গীতাকে নানা উপহারের উষ্ণতা দিয়ে গলিয়ে ওকে যদি সামান্য ক্ষণের জন্য দেখার অনুমতি পাই, আমাদের সামনে এসে ওর চোখ চিকচিক করে ওঠে খুশিতে। যে সুহৃদ প্রাণ খুলে হাসত, কাঁদত, যেমন ইচ্ছে তেমন চলতো, দৌড়োতো, কলকল করে কথা বলত —- সেই সুহৃদ এখন হাসতে পারে না, কাঁদতে পারে না, কথা মিনমিন করে বলে, প্রায় শব্দহীন স্বর, শঙ্কিত পদক্ষেপ, নিস্প্রভ, নিরুত্তেজ। একটি কথাই ও দ্রুত বলতে আসে, থাকো, যাইও না। হাতে যদি ট্রেনের টিকিট দেখে চলে যাবার, মুহূর্তে ওর চোখ জলে উপচে পড়ে, টিকিট কেড়ে নিতে চায়। ও বাড়িতে থাকব, ওর সঙ্গে দেখা হবে না, ও ঘরবন্দি থাকবে, তারপরও ওর স্বস্তি হয় যে আছি, বাড়ির কোনও না কোনও ঘরে আছি। সুহৃদের সারা মুখে ভয়, চোখদুটিতে ভয়। গীতার ভয়ে সে পাথর হয়ে থাকে। যে ছেলেটি বেলায় বেলায় খেতো, খেতে না চাইলেও গল্প বলে বলে নানা কৌশলে যাকে খাওয়ানো হত, সেই ছেলে ক্ষিধেয় মরে গেলেও কিছু খেতে পাওয়ার অনুমতি পায় না। টেবিলের ওপর খাবার পড়ে থাকলে আর যারই ছোঁবার অধিকার থাক, সুহৃদের নেই। রেফ্রিজারেটরেও হাত দেবার কোনও অধিকার ওর নেই। গীতা যখন ওকে খেতে দেবে, তখনই ও খেতে পাবে। সেই খাওয়া অতি অখাদ্য খাওয়া। পচা পুরোনো বাসি খাবার। নাদুস নুদুস ছেলে শুকিয়ে কাঁটা হয়ে গেছে। ছোটদা থাকলে বাড়ির সবাইকে ডেকে নিয়ে খেতে বসেন টেবিলে। তাঁকে দেখিয়ে সুহৃদের পাতে গীতাকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও মাংসের টুকরো দিতে হয়। বাইরের লোকের সামনেও গীতা দেখাতে চায় নিজের ছেলেকে সে ভালবাসে, কিন্তু কারও বুঝতে খুব বেশি দেরি হয় না তার সুচতুর চরিত্র। গীতা তার স্বার্থের জন্য নিজের হিংস্র রূপটি যথাসম্ভব ঢেকে রেখে আহ্লাদি গলায় কথা বলে যে কোনও কাউকে গলিয়ে মজিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারে, এমনই সে পাকা। কিন্তু শেষ অবদি কারও সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব টেকে না দীর্ঘ দিন। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে গীতা হাওয়া।
তারপরও আমরা যাই নয়াপল্টনে। না গিয়ে পারি না। সুহৃদকে একবার চোখের দেখা দেখতে যাই। মা সুহৃদের জন্য ডজন ডজন মুরগি নিয়ে, নানারকম ফলমূল নিয়ে যান ঢাকায়। মার হাত থেকে জিনিসপত্র নিয়ে গীতা গোপনে রেখে দেয়। সুহৃদকে জানতেও দেয় না মা তার জন্য অনেক খাবার এনেছেন। আমি আগে যেমন মাইনে পেলেই সুহৃদকে নিয়ে যেতাম দোকানে, সুহৃদ যত খেলনাই পছন্দ করত, কিনে দিতাম। এখনও হাতে টাকা এলেই সুহৃদের জন্য জামা কাপড় আর তার পছন্দের খেলনা কিনে ঢাকা নিয়ে যাই, গীতা আমার হাত থেকে সব নিয়ে আলমারিতে রেখে দেয়। সুহৃদকে জানানো হয় না, কিছু দেওয়াও হয় না। সব দেওয়া হয় পরমাকে। পরমাকে পরম আদরে মানুষ করছে গীতা। সুহৃদ অবকাশে যে আদর পেত, সেই আদর গীতা পরমাকে দিচ্ছে। পরমা তার বড় ভাইকে গাল দেবার ঘুসি দেবার লাথি দেবার সব রকম অধিকার রাখে, সুহৃদকে পিঠ পেতে কান পেতে সব বরণ করতে হয়। এক বাড়িতে দুই সহোদর ভাই বোন দু রকম ভাবে মানুষ হচ্ছে। যে সুহৃদ নিজে কখনও গোসল করেনি, মা তাকে কুসুম গরম জলে সাবান মেখে তাকে গোসল করিয়ে ঘরে এনে সারা গায়ে জলপাই তেল মেখে চুল আঁচড়ে দিতেন সিঁথি করে, সেই সুহৃদকে এখন একা গোসল করতে হয়, নিজে সে সাবান মাখতে পারে না, শ্যাম্পু করতে পারে না, গায়ে কোনওরকম জল ঢেলে চলে আসে। ২৫ পরমাকে নিজে হাতে গীতা গোসল করিয়ে আনে। পরমার জন্য ভাল জামা কাপড়, ভাল জুতো, ভাল খেলনা। সুহৃদর জন্য যা কিছু সব পুরোনো, সব মলিন। সুহৃদের জন্য একটি শক্ত তোশকের ছোট বিছানা। পরমার জন্য নরম গদির পালংক। পরমার গালে চুমু, সুহৃদের গালে চড়। পরমার গায়ে বেবী লোশন মেখে চুল আঁচড়ে দিতে দিতে গীতা বলছে, কি গো রাজকন্যা, তোমাকে একটু আঙুর দেই।
না।
প্লিজ একটু খাও।
না।
তুমি আমার মা, মা গো, একটু খাও।
পরমা মাথা নাড়ে, সে খেতে রাজি।
পরমা রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, গীতা হাঁক দিল, এই সুহৃদ, পরমারে আঙুর আইন্যা দে।
সুহৃদ দৌড়ে তার মার আদেশ পালন করে।
সুহৃদ আবদার করে, আমিও একটু আঙুর খাই?
গীতা ধমকে ওঠে, না।
পরমা জুতো পরবে। গীতা হাঁক দেয়, সুহৃদ জুতা নিয়া আয়।
সুহৃদ জুতো নিয়ে এল। কিন্তু একটি ধুম শব্দের কিল উপহার পেল।
জুতা মুইছ্যা নিয়া আয়।
ধুলো মুছে নিয়ে এল সুহৃদ।
যা, পরমার পায়ে পরাইয়া দে জুতা।
সুহৃদ জুতো পরাতে পরাতে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলে, ‘আমি কি ওর চাকর?’ গীতা ছুটে এসে নিজের পায়ের জুতো খুলে সেই জুতো দিয়ে সুহৃদের পিঠে সজোরে আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘হ তুই ওর চাকর। অন্যদিন তো পরাস জুতা, আইজকা মুখ দিয়া কথা বাইর হয় কেন? আইজকা তর সাহস বাড়ল কেমনে? কারে দেইখা সাহস বাড়ছে? মনে করছস কেউ তরে বাঁচাইতে পারবো আমার হাত থেইকা?’
আমার চোখের সামনে ঘটে এগুলো। আমার আর সয় না। বেরিয়ে যাই ঘর থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা কাঁদি। আমরা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। কোনও মা কি পারে এরকম ব্যবহার করতে নিজের সন্তানের সঙ্গে? সৎ মায়ের নির্মমতার অনেক গল্প শুনেছি। সব গল্পই হার মানে গীতার কাছে। মা বলেন, ‘গু ফালায় নাই মুত ফালায় নাই, হাঁটা শিখায় নাই, কথা শিখায় নাই, ছয় বছর পরে একটা তৈরি ছেলে পাইছে, ছেলের জন্য কোনও টান নাই।’ তাই বা কেন হবে, ভাবি। হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে পঁচিশ বছর পর ফিরে পেলেও তো মায়ের আদর মরে যায় না।