রাতে অতিথিদের ঘুমোবার আয়োজন হচ্ছে যখন, আমার আর রুদ্রর জন্য আলাদা দুটি ঘরের ব্যবস্থা করা হল, কারণ অতিথিদের একজন বাড়ির কর্তার কানে কানে আমাদের বিয়ে-বিচ্ছেদের খবরটি পৌঁছে দিয়েছেন। রুদ্র আর আমি দুজনই আলাদা ঘরের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে এক বিছানায় ঘুমোই। অনেক অনেকদিন পর রুদ্র আমাকে স্পর্শ করে গভীর করে। অনেক অনেক দিন পর রুদ্র আমাকে চুমু খায়। অনেক অনেক দিন পর দুজনের শরীর একটি বিন্দুতে এসে মেশে। একবারও আমার মনে হয় না রুদ্র কোনও পরপুরুষ। মনে হয় না যে আমরা এখন পরষ্পরের অনাত্মীয় কেউ, অবন্ধু কোনও। পরদিন ঝিনাইদহে সকাল হয়, লোকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কী করে পরপুরুষের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমোতে রুদ্রর না হোক, আমার দ্বিধা হল না! আমার হয়নি। যে পাপবোধের কথা অন্যরা ভাবে, সেই পাপবোধের লেশমাত্র আমার মধ্যে নেই। কারও ভ্রুকুঞ্চণ আমাকে স্পর্শ করে না। আমি রুদ্রকে কাগজে পত্রে ত্যাগ করেছি তা ঠিক, তবে কোনও পুরুষকে যদি আমার সবচেয়ে কাছের বলে মনে হয়, সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়, সে রুদ্র। এর মধ্যে এক বিন্দু কৃত্রিমতা নেই, এক ফোঁটা মিথ্যে নেই। ভালবাসি এক রুদ্রকেই, যতই তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ থাকুক না কেন। এই ভালবাসার বোধটি আমি খুব গোপনে গোপনে লালন করি। এই বোধটি আমার একটি হাত নিয়ে রাখে রুদ্রর উষ্ণ কৃষ্ণ হাতে। এই বোধটি একা নিভৃতে বসে থাকে, সংসার যাপনের পরিকল্পনা করে না, ভবিষ্যতের কথা সামান্যও ভাবে না, বোধটি বোধহীন বটে। ঢাকার পথে দুজন যখন কবিতার গল্পে ডুবে যাই, কবিতার দুটি একটি বাক্য পরস্পরকে শোনাচ্ছি, রুদ্র অনেকদিন আগের লেখা একটি কবিতা মুখস্ত বলতে থাকে। তার মনে হয় তার সময়গুলো আসলেই পচে গলে যাচ্ছে।
‘খুলে নাও এইসব পোশাক আমার কৃত্রিমতা
মাংসের ওপরে এই ত্বক, এই সৌন্দর্য মোড়ক
খুলে নাও দিনের শরীর থেকে রোদের ভূমিকা।
গলা পিচের মতোন গলে যাচ্ছে মুহূর্ত, সময়,
গলে যাচ্ছে নারী আর শিশুদের অনাবিল বোধ,
মানুষের মৌলিক বিশ্বাস, গলে যাচ্ছে ভালবাসা
আমি ফেরাতে পারি না সভ্যতার অবিরল ক্ষতি,
আত্মরমনের ক্লেদ, জলে ভাসা পুস্পের সংসার,
শিশুর মড়ক, আমি ফেরাতে পারি না মহামারি,
ভ্রুণ হত্যা, অন্ধকারে জ্বলজ্বলে হননের হাত..
ক্ষমাহীন অক্ষমতা জমে জমে পাহাড় হয়েছে,
পাহাড়ের পাদদেশে সোনারঙ আলস্যের ধান,
আর কিছু দলছুট পরাজিত বিবর্ণ মারিচ।
টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলো আমার চেতন,
বিশ্বাসের স্থবির শরীর চাবুকে রক্তাক্ত কর,
ক্ষুধার্ত সিংহের মুখে ছুঁড়ে দাও আমার আত্মাকে।
মানুষের মৌলিক মুখোশ আমি খুলতে পারি না,
শুধু পুড়ে যেতে পারি, পুড়ে যাই, পোড়াই সৌরভ,
রাতের আগুন এনে নিবেদিত সকাল পোড়াই।’
পা পা করে একটি কষ্ট উঠে আসছে আমাদের দিকে, স্পষ্ট দেখি। ঝাঁক বেঁধে বিষণ্নতাও আসে। কষ্টকে দূর ছাই হাতে সরিয়ে রুদ্র শিমুল নামের একটি মেয়ের কথা বলে, মেয়েটিকে সে গত বছরই প্রথম দেখে মেলায়, মেয়েটিকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছে।
‘কি রকম কবিতা?’
‘আমারও ইচ্ছে করে বৈশাখের ঝড়ের সন্ধ্যায়
অন্য কোনো তরুণীর হাত ধরে সুদূরে হারাই,
বৃষ্টি ও বাতাসে মেলি যুগল ডানার স্বপ্ন।
আমারও ইচ্ছে করে ফুটে থাকি অসংখ্য শিমুল।’
‘তারপর?’
‘দুপুরের রোদে পোড়া চিবুকের উদাসীন তিল
ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে ভালবাসা, নীল চোখ, চাঁদের শরীর
আমারও ইচ্ছে করে আঙুলে জড়াই মিহি স্মৃতি,
স্বপ্নের কপাল থেকে ঝরে পড়া চুলগুলো আলতো সরাই।’
‘আর কী কী ইচ্ছে করে?’
‘ইচ্ছে করে নগরের নিয়ন্ত্রিত পথে
সমস্ত নিষেধ মানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
সড়কের মাঝখান বেয়ে হেঁটে যাই
আমারও ইচ্ছে হয় কাঁদি।’
‘এ তো সুখের কথা। এতে কাঁদার কি হল? কাঁদবে কেন?’
রুদ্র হেসে বলে, ‘আরে শোনোই না।’
আমিও হাসি বলতে বলতে, ‘আরে বলই না।’
‘আমারও ইচ্ছে করে খুলে দিই হাতকড়া বাঁধা হাত,
চক্রান্তের খল বুকে কামড় বসাই।
আমারও ইচ্ছে করে
টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলি তোমার শরীর।’
‘ছি ছি, এমন কসাইএর মত কথা বলছো কেন? কার শরীর টুকরো টুকরো করতে ইচ্ছে হয় তোমার?’ আমার বঙ্কিম চাহনী বঙ্কিম ওষ্ঠে এসে সরস হতে না হতেই রুদ্র বলে,
‘দৃশ্যকাব্যগুলো পড়েছো? শিমুলকে নিয়ে লেখা।
আমি তোমার নাম জানি না,
দেখলে চিনি।
এখন আমি কোথায় গিয়ে খুঁজবো তোমায়?
খুঁজতে খুঁজতে কোথায় যাবো?
সিরামিকের গাছগাছালি,
ইটের ঝাউ বনের ভেতর
কোথায় আমি খুঁজবো তোমায়?
কোথায় তোমার সৌম সকাল, শান্ত দুপুর?
কোথায় তোমার মুখর বিকেল, একাকি রাত?
খুঁজবো কোথায়–ঝরা পাতায় সাজানো ঘাস
সন্ধ্যাবেলায়? কোথায় খুঁজবো?’
আমি বলি, ‘অনেক খুঁজেছো, দৃশ্যকাব্য দুইএ তোমার ঘুমও যে মেয়েটিকে খুঁজতে গেছে, সকালে টের পেয়েছো। দৃশ্যকাব্য তিনেও তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!। নদী পেরোচ্ছে!, সাগর পেরোচ্ছে!, বিস্তৃত মাঠ পেরোচ্ছে!, পাহাড় পর্বত বন বাদাড় সব খুঁজছো, এমনকি আকাশেও খুঁজছো, এত খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত পেয়েছো তাকে?’
রুদ্রর মুখে অমলিন হাসি। বলে সে পেয়েছে তাকে খুঁজে। শিমুলকে। শিমুল নাকি একটুখানি চেয়েছিল প্রথম প্রথম। অত বেশি নিজেকে খুলতে চায় নি। শিমুলের দুপুরগুলো রুদ্র তখন উড়িয়ে দিতে বলছে।