চিত্রালীতে লেখা ছাপা হওয়ার পর থেকে আমার নামে অবকাশের ঠিকানায় বেশ কয়েকটি চিঠি আসে, পত্রমিতালির আবেদন দেশের বিভিন্ন শহর থেকে। এমন কখনও ঘটেনি, ডাকে কোনও চিঠি আমার জন্য আসেনি আত্মীয় স্বজনের বাইরের কারও, কোনও অচেনা কারও। চিঠি পেয়ে রীতিমত উত্তেজিত আমি। পত্রমিতালি ব্যাপারটি অভিনব একটি ব্যাপার, কেবল চিঠিতে দূরের মানুষদের চেনা, চিনতে চিনতে বন্ধ-ু মত আত্মীয়মত হয়ে যাওয়া। ঢাকা থেকে জুয়েল, সিলেট থেকে সাব্বির, চট্টগ্রাম থেকে শান্তন-ু – পত্রমিতা হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিই। মেয়েরা ছেলেরা চমৎকার বন্ধু হতে পারে এই বিশ্বাসটি আমার মনে একটু একটু করে বাসা বাধঁ তে থাকে। আত্মীয়তার বাইরে সম্পর্কের যে ব্যাপারটি আমি দেখেছি, তা প্রেম, ছোটদা আর দাদার জীবনে হয়েছে, রুনুখালা রুনুখালার জীবনেও। প্রেমের উদ্দেশ্য একটিই, বিয়ে। দাদার পক্ষে শীলাকে সম্ভব হয়নি, ছোটদা সম্ভব করে ছেড়েছেন। এর বাইরে ছেলে মেয়েতে কোনও রকম সম্পর্ক আমি আমার চেনা কারও মধ্যে দেখিনি। নাটক উপন্যাসে থাকে, সিনেমার গল্পে থাকে। আমি যে জগতে বাস করি, সে জগতে এর কোনও স্থান নেই। কিন্তু আমার কাছে আসা চিঠিগুলোই এই প্রথম অন্যরকম কিছু ঘটিয়ে ফেলে। পর পুরুষের চিঠি কিন্তু কোনও প্রেমের চিঠি নয়, কারও সঙ্গে আমার কোনও বিয়ের কথা হচ্ছে না, কিন্তু চিঠি। ডাকে আসা পত্রমিতাদের চিঠি বাড়িতে অনেকটা দল বেঁধে পড়া হয়। ডাকপিয়ন যার হাতে চিঠি দিয়ে যায়, সে ই পড়ে প্রথম। তারপর যার চিঠি তাকে দিতে গিয়ে চিঠির কথাগুলোও বলে দেয়, যে দেয়। জুয়েলের একটি চিঠি এল, ইয়াসমিন খামখোলা চিঠিটি আমার হাতে দিতে দিতে বলল, জুয়েল জানতে চাইছে তোমার কার গান পছন্দ, হেমন্তর না কি মান্না দের। সাব্বির পাতার পর পাতা ধর্মের কথা লেখে, ছোট ছোট ধমর্পু স্তিকাও উপহার পাঠায়, তার চিঠি এল তো ছোটদা আমার পড়ার আগে সে চিঠি পড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দেন, যা পড়, মুন্সি বেডার চিডি পড়। চিঠি ব্যাপারটি যে ব্যক্তিগত, তা আমার তখনও বোঝা হয়নি। পত্রমিতালির ব্যাপারটি চন্দনাকে সংক্রামিত করেছে পরে, দাদাকেও। দাদা ঢাকার এক মেয়ে সুলতানার সঙ্গে পত্রমিতালি শুরু করলেন হঠাৎ। অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখা সুলতানার। চিঠি এলে দাদা আমাদের সবাইকে ডেকে সুলতানার হাতের লেখা দেখান। কেবল দেখান না, আমাদের সামনে বসিয়ে চিঠি পড়ে শোনান। পড়ে চিঠির উপর হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, মেয়েডা নিশ্চয়ই দেখতে খুব সুন্দরী। দাদার বিশ্বাস যার হাতের লেখা এত সুন্দর, যার চিঠির ভাষা এমন কাব্যময়, সে প্যারাগন অব বিউটি না হয়েই যায় না।
