পীর বেশারাতুল্লাহ মারা যাবার পর তার পুত্র মুসা বনেছিলেন নতুন পীর। কিন্তু বেশিদিন পীর হওয়ার আনন্দ তিনি ভোগ করতে পারেন নি। হৃদপিণ্ডের অসুখে হঠাৎ মারা যান। এরপর পীর বেশারাতুল্লাহর নাতি, ফজলি খালার বড় ছেলে মোহাম্মদ হয়েছে পীর। এই মোহাম্মদই দিয়েছে ফতোয়া। এই ফতোয়া সমর্থন করেছে পীরবাড়ির সবাই। ফতোয়াঃ মা যেন পীরবাড়িতে আর না ঢোকেন।
মার অপরাধ? তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কাফেরকে জন্ম দিয়েছেন এবং এই কাফেরের সঙ্গে মার এখনও মা মেয়ে সম্পর্ক বজায় আছে।
এই মার অপরাধ। হয় আমাকে ত্যাগ করতে হবে, নয়ত পীরবাড়ি ত্যাগ করতে হবে। ফজলিখালাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে মা বলেছেন, ‘ফজলি, আমি আমার নিজের মেয়েরে ত্যাগ করবো কেমনে? একটা কি হয়?’
‘ত্যাগ তোমাকে করতেই হবে বড়বু। তোমার মেয়ে হল কাফের। কাফেরের সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। যদি থাকে, তাহলে তুমিও কাফের।’
‘আমারে কাফের কইলি!’
‘এই দুনিয়ার ছেলে মেয়ে হিচ্ছে মিথ্যে মায়া। তোমাকে তো আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। ছেলে মেয়ের মায়ায় পড়ে তুমি যদি একটা কাফেরকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার কর, তাহলে বলে দিচ্ছি আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না। কোরানে আছে, তাহাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখিবে তো তোমাকে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করিব।’
‘নাসরিন মানুষের অনেক উপকার করে। ও খুব উদার। মেয়েদের ওপর অন্যায় অত্যাচার হয়, এইসবের বিরুদ্ধে লেখে। কত গরিব মেয়েরে ও টাকা পয়সা দিয়া সাহায্য করে। ও কি আল্লাহর ক্ষমা পাইব না?’
ফজলিখালা কঠিন গলায় বলেন, ‘না। কোনও ক্ষমা নাই তাদের। ও দোযখে যাবে। ও আল্লাহ বিশ্বাস করে না। বড়বু, তুমি খুব ভাল করেই জানো নাসরিন কোরান সম্পর্কে বাজে কথা লিখেছে। কোরান নাকি মানুষের লেখা। আমাদের নবীজি নাকি কামুক লোক। আল্লাহর নাকি অস্তিত্ব নাই। আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লা।’
‘দেখ ফজলি, তর দুলাভাই আমারে কোনও টাকা পয়সা দেয় না। ময়মনসিংহ থেইকা কয়দিন পরপরই আমারে দূর দূর কইরা তাড়ায়। এহন নাসরিনের কাছে গিয়া যদি আমি না থাকতে পারি, আমি থাকব কোথায়?’
‘সেইটা আমি কি জানি! সোজা কথা, এই বাড়িতে আসতে চাইলে কোনও কাফেরের মুখ দেখা তোমার জন্য হারাম। আর কাফেরের সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক যদি তুমি রাখতে চাও, তবে এই বাড়ি তোমার জন্য হারাম।’
মা কাঁদেন। মা ফুঁপিয়ে কাঁদেন। হাউমাউ করে কাঁদেন। ফজলিখালা মার কান্নার দিকে ফিরে তাকান না।
মাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় পীরবাড়ি থেকে। বলে দেওয়া হয়, মা যেন কখনও আর পীরবাড়ির ত্রিসীমানায় না ঘেঁসেন।
২৪. একথা সেকথা
ভালবাসাকে নিয়ে মা চলে এলেন ঢাকায়। ইয়াসমিন যেহেতু নটা পাঁচটা চাকরি করে, ভালবাসাকে মারই দেখাশোনা করতে হয়। ভালবাসার পুরো নাম স্রোতস্বিনী ভালবাসা। নামটি আমিই দিয়েছি। এই নাম নিয়ে প্রথম আপত্তি করেছিল মিলন।
এ কোনও নাম হল!
কখনও শুনিনি কারও নাম ভালবাসা।
তাতে কি!
লোকে হাসবে শুনে।
তাতে কি!
বড় হলে ছেলেরা টিটকিরি দেবে।
তাতে কি!
