বাবাও যান সুহৃদকে দেখতে। বাবার কাছেও গীতা সুহৃদকে ভিড়তে দিতে চায় না। সুহৃদের প্রাণ ফেটে যায় কাছে বাবার কাছে যাবার জন্য। ধমকে কান মলে পিঠে কিল বসিয়ে সুহৃদকে স্থির করে রাখা হয় যেখানে গীতা চায় সে স্থির হোক। বাবা ফিরে আসেন অবকাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে। বলেন, ‘গীতা কি ভুইলা গেছে যে সুহৃদ তার পেটের ছেলে!’
সুহৃদের দুঃসহ অবস্থা দেখে প্রতিবারই আমরা এক বুক দুঃখ আর হতাশা নিয়ে ফিরি। এমনও হয় যে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দরজায়, গীতা দরজা খুলছে না। মা নিজে বাসে চড়ে গরমে ভুগতে ভুগতে ধুলোয় ধোঁয়ায় কালো হতে হতে বাসের গুঁতো ধাককা খেতে খেতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় গিয়ে ছোটদার বাড়ির বারান্দায় তিন চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এসেছেন। গীতা ঘরে ছিল, তবুও দরজা খোলেনি। সুহৃদ একদিন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মাকে দেখে গীতাকে ডেকেছে দরজা খোলার জন্য। গীতা ওঠেনি। নিজে সে চেয়ার টেনে এনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলেছে নিজে। এটুকু সাহস করার জন্য সুহৃদের ওপর তাণ্ডব চলে কয়েকদিন। আমিও অনেকদিন বারান্দায় অপেক্ষা করে ফিরে এসেছি। যদি দরজা খোলে তবে বসতে বলে না, যদি নিজে বসিও, তবে খেতে ডাকে না, বাইরে থেকে খেয়ে আসি। শোবার জন্য বিছানা দেয় না। বৈঠক ঘরের সোফায় রাত কাটাই। এরকম যাওয়া কেবল সুহৃদের জন্য। অনেকবার ভেবেছি যাবো না, কিন্তু গেলে সুহৃদের যে ভাল লাগে, সুহৃদ যে জেনে সুখ পায় যে আমরা তাকে দেখতে গিয়েছি, সে কারণে যাই। সুহদকে আমার উপস্থিতির সুখ দেওয়ার জন্য গীতাকে নানা উপঢৌকনে ঢেকে যেন তাকে খুব ভালবাসি, তাকে (ছেলেমেয়েসহ) রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাই, থিয়েটারে নিয়ে যাই, উৎসবে মেলায়, দোকান পাটে, যেখানে গেলে তার ভাল লাগবে যাই, যেন তার মত এত হৃদয়বতী জগতে নেই বলেই তাকে এমন খাতির করছি। আসলে যে সবই সুহৃদের জন্য করি সে কথা গীতাকে বলি না। সুহৃদ যেন আমার সান্নিধ্য পায়, আমার সঙ্গ সুহৃদকে তার শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে খানিকটা প্রাণবায়ু দেয় সে কারণে যে করি, বলি না। গীতা বোঝে ঠিকই, আমিও বুঝি সে বোঝে। কিন্তু গীতা যা বোঝে, তা সে মনে মনেই রাখে, সুহৃদকে বুঝতে দিতে চায় না। অনেক দিন এমন হয়েছে যে টাকা ভর্তি ব্যাগটি সোফায় রেখে পেচ্ছ!বখানায় গেলাম, ফিরে এসে দেখি ব্যাগ পড়ে আছে, ভেতরে একটি টাকাও নেই। সোনার কানের দুল খুলে স্নান করতে গেলাম, ফিরে দেখি দুল নেই। গীতা যদি এসব নিয়ে নিজে খুশি থাকে, তবু সে খুশি হোক। তার মন খুশি থাকলে হয়ত সুহৃদকে কী করে কষ্ট দেওয়া যায় তার পরিকল্পনা আঁটা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। আমি হারানো জিনিসের জন্য কেবল মনে মনেই দুঃখ করি, অভিযোগ করি না। খাতির পরমাকেও করতে হয়, পরমাকে কোলে তুলে তার অসুন্দর মুখটিকেও আহা কী সুন্দর বলতে হয়, পরমাকে জিনিসপত্র দিলে গীতা খুশি হয় বলে দিতে হয়। গীতা খুশি হলে বসতে বলবে, গীতা বসতে বললে সুহৃদের সঙ্গে আমার দেখা হবে, দেখা না হলেও চোখাচোখি হবে, হয়ত সুহৃদ ফাঁক পেয়ে আমাকে একটু ছুঁয়ে যেতেও পারবে। এই স্পর্শটুকু সুহৃদের জন্য ভীষণ প্রয়োজন। গীতার মা ভাই বোন প্রায়ই যায় ছোটদার বাড়িতে। তাদেরও দেখেছি পরমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে আর সুহৃদকে গালাগাল করতে। গীতাকে খুশি করা গীতার আত্মীয়দের অর্থনৈতিক দায়িত্ব। একবার সুহৃদ পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল, গীতা কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না, আমিই সুহৃদকে নিয়ে যাই। ডাক্তার এক্সরে করে দেখলেন হাড় ভেঙেছে। হাত প্লাস্টার করে ব্যাণ্ডেজ করে গলায় ঝুলিয়ে দিলেন নব্বই ডিগ্রি কোণে, হাড় জোড়া লাগতে এক মাস লাগবে বলে দিলেন। সুহৃদ ডাক্তারখানা থেকে বাড়ি ফিরতেই গীতা টেনে সব প্লাস্টার আর ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলেছে। বলেছে, ‘হাতে কিছু হয় নাই। সব ওর শয়তানি।’
গীতার সব দুর্ব্যবহার সহ্য করি আর মনে মনে বলি আমাদের ওপর করুক তার যা ইচ্ছে তাই, তবু সুহৃদের ওপর যেন কোনও অত্যাচার না করে। সুহৃদ বোঝে সব। সুহৃদও গীতার নির্মমতা নিষ্ঠূরতা সহ্য করে, যেন আমাদের সঙ্গে কোনও দুর্ব্যবহার না করে গীতা। ছ বছর বয়স মাত্র সুহৃদের। সুহৃদ তার সমস্ত আবেগ সমস্ত স্বাভাবিক প্রকাশ সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে রেখে কৌশলী হয়ে ওঠে। সে প্রাণপণে তার মাকে খুশি করতে চায়, যেসব কথা বললে তার মা খুশি হবে, সেসব কথা বলে। নিজের মার কিঞ্চিৎ পরিমাণ সহানুভূতি পাবার জন্য এই টুকুন বাচ্চাকে অভিনয় করতে হয়।
বিমানের চাকরিতে বিদেশ ঘুরে ছোটদা সপ্তাহ দু সপ্তাহ পর ফেরেন। ছোটদা ফিরতেই গীতার নালিশ শুরু হয় সুহৃদের বিরুদ্ধে। সুহৃদ খারাপ, সুহৃদ বাজে, ইশকুল থেকে অভিযোগ করেছে, সুহৃদ কথা শোনে না, পরমাকে মেরেছে ইত্যাদি আরও নানা কিছু বানিয়ে বানিয়ে। গীতার সুখ হয় যখন ছোটদা সুহৃদকে ধমকান। ছোটদার কোলে গীতা পরমাকে বসিয়ে দেন, যেন তিনি আদর করেন পরমাকে। পরমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ গীতা। পরমা পড়ায় ভাল, ছড়ায় ভাল, চড়ায় ভাল, নড়ায় ভাল, মন ভরায় ভাল। পরমার এটা লাগবে, ওটা লাগবে। কেবল পরমাকে নিয়েই গীতার সব গল্প। ছোটদা লক্ষ্য করেন সুহৃদের ওপর অনাচার হচ্ছে। লক্ষ্য করেন ঠিকই, কিন্তু গীতার সমালোচনা করার কোনও সাহস তাঁর নেই। তিনি টাকা পয়সা যা কামান তার সবটাই গীতার হাতে তুলে দেন, গীতার প্রতিটি আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই তাঁর কাজ। গীতার ত্রাসের রাজত্যে সুহৃদ তো ভয়ে পাথর হয়ে থাকে, ছোটদাও তটস্থ। গীতা তার বিমান আপিসের ছোটখাটো রিসেপশনিস্টের চাকরিটি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। সম্পূর্ণই সে গৃহবধূ। কিন্তু গৃহবধূর জীবন সে যাপন করে না। জাঁকালো একটি জীবন তার, নিজে গাড়ি চালাচ্ছে, যেখানে খুশি সেখানে যাচ্ছে, টেনিস খেলতে যাচ্ছে, সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে যাচ্ছে। কোনও স্বনির্ভর সম্পন্ন মেয়ে যে স্বাধীনতার স্বপ্নও দেখতে পারে না, গীতা গৃহবধূ হয়েও তা অবাধে ভোগ করে। গীতার নির্ভয়তা, নিঃশঙ্কতা আমাকে বিমুগ্ধ করে, একই সঙ্গে তার অনুদারতা, তার ক্রূরতা, খলতা আমাকে বিচলিত করে।