ভারতের সানডে ম্যাগাজিন, স্টেটসম্যান থেকে সাংবাদিক আসেন সাক্ষাৎকার নিতে। সারা ভারতেই ফতোয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে সভা হচ্ছে। বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। সচেতন লেখকরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন লিখে। পত্রিকায় সম্পাদকীয় যাচ্ছে। কলকাতায় অন্নদাশংকর রায়ের নেতৃত্বে লেখকরা গিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসে স্মারকলিপি নিয়ে। দূতাবাসের দুয়ার খটাশ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওঁদের মুখের ওপর। কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির আয়োজনে আমার জীবন ও লেখার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সভা হয়। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা অনুষ্ঠানে ছিলেন, অবশ্য বাংলাদেশের কেউ ছিলেন না। অন্নদাশংকর রায় ওখানেও ছিলেন। তাঁর মতে আমি একবিংশ শতকের কন্যা, ভুল করে বিংশ শতকে জন্মেছি। আমি ফ্রান্স বা ইংলেণ্ডের কন্যা, ভুল করে বাংলাদেশে জন্মেছি। আরেকটি কথা বলেছেন, ‘তসলিমা একজন আ্যংরি ইয়ং উওম্যান, মোল্লারা একদল অ্যাংরি ওল্ড ম্যান। এদের মধ্যে মিটমাট অসম্ভব। অনেক কথার মধ্যে আরেকটি কথা, বাংলাদেশের জনমত আমরা এখান থেকে বদলাতে পারব না, সেটা পারবে সেখানকার জননায়ক বুদ্ধিজীবীরা, আমরা তাঁদের সমর্থন করতে পারি শুধু।’
এদিকে পেঙ্গুইন ইণ্ডিয়া থেকে লজ্জার ইংরেজি সংষ্করণ বেরিয়ে গেছে। ফোন আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে, প্রকাশকরা ফোন করছেন। তাঁরা লজ্জা বইটি অনুবাদ করে ছাপতে চান। ফতোয়ার খবরটি বিদেশের প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর ওখানকার মানুষের বদ্ধ ধারণা যেহেতু লেখক আমি, নিশ্চয়ই আমি এমন কোনও আপত্তিকর বই লিখেছি, যেটির কারণে মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে। সালমান রুশদিকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল স্যাটানিক ভার্সেসএর কারণে। আমার ফতোয়াও নিশ্চয়ই কোনও না কোনও বইয়ের কারণেই। লজ্জা বইটি সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সে অনেকদিন হয়ে গেল। কিন্তু সাংবাদিকরা পাকামো করে পাঠকের জানার তৃষ্ণা মেটাতে লজ্জাকে ফতোয়ার কারণ হিসেবে কোথাও কোথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু লজ্জা কি মৌলবাদীদের ক্ষেপে ওঠার মূল কারণ? মোটেও না। ওরা তো ক্ষেপেই ছিল। ক্ষেপে আগুন হয়ে ছিল, সরকারের লজ্জা নিষিদ্ধের ঘি ওদের আগুনে গিয়ে পড়েছে। তাই ফতোয়া। আর ফতোয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কিছু না করার ঘি ওদের আগুন আরও বেশি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই দেশ জুড়ে আন্দোলন। পেঙ্গুইন লজ্জা ছেপেছে, সে চলে। কারণ লজ্জার কাহিনী যদিও সম্পূর্ণ বাংলাদেশের পটভূমিতে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ যেহেতু ঘটে, পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না গল্পটি। কিন্তু জার্মান পাঠক বা ফরাসি পাঠক লজ্জার কী বুঝবে! আমি বিরক্ত কণ্ঠে প্রকাশকদের প্রশ্ন করি, ‘আপনারা কি জানেন লজ্জা বইটি কি নিয়ে?’
‘না, তা জানি না।’
‘এটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের স্থানীয় ব্যপার। প্রচুর তথ্য আছে। আপনাদের পাঠকের এসব পড়তে ভাল লাগবে না। উপন্যাস হিসেবে এটি ভাল কোনও বই নয়।’
‘সে নিয়ে আপনি মোটেও ভাববেন না। অনুগ্রহ করে আমাদের অনুমতি দিন।’
‘আমি এমন কোনও বই এখনও লিখিনি যেটি বিদেশে অনুবাদ হতে পারে। এখানকার সমাজের সমস্যা নিয়ে লিখি। কোনও বই আন্তর্জাতিক মানের নয়। আমি ভাল কোনও বই লিখি আগে, তারপর দেব আপনাদের।’
‘সে না হয় ছাপব, যা লিখবেন ভবিষ্যতে। কিন্তু আমরা লজ্জা ছাপতে চাইছি।’
‘কেন, লজ্জা কেন?’
‘লজ্জা তো বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। লজ্জার জন্যই তো ফতোয়া।’
‘না, লজ্জার জন্য আমাকে ফতোয়া দেওয়া হয়নি। লজ্জা বের হওয়ার আগে থেকেই আন্দোলন করছে মৌলবাদীরা। নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক পরে ফতোয়া দিয়েছে। লজ্জা বের হওয়ার পর ছ মাস চলেছে এখানে। কোনও মৌলবাদী লজ্জা নিষিদ্ধ করার দাবি করেনি।’
‘তবুও আমরা লজ্জাই ছাপতে চাই।’
‘এ বই আপনাদের ওখানে চলবে না।’
‘সে আমরা বুঝব। লজ্জা বইটি ছাপার অনুমতি তো দিন। আমরা অগ্রিম রয়্যালটি দেব।’
রিয়্যালটি কোনও ব্যপার নয়। ব্যপার হচ্ছে পাঠকের আগ্রহ। এখানকার হিন্দু মুসলমানের সমস্যা নিয়ে ওখানে আগ্রহ থাকার কথা নয়।’
‘খুব আগ্রহ আছে। আপনি আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। এসব আমরা দেখব।’
নাছোরবান্দা। ফ্রান্সের এডিশন দ্য ফামের মিশেল ইডেল দিনে তিনবেলা ফোন করেন, ‘তসলিমা আপনি তো নারী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছেন। এখানে আমাদের সংগঠনও দীর্ঘবছর ধরে একই সংগ্রাম করে আসছি। আমরা আপনার জন্য এখানে আন্দোলন করছি। আপনি আমাদের লজ্জা বইটি ছাপার অনুমতি দিন। আমরা কনট্রাক্ট ফরম পাঠাচ্ছি। আপনি সই করে দিন।’
‘দেখুন, লজ্জা বইটি নারী স্বাধীনতার ব্যপার নয়। নারী বিষয়ে আমার কিছু বই আছে। আপনারা দেখুন, ওর মধ্যে একটি ছাপা যায় কি না। যদিও আমি নিশ্চিত নই, বাংলাদেশের মেয়েদের সমস্যাগুলো আদৌ ওখানে..’
‘সে নিয়ে ভাববেন না। আমরা অন্য দেশের মেয়েদের সমস্যা জানতে চাই খুব। কিন্তু ওগুলোও ছাপবো। লজ্জা আগে ছাপবো।’
‘লজ্জা ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে। আগে পড়ে দেখুন ওটি, ছাপার যোগ্য কি না। আমি কিন্তু জানি যে আপনি পড়ার পর ছাপতে রাজি হবেন না।’
‘না বলব! বলছেন কি? আমরা লজ্জা বইটা পাওয়ার জন্য এমন আকুল হয়ে বসে আছি।’
‘কি আছে ওতে বলুন তো?’
‘ওতে ইসলামের সমালোচনা করেছেন। তাই তো মুসলমানরা ক্ষেপেছে।’