মিলনের মা মোসাম্মৎ আফিফা খাতুন নামটি ঠিক করেছিলেন। ওই নামটিই মেয়ের জন্য রাখা প্রায় হচ্ছিল হচ্ছিল, কিন্তু ইয়াসমিনের জোর আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে না। ইয়াসমিন আমার দেওয়া নামটির পক্ষে রীতিমত আন্দোলন করে এটিকেই বহাল রাখে। এখন গাল ভরে সবাই ফোলা ফোলা গালের মেয়েটিকে ভালবাসা বলে ডাকে। ভালবাসা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়ায় সারা বাড়িতে। দেখে আমার খুব ভাল লাগে। আমার কোলে বসে মাঝে মাঝে কমপিউটারের কীবোর্ড টিপে আমার লেখা নষ্ট করে দেয়, এতেও আমার রাগ হয় না। ভালবাসার জন্য ভালবাসা জাগে।
মার যাযাবর জীবন যে শান্তিনগরের বাড়িটিতে স্থিরতা পাবে, তা পায় না। মা স্থিরতা চান, কিন্তু তাঁকে দেবে কে? অবকাশে বাবার অধীনতা মানতে হয়। আর শান্তিনগরে মানতে হয় আমার অধীনতা। মার পরাধীন জীবন পরাধীনই থেকে যায়। নাহিদকে মার পছন্দ নয়। নাহিদ নিজে সিগারেট খায়, আমাকেও সিগারেট খাওয়া শেখাচ্ছে, এটি তো আছেই, তার ওপর মার ধারনা নাহিদ খুব বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু নয় আমার। মাকে আমি ধমকে চুপ করতে বলি, বলে দিই আর যেন একটি কথা না উচ্চারণ হয় নাহিদের বিরুদ্ধে। মা আড়ালে গিয়ে চোখের জল ফেলেন। নাহিদ আমার বাড়িতে যখন খুশি আসবে, তাকে যেন সম্মান করা হয়, এটি জানিয়ে দিই। সম্মান নাহিদকে ঠিকই করা হচ্ছিল, কিন্তু নাহিদ অবশ্য আমাকে ফাঁক পেলেই বলে আমার বাড়ির কোন মানুষটি তার সঙ্গে কোন সৌজন্যটি দেখায়নি, দরজা খুলতে দেরি করেছে, সময়মত খাবার দেয়নি, তার দিকে অবজ্ঞা চোখে চেয়েছে। নাহিদের এসব শুনে সব রাগ আমার গিয়ে পড়ত মার ওপর। কিন্তু একদিন নাহিদের ওপর আমার নিজেরই রাগ হয়। নিপার মা নিপাকে নিয়ে আমার বাড়িতে নাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে এসেছিলেন এক রাতে। আমার বাড়িতে নাহিদের সঙ্গে নিপার দেখা হতে হতে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। মাঝে মাঝে নাহিদ রাত কাটায় নিপাদের বাড়িতে। শেষ রাতটিতেই ঘটনাটি ঘটেছে, নিপার সঙ্গে রাতে এক বিছানায় শুয়েছিল নাহিদ, কিন্তু নাহিদের হাত অন্ধকারে বারবারই নিপার শরীরে আনাচে কানাচে গিয়েছে,একসময় সে জোরও করেছে নিপার কাপড় জামা খুলে নিতে। নিপা তার মাকে এই ঘটনা জানিয়ে দিলে নিপার মা নিজে আসেন আমাকে বলতে যে আমি যেন নাহিদকে বলে দিই আর কোনওদিন যেন সে নিপাদের বাড়িতে না ঢোকে। এটি কোনও কারণ নয় নাহিদকে সন্দেহ করার বা তার ওপর রাগ করার। নাহিদ সম্ভবত সমকামী, যা আমার আগে জানা ছিল না। নাহিদ জানায়নি, সেটি সে লুকিয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত ব্যপার সে লুকোতেই পারে, এ তার দোষ নয়। সন্দেহটি জাগে যখন একটি পত্রিকায় কায়সারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে লেখা হয়। লেখা হতেই পারে, কায়সারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মোটেও লুকোনো কোনও ব্যপার নয়। কিন্তু কায়সার আমার হাতে একদিন মার খেয়েছিল, মার খেয়ে ছেঁড়া শার্ট পরেই তাকে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল এ কথাটি লেখা হয়েছে। ঠিক এরকম না হলেও কাছাকাছি একটি ঘটনা ঘটেছিল এবং নাহিদ সেটি দেখেছে। বাড়িতে তখন আর কেউ ছিল না যে কি না পত্রিকার কাউকে এ খবরটি দিতে পারে। সেই থেকে নাহিদের ওপর যে আমার আস্থা ছিল, সেটি কমে যায়। আমি আর দরজা খুলি না নাহিদ এলে। সে খুব চেষ্টা করে আমার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করার,অনুরোধ আবদার, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা, চিঠি লেখা, ফোন, সবই সে করে। কিন্তু আমাকে সে কিছুতেই নরম করতে পারে না। আমার ব্যক্তিগত ব্যপার নিয়ে পত্রিকায় লেখা ছাপা হতেই পারে। প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে। এসব আমি এখন আর গ্রাহ্য করি না। কারণ একটি সত্য ঘটনার সঙ্গে সাতটি বানানো ঘটনা মিশিয়েই সাধারণত আমার ব্যক্তিগত জীবন রচনা করে হলুদ সাংবাদিকরা। প্রথম প্রথম আমার দুঃখ হত, রাগ হত। কিছু না হলেও ভাবনা হত। এখন ওসব গল্পে একবার চোখ বুলিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই। নাহিদকে আমি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু গুপ্তচর হিসেবে আমার কাছে সে আসুক, তা আমি চাই না। নাহিদ নিজে আমার সম্পর্কে লিখতে পারে বা আমার সম্পর্কে বলতে পারে অন্য কোনও সাংবাদিককে, এতে আমার আপত্তি নেই। সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু লুকিয়ে কেন! যা সে আমার কাছে বলছে, আমার আড়ালে গিয়েই সে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছে, তা যখন জানা হয়ে যায়, তখন সে আমার আর যা কিছুই হোক, বন্ধু নয়, এ ব্যপারে আমি নিশ্চিত। সামনে এক কথা, আড়ালে আরেক কথা বলার চরিত্র অনেক লোকের। এমন চরিত্র আমার মোটেও পছন্দ নয়, এমন চরিত্রের মানুষকে আমার বাড়িতে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ আমি দিতে চাই না।