চন্দনা চিত্রালী আর পূর্বাণীর বাইরে আরও একটি পত্রিকা পড়তে শুরু করেছে, বিচিত্রা। বিচিত্রার পাঠকের পাতায় ওর একটি লেখাও ছাপা হয়েছে। পুলিশবাহিনীতে মহিলা নেওয়ার খবর শুনে চন্দনা মহিলা পুলিশের পোশাকের একটি প্রস্তাব দিয়েছে, বোরখা, বোরখার তলে থাকলে ধমর্ও থাকল আর চোর ছ্যাঁচড়ের কাজ কর্ম চোখের ফুটো দিয়ে দেখাও গেল, পথচারি কারও পুলিশ বলে সন্দেহও হবে না। বিচিত্রা আবার ওর লেখাটির সঙ্গে এক বোরখাওয়ালির কার্টুন এঁকে দিয়েছে। ইশকুলে যাওয়ার রিক্সাভাড়া থেকে চার আনা ছ আনা বাঁচিয়ে চিত্রালী পূর্বাণী কিনি, বিচিত্রা কেনার পয়সা জোটানো সবসময় সম্ভব হয় না। দাদার কাছে হাত পেতে রাখি। পাতা হাত দেখতে দাদার আনন্দ হয়, কদাচিৎ ফেলেন ওতে কিছু ও দিয়েই নেশাখোরের মত বিচিত্রা কিনে নিই। কিনে নেওয়া মানে ইয়াসমিনকে নয়ত জরির মাকে কালো ফটকের কাছে দাঁড় করিয়ে অথবা নিজেই দাঁড়িয়ে হকার দেখলেই ডেকে কেনা। হকার না এলে ইয়াসমিনকে গাঙ্গিনারপাড় মোড়ে পাঠিয়ে কিনে আনি। ডাঙ্গর হয়েছি বলে রাস্তায় একা হাঁটা আমার বারণ। ইয়াসমিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা এখনও জারি হয়নি, তাই দুঃসময়ে ওরই ওপর ভরসা করতে হয় আমার। পত্রিকা কেনার খরচই তো শুধু নয়, পত্রিকার জন্য লেখা আর পত্রমিতাদের চিঠির উত্তর পাঠাতেও খরচা আছে। ছোটদার হাতে চিঠি দিলে ডাকটিকিটের পয়সাও গুনে গুনে দিতে হয়। দাদার মেজাজ বিগড়ে থাকলে অগত্যা শিশিবোতলকাগজ। অবকাশের গা ঘেঁসে তিনটি রাস্তা চলে গেছে তিন দিকে, একটি গোলপুকুরপাড়ের দিকে, আরেকটি দগুর্াবাড়ির দিকে, আরেকটি গেছে সেরপুকুর পাড়ের দিকে। এই তিন রাস্তায় সকাল থেকে শুরু করে সারাদিনই সুর করে ফেরিঅলা হেঁকে যায়। শাড়িকাপড়অলা, বাদামঅলা, চানাচুরঅলা, আচারঅলা, চুরিফিতাঅলা, আইসক্রিমঅলা, হাওয়াই মিঠাইঅলা, শাকসবজিঅলা, ঘিঅলা, মুরগিঅলা, কবুতরঅলা, হাঁসঅলা, কটকটিঅলা, মুড়িঅলা, শিশিবোতলকাগজঅলা। শিশি-বোতল-কাগজ ডাকটি শুনলেই হাতের কাছে যে ই থাকে পাঠাই দৌড়ে ধরতে ব্যাটাকে। ব্যাটার মাথায় থাকে বড় ঝাঁকা। মাথা থেকে ঝাঁকা নামানোর আগে দরাদরি চলে, কত? পত্রিকা তিন টাকা সের, বