এমন যখন মন, তখন প্রায় বিকেলের পাট চুকিয়ে প্রতি বিকেলে শামসুল হুদা আসেন আমাকে পড়াতে। হুদার মুখটি কালো ফটকের ধারে কাছে দেখলেই আমার হৃদকম্প শুরু হয়। চমৎকার বিকেল জুড়ে এখন অঙ্ক কর, পদার্থ বিদ্যা ঘাঁটো, রসায়নের পুকুরে হাবুডুবু খাও। ইয়াসমিনকে পড়াতে যখন রবীন্দ্রনাথ দাস আসেন, আমার একরকম আনন্দই হয়। রবীন্দ্রনাথ ইয়াসমিনকে পড়ান পনেরো মিনিট, গল্প করেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট। গল্প একা ইয়াসমিনের সঙ্গে করেন না, আমার সঙ্গেও। টাঙ্গাইলের কালিগঞ্জ গ্রামে তাঁর কন্যা কৃষ্ণা বড় হচ্ছে, পুত্র গৌতম বড় হচ্ছে। তিনি ময়মনসিংহ শহরের ছোট বাজারে থাকা খাওয়ার বিনিময়ে নির্মল বসাকের ছেলে গোবিন্দ বসাককে পড়ান। নিজে তিনি শহরতলির এক প্রাইমারি ইশকুলের প্রধান শিক্ষক। প্রধান শিক্ষকের চাকরি করে শহরে টিউশনি করে কালে ভদ্রে তিনি সময় পান দেশের বাড়ি যেতে। ওই কালে ভদ্রেই তিনি খরচার টাকা দিয়ে আসেন বাড়িতে, পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন থেকেও আসেন। যতদিন শহরে থাকেন, স্ত্রী পুত্র কন্যার কথাই নিরবধি ভাবেন। আমাদের পাশে বসিয়ে প্রতিদিনই পুত্র কন্যার গল্প করেন, শুনতে শুনতে আমাদের জানা হয়ে যায় কৃষ্ণা দেখতে কেমন, কৃষ্ণা কি খেতে, কি করতে, কি পরতে পছন্দ করে। গৌতম ফুটবল পছন্দ করে নাকি ক্রিকেট, পরীক্ষায় কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছে, সব। অবশ্য হঠাৎ বাবা বাড়ি ঢুকলে আমি সরে আসি, রবীন্দ্রনাথ দাসও সচকিত হয়ে বইয়ে মাথা গোঁজেন। ইয়াসমিনের মাথার ঘিলুর পরিমাণ বাবা যখন জানতে চান, দাস মশাই সহাস্য বদনে যা বলেন তা হল, ঘিলু সাধারণের চেয়ে অধিক, তবে পড়াশোনায় মনোযোগটিই সাধারণের চেয়ে স্বল্প। বাবা বলেন, মারবেন। না মারলে ঠিক হবে না। বাবা নিজের হাতে তোশকের তল থেকে এনে দাসমশাইএর হাতে সন্ধি বেত দিয়ে যান। আমার গৃহশিক্ষককেও হাতের কাছে পেলে বলেন, আমাকে যেন পিটিয়ে লম্বা করেন। বাবার এই মত, না পেটালে ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না। বাবার উপযর্পু রি অনুরোধের কারণে সম্ভবত শামসুল হুদা আমার পিঠে শক্ত শক্ত চড় কষাতে দ্বিধা করেন না। শামসুল হুদা শিক্ষক হিসেবে ভাল, বিদ্যাময়ী ইশকুলের অংকের শিক্ষক তিনি। বাড়িতে আমাকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ান। বাকি বিষয়গুলোর জন্য বিদ্যাময়ীর দুই শিক্ষক জ্ঞানেন্দ্রমোহন বিশ্বাস আর প্রদীপ কুমার পালকে রাখা হয়েছে। প্রদীপ কুমার পালের বাঁ হাতে পাঁচটির জায়গায় ছ টি আঙুল। তাঁর সামনে বসে পড়তে গেলে বইখাতা থেকে বারবারই আমার চোখ চলে যায় ওই বাড়তি আঙুলটিতে। তিনি আবার কবিতা লেখেন, প্রতিদিনই পড়া শেষে আমার একটি কবিতা শোনো বলে শার্টের বুক পকেট থেকে কবিতা লেখা কাগজ বের করে পড়ে কবিতা কেমন লাগল না লাগল জিজ্ঞেস না করে হঠাৎ উঠে চলে যান। গৃহশিক্ষক হিসেবে জ্ঞানেন্দ্রমোহন অবকাশে টিকে গেলেও প্রদীপ কুমার টেকেন না। যে শিক্ষক আমাকে যথেষ্ট কিল চড় ঘুসি লাগাচ্ছেন না, সেই শিক্ষক, বাবার ধারণা, শিক্ষক হিসেবে ভাল নন। শিক্ষক নিয়োগ করতে বাবার যেমন অল্প সময় লাগে, শিক্ষক বিদেয় করতেও। পঞ্চম শ্রেণীতে তিন বিষয়ে লাল দাগ পাওয়ার পর ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠা যখন সম্ভব হয়নি ইয়াসমিনের, বাবা নিজে ওকে পড়াতে শুরু করেন। ইয়াসমিন ইশকুল থেকে ফিরে আরোগ্য বিতানে চলে যায় বই খাতা নিয়ে। ওখানে বসেই ও দেখে বেতন আনতে বাবার কাছে গৃহশিক্ষকদের ধর্না দেওয়া। বাবা ওঁদের দুতিনঘন্টা খামোকা বসিয়ে রেখে কুড়ি টাকা পঁচিশ টাকা হাতে দেন। মাসের বেতন পঞ্চাশ টাকা, সেটি বাবার কাছ থেকে কোনও গৃহশিক্ষকের পক্ষেই একবারে পাওয়া সম্ভব হয় না। সবসময় তিন চার মাসের টাকা বাকি রাখতে পছন্দ করেন বাবা। শুনে আমার লজ্জা হয় খুব, আমি আমার লজ্জা নিয়ে নুয়ে থাকি। বাবার বরাবরই বড় উন্নত শির, তিলার্ধ লজ্জারও তাকত নেই তাঁর তকতকে তল্লাট তিলমাত্র তছনছ করে। তিনি প্রায়ই আমাকে জানিয়ে দিচ্ছেন, পরীক্ষায় পাঁচটি লেটার নিয়ে তারকাখচিত নম্বর না পেয়ে পাশ না করলে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন। সারা জীবন আমাকে রাস্তায় রাস্তায় ফুটো থালা হাতে নিয়ে ভিক্ষে করতে হবে।
মেট্রিক পরীক্ষা হাতের নাগালে তো বটেই, একেবারে নাকের ডগায় যখন এসে বসে, আমার আর উপায় থাকে না স্থির হওয়া ছাড়া। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো ঘন্টা আমি পড়ার টেবিলে। হঠাৎই আমি বাড়ির বহুমূল্যবান মানুষ হয়ে উঠি। হাঁটতে গেলে সবাই সরে দাঁড়িয়ে জায়গা দেয়, পেচ্ছাব পায়খানায় গেলে মা নিজে বদনি ভরে পানি রেখে আসেন। গোসল করার আগেও বালতিতে পানি তোলার কথা বলতে হয় না, তোলাই থাকে। রাত জেগে পড়া তৈরি করতে হচ্ছে, ভাল ভাল খাবার রান্না হচ্ছে আমার জন্য। মা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। ফল মূল নিয়ে একটু পর পর বাড়ি আসছেন বাবা, পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে পিন পতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করে দিন রাত। বাড়ির লোকেরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে, যেন কোনও শব্দ আমার মগ্নতা নষ্ট না করে। পাড়ায় পুজোর গান শুরু হলে বাবা নিজে গিয়ে পুজো কমিটির চেয়ারম্যানকে বলে আসেন, গান যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে, মেয়ের মেট্রিক পরীক্ষা। মেট্রিক পরীক্ষার মূল্য বুঝে দিলীপ ভৌমিকও পুজোর গান বন্ধ করে দেন। নিতান্তই বাজাতে হলে উল্টোদিকে মাইক ঘুরিয়ে বাজান। আমার টেবিলে খোলা বই খোলা খাতার পাশে খোলা বিস্কুটের কৌটো, পড়তে পড়তে ক্ষিধে লাগলেই যেন খাই। মা গরম দধু দিয়ে যান দুবেলা, বলেন, দধু খেলে ব্রেন ভাল থাকে, পড়া মনে থাকে। এ বাড়ির একটি মেয়ে মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে, এর চেয়ে বড় খবর, এর চেয়ে জরুরি খবর কিছু নেই আর। দিন যত কাছে আসে তত মনে হয় আজরাইল আসছে জান কবচ করতে। আমার বুক কাঁপে। গা হাত পা কাঁপে। রাত দুটো তিনটেয় আমাকে ঘুম থেকে তুলে বাবা বলেন, চোক্ষে পানি দিয়া পড়তে বস। আমি চোখে পানি ছিটিয়ে বসি। বাবা বলেন,পানিতে কাম না হইলে সরিষার তেল দেও।