মিছিল আসছে। একশ নয়, দুশ নয়, কয়েক হাজার লোকের মিছিল। কাকরাইলের মোড় থেকে মিছিল আসছে শান্তিনগরের দিকে। আমি জানালায় বসে দেখছি বড় বড় অক্ষরে ব্যানারের লেখা, তসলিমার ফাঁসি চাই। এগিয়ে আসছে মিছিল নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর বলতে বলতে। মিছিল আসছে। মা বিড়বিড় করে সুরা পড়ছেন। আমাকে জানালার কাছে দেখে সুরা উবে গেল মুখ থেকে। টেনে আমাকে সরালেন জানালা থেকে। সুরায় খুব কাজ হবে বলে মার বিশ্বাস হয় না, মা দৌড়ে গিয়ে জায়নামাজে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাথা ঠেকিয়ে রাখলেন, যদি মার প্রার্থণা আল্লাহতায়ালার কানে পৌঁছোয়। আল্লাহ তায়ালা এই জনরোষ থেকে আমাকে যেন রক্ষা করেন। মিছিল এসে থামল শান্তিনগরের মোড়ে। মোড়ে কিছু খাকি পোশাকের পুলিশ দাঁড়ানো। পুলিশ বাধা দিচ্ছে এগোতে। মোড় থেকে নারায়ে তকবীরের গর্জনে বাড়ি কেঁপে ওঠে।
এরকম প্রায়ই মিছিল আসে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে শান্তি নগরের দিকে। এরকম প্রায়ই প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি।
মানুষের এই ঢল যদি কখনও আমার ঘরে উঠে আসার সুযোগ পায়! দরজায় বসে থাকা দুটো পুলিশ কি আর রোধ করতে পারবে ঢল! দিন দিন বানের ফুঁসে ওঠা জলের মত এগোচ্ছে মিছিল।
শায়খুল হাদিস বিখ্যাত লোক। তিনি নতুন একটি কমিটি গঠন করেছেন। ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি। দলে দলে মুফতী মাওলানা যোগ দিচ্ছেন এই কমিটিতে। বিশাল ব্যানার নিয়ে বিশাল মিছিল করছে এই দল। বিশেষ করে শুক্রবার জুম্মাহর নামাজের পরই মিছিল শুরু হয়। কেবল মিছিল করেই বসে থাকে না এই দল। জাতীয় সংসদের স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।
মাননীয় স্পীকার
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
সংসদ ভবন
শেরে বাংলা নগর,
ঢাকা
জনাব,
যথাযথ সম্মানপূর্বক নিবেদন এই যে
১. বাংলাদেশের আপামর জনতা গভীর ভাবে ধর্মপ্রাণ এবং এ দেশের সকল সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যপারে অত্যন্ত সচেতন ও যত্নশীল এ সত্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু কতিপয় বিভ্রান্ত মহল জনগণের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানাকে প্রগতিশীলতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন মনে করে জনগণের ধর্মীয় চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের হীন তৎপরতা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ হেন দুষ্কর্মের পিছনে ইসলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সামাজিক সুস্থিতির প্রতি বৈরি মহল সমূহের মদদ ও যোগসাজস রয়েছে তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
২. তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কুখ্যাত লেখিকা ক্রমাগত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কলাম, বই ও উপন্যাস লিখে একাধারে বাংলাদেশের সকল ধর্ম বিশ্বাসীর ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হেনে চলছে। অন্যদিকে অত্যন্ত সুচতুর ও সুপরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারষ্পরিক বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে।
৩. মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যভিত্তিক অসৎ উদেবদশ্য প্রণোদিত উপন্যাস লজ্জা লিখার মাধ্যমে তসলিমা নাসরিন এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সর্বজন স্বীকৃত ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং দেশী বিদেশী কতিপয় সাম্প্রদায়িক মহলকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা পরায়ণতার দিকে উস্কে দিয়েছে। অথচ সরকার শুধুমাত্র লজ্জা উপন্যাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোনরূপ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যদিও তসলিমা নাসরিনের বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে বহু উস্কানিমূলক বক্তব্য রয়েছে যা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। সরকারের এহেন আচরণে দেশপ্রেমিক জনগণ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্থ।
৪. যদিও সাংবিধানিকভাবে এবং দেশের প্রচলিত আইনে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানা এবং তাদের মধ্যে পারষ্পরিক বিদ্বেষ ছড়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু এ ধরনের দেশ ও ধর্মবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান না থাকায় দেশদ্রোহী ও ধর্মবিরোধী মহল সমূহ বেপরোয়া ভাবে অপকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছে এবং সামাজিক সংঘাত ও অস্থিরতার ইন্ধন যোগাচ্ছে।
৫. বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগ মানুষ মুসলমান। লেখিকা তসলিমা নাসরিন তার বিভিন্ন বই ও লেখার মাধ্যমে মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন, নবী(দঃ)এর হাদিস এবং ইসলামী শরিয়তের বিভিন্ন বিধি বিধানের প্রতি অবমাননামূলক কটাক্ষ প্রতিনিয়তই করে চলেছে এবং তার এহেন ধর্মদ্রোহী আচরণের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল সকল ধর্মীয় মহল থেকে জোর প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও সরকার এ ব্যপারে দুর্বল আইনের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে রহস্যজনক ভাবে নিষিক্রয়তার পথই অবলম্বন করে চলেছেন। ফলে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অত্যন্ত যুক্তিসংগত কারণেই বর্তমান আইন কানুন ও সরকারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন।
৬. লেখিকা তসলিমা নাসরিন শুধু ধর্মের উপরেই আঘাত হানছে না, সমাজে প্রচলিত সার্বজনিন মূল্যবোধের বিপরীতে ব্যভিচার, অবাধ যৌন সম্পর্ক, বিবাহপূর্ব এবং বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক জুলুমের ফাঁপানো ফুলানো কল্পকাহিনী প্রচার করে সামাজিক সুস্থিতি বিনষ্টের অপপ্রায়াসেও লিপ্ত রয়েছে। তার লেখা যে পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে পড়ে এবং তা এ দেশের যুব সমাজকে উμছৃঙ্খলতা ও নৈতিক অক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বৈ ত কিছুই নয়।
এমতাবস্থায় আমরা দেশ প্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জোর দাবী জানাচ্ছি যে ১. দেশদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহী মুরতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড সহ কঠোর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন। ২. তসলিমা নাসরিনকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং ৩. তার যাবতীয় আপত্তিকর লেখা বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
(শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক)
আহবায়ক
ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
সাত মসজিদ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা