এদিকে বড় শহরে জুসমে জুলুসের মিছিল হচ্ছে। ঘটা করে হযরত মোহাম্মদের জন্মদিন পালন হচ্ছে। বিশাল বিশাল টুপিবাহিনীর ট্রাক-মিছিলে পুরো ঢাকা শহর ছেয়ে যায়। সাজ সাজ রব চারদিকে। আর যেদিন হিন্দুদের জন্মাস্টমীর মিছিল বেরোলো, মিছিলে বিএনপির লাঠিয়াল বাহিনী আর যুব কমাণ্ডের লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মেয়েদের শাড়ি খুলে নিয়েছে, কৃষ্ণ সেজেছিল যে শিশুটি, তারও মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। পুলিশ কোনও আক্রমণকারীকে একটি টোকা পর্যন্ত দেয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে শুধু।
যখন দেশজুড়ে মৌলবাদিদের প্রলয়ঙ্করী নৃত্য চলছে, তখন সরকার বিষম বিচক্ষণতা দেখালেন মৌলবাদিদের নেতা গোলাম আযমকে নিরপরাধ প্রমাণের ব্যবস্থা করে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে! ঘাতকের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হচ্ছে প্রকাশ্যে। যে দেশদ্রোহীর নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল, সেই দেশদ্রোহীকে আজ সসন্মানে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। কি জানি, সম্ভবত এই সরকার গোলাম আযম এবং তাঁর ঘাতক সঙ্গীদের, যাদের কারণে লক্ষ লক্ষ বাঙালির ঘর আগুনে পুড়েছে, লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিহত হয়েছে, ধর্ষিতা হয়েছে, অচিরে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেবে। গোলাম আযমকে মুক্তি দেওয়া হয় আর ওদিকে রমনায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণআদালত এর সভা থেকে মাইক ছিঁড়ে নেওয়া হয়, গণসমাবেশে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, মানুষ আহত হয়। এ দেশ যেন আমার নয়, আমাদের নয়, আমরা যারা গর্ব করি রফিক বরকত, সালামকে নিয়ে, যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে প্রাণ দিয়েছিলেন, আমরা যারা গর্ব করি অসংখ্য অগুনতি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে, যাঁরা এ দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এ দেশ হয়ে যাচ্ছে গোলাম আযমের দেশ। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। শহীদ মিনারের পাশের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস, কাজী নজরুলের বাণীগুলো রঙ মেখে নষ্ট করে দিয়েছে স্বাধীনতার শত্রুরা। কালি লেপে দিয়েছে ‘বাংলার হিন্দু বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’র ওপর। আর কত ধ্বংস দেখতে হবে আমাদের! তার চেয়ে অন্ধ হয়ে যাক আমাদের চোখ, আমরা বধির হয়ে যাই!
গ্রামের মেয়েদের ওপর ফতোয়া দেওয়ার প্রতিবাদ করতে মহিলা পরিষদ একটি মিছিল বের করে। প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় বসে যান গ্রামের মহিলারা, হাতে কঞ্চি, কঞ্চির আগায় মহিলা পরিষদের স্লোগান লেখা কাগজ। মহিলা পরিষদের সভায়, কোন কোন মেয়েকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে সবার নাম উল্লেখ করে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেন নেত্রীরা। কেউ কিন্তু একবারও উচ্চারণ করেননি আমার নাম। মহিলা পরিষদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠন, সভানেত্রী হিসেবে সুফিয়া কামালের নাম থাকলেও মূল নেত্রী মালেকা বেগম। মালেকা বেগম নারী বিষয়ে অনেকগুলো বইও লিখেছেন। বহু বছর ধরে তিনি নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং বলা যায় দেশের হাতে গোণা দুইএকজন নারীবাদী নেত্রীর মধ্যে তিনি অন্যতম। একদিন আমার বাড়িতে তিনি পদধূলি দেন। বিস্ময়াভিভূত আমি তাঁকে প্রায় আলিঙ্গণ করতে নিই। পত্রিকায় কলাম লেখা শুরু করার পর মালেকা বেগমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কয়েকবার, বলেছিলেন, ‘খুব ভাল হচ্ছে লেখা, লিখে যাও, লিখে যাও।’ মালেকা বেগমের স্বামী মতিউর রহমান কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা একতার সম্পাদক। একতা থেকে বেরিয়ে এসে এখন অবশ্য ভোরের কাগজএর সম্পাদক হয়েছেন। দুজনই সমাজতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। দুজনের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা প্রবল। প্রবলই ছিল। তবে মাঝে মাঝে প্রবলের শরীরে চমকের ধাককা লেগেছে। আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার পর অতি আনন্দে আনন্দর খবর দিতে যেদিন মালেকা বেগমের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তিনি বক্রহাসি হেসে বলেছেন, ‘সুনীলের সঙ্গে খাতির থাকলে আনন্দ পুরস্কার পাওয়াই যায়, এ তো সবাই জানে!’ তিনি মোটেও পছন্দ করেননি আমার পুরস্কার পাওয়া। আমি যোগ্য নই পুরস্কারের, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার জন্য এই পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন, এই তাঁর বিশ্বাস। বড় একা বোধ করেছি। আনন্দ পুরস্কার এমনই একটি ধারালো কাঁটা, যে কাঁটাটি আমার শুভাকাঙ্খীদের বড় একটি সংখ্যার শরীরকে খোঁচা মেরে প্রায় শূন্যে নামিয়ে দিয়েছে। আমি মাথা নিচু করে মালেকা বেগমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। আরও একদিন অবাক লেগেছিল আমার, আমি বুঝে পাইনি মালেকা বেগম এ কী কাণ্ড করছেন, যখন তিনি তাঁর দলের লোক নিয়ে আদালত প্রাঙ্গনে খুকুর ফাঁসি চাইছিলেন। মুনিরের সঙ্গে খুকুর সম্পর্ক ছিল এবং সে সম্পর্ক ছিল অবৈধ, এ কথা পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর লোকেরা খুকুকে ছি ছি করল, দুয়ো দিল। আর কোথায় খুকুর পক্ষে দাঁড়াবে মহিলা পরিষদ, উল্টো আদালতের দরজায় গিয়ে খুকুর ফাঁসি চাই চিৎকার দিয়ে গলা ভাঙল। মহিলা পরিষদের বিখ্যাত নেত্রীটি এখন আমার বাড়িতে।
‘তোমাকে দেখতে আসলাম, কেমন আছ তুমি?’
আমি মলিন হাসি। আমি কেমন আছি তা নিশ্চয়ই তিনি অনুমান করতে পারেন।
‘তোমার কাছে আসলাম। ভাবলাম দেখে যাই। যে অবস্থা হচ্ছে দেশে, তোমার জন্য খুব চিন্তা হয় আমাদের। মোল্লারা খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।’
‘হ্যাঁ। কি যে হবে দেশের!’