কানে যাওয়ার পরই গৌরী আমার বাড়িতে এসে আশ্রয় চায়। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সে মামলা করেছে, মামলার কারণে তাকে থাকতেই হবে ঢাকায়, কিন্তু এ শহরে কোনও থাকার জায়গা নেই তার। আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি একটি অসহায় মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়া। গৌরী রাণীকে বলেছি, যতদিন তার দরকার, সে নিশ্চিন্তে আমার বাড়িতে থাকবে, খাবে। মামলায় টাকা পয়সা দরকার হলেও আমার কাছ থেকেই নেবে। গৌরী রাণীকে বাড়িতে রীতিমত রানীর আসনে বসিয়ে দিলাম। সপ্তাহ দুই পার হলে মা বললেন, গন্ধে বাড়িটায় টিকা যায় না। মার ধারনা গন্ধটি গৌরীর গায়ের। মাকে তখনও হিংসুটে সংকীর্ণ মনা বলে থামিয়েছিলাম। পরে একদিন নিজেই আমি বোটকা গন্ধ পাই গৌরীর গা থেকে বেরোচ্ছে। গৌরী গোসল করে এলেও ওর গা থেকে যায় না। গৌরী এ বাড়িতে আসার পর থেকেই গন্ধটি আমি পাচ্ছিলাম, কিন্তু কখনও মনে হয়নি এ গৌরীর গন্ধ। গন্ধ দিন দিন তীব্র হয়ে উঠল। আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না গৌরীকে এ বাড়িতে চলে যেতে বলার। আমি বরং ওর কাপড় চোপড় ধোবার ব্যবস্থা করি। নাক ঢেকে মিনু গৌরীর কাপড়জামা ধুয়ে দেয়। তার পরও গন্ধ যায় না। গন্ধটি গেল, গৌরী যেদিন গেল।
মহাভোজের আয়োজন কর, আমার লেখক বন্ধুরা খাবেন।
রাঁধাবাড়া শেষ। কিন্তু এক্ষুনি আবার সাতজনের জন্য রাঁধো। সাতজন গার্মেণ্টেসএর মেয়ে আসছে খেতে।
ঘর ছেড়ে দাও, কলকাতা থেকে দাদা বা দিদি আসছেন। পাঁচদিন থাকবেন।
মদ আনাতে হবে, কবি বন্ধুরা পান করবেন।
জোরে গান বাজবে, যত জোরে ইচ্ছে করে, আমার পরান যেমন জোরে চায়।
কেউ শব্দ কোরো না, আমার লেখার অসুবিধে হয়।
রাত দুটো পর্যন্ত আড্ডা চলছে, তাতে কার কি! এটা আমার বাড়ি, সারারাত আড্ডা দেব। ড্রাইভারকে খাবার দাও, রান্নাঘরে না, ডাইনিং টেবিলে।
এসব কোনও কিছুতে মার আপত্তি নেই। দিন দুপুরে কায়সারকে নিয়ে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করছি, ঘন্টা পার করে দুজনই এলো চুলে বেরোচ্ছি ঘর থেকে, এতেও মার আপত্তি নেই। কিন্তু তারপরও দেখি মা হঠাৎ হঠাৎ আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যান। মা বাড়িতে থাকলে বাড়িটিকে বাড়ি মনে হয়। কোথাও কোনও ধুলো নেই। স্নানঘরের মেঝেয় জল পড়ে নেই। বিছানার চাদর কুঁচকে নেই। কাপড় চোপড় আধোয়া নেই। ক্ষিধে পাওয়ার আগেই খাবার দেওয়া হয় টেবিলে। যা যা ভালবাসি খেতে তাই দেখি রান্না হচ্ছে। লেখার টেবিলে ঘন ঘন চা দিতে কাউকে বলতে হয় না। বলার আগেই চা এসে যায়। বাড়ির সব কিছু আশ্চর্য সুন্দর হয়ে ওঠে। মা থাকলে বুঝি না যে মা আছেন। মা না থাকলেই টের পাই যে মা নেই। ইয়াসমিনকে একদিন মার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, মা রাগ কইরা চইলা গেছে।
‘কেন রাগ করছে?’
‘তুমি নাকি বলছিলা, টাকা পয়সা বেশি খরচ হইতাছে বাজারে।’
‘হ তা কইছিলাম। কিন্তু মারে উদ্দেশ্য কইরা তো কই নাই।’
‘মা ভাবছে মারে কইছ।’
মা আমার স্বাধীনতায় কোনও বাধ সাধেন না। কেবল তাঁর প্রতি আমার দুর্ব্যবহার তাঁকে কাঁদায়। তাঁকে যাযাবর করে। মা এখানে আমার কাছে ধমক খেয়ে অভিমান করে অবকাশে আশ্রয় নেন। অবকাশে বাবার ধমক খেয়ে আবার আমার কাছে ফিরে আসেন। মার স্থায়ী কোনও জায়গা নেই বসবাসের। মার নিজস্ব কোনও ঘর নেই। সংসার নেই। আমি লক্ষ করি না, মার প্রতি ব্যবহারের বেলায় আমি আমার অজান্তেই বাবা হয়ে উঠি। বাবার প্রতি আমার সমীহ বরাবরই ছিল, আছে, যতই তিনি নিষ্ঠুর হন না কেন। তাঁকে নিষ্ঠুর বলে গাল দিয়েছি, কিন্তু তাঁর প্রতাপের প্রতি গোপনে গোপনে শ্রদ্ধা ছিল বোধহয়, যা কখনও বুঝিনি যে ছিল। তাই যখনই আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, যখনই স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে জীবনে, তখনই আমার অজান্তেই আমি ছোটখাটো বাবা হয়ে উঠি। প্রতাপশালী। ক্ষমতাবান। মার দারিদ্র, মার হত ভাগ্য, মার রূপ হীনতা, মার হীনমন্যতা, মার নুয়ে থাকা, মার কষ্ট, মার নির্বুদ্ধিতা, মার বোকামো, মার ধর্মপরায়ণতা, মার কুসংস্কার কোনওদিন আমাকে আকর্ষণ করেনি। এসব আমাকে মা থেকে কেবল দূরেই সরিয়েছে। মা আমার সংসারে নিজেকে প্রয়োজনীয় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। আমার তবুও মাকে বাড়তি মানুষ বলে হয়। বাবার যেমন মাকে মনে হয়, অবকাশে। ঈদ পরব এলে আমি বাবার জন্য নানারকম উপহার নিয়ে ময়মনসিংহে যাই। মার কথা আমার মনে থাকে না। যদি কখনও দিতে হয় কিছু মাকে, আলমারি খুলে আমার পুরোনো কোনও শাড়ি, যা অনেকদিন পরেছি, এখন আর ভাল লাগে না পরতে, তাই দিই। তা পেয়েই মার খুশির অন্ত নেই। প্রথম নিতে চান না। বলেন, ‘তুমি পছন্দ কইরা কিনছ শাড়ি, তুমি পড়। আমার যা আছে, তা দিয়া ত চলতাছেই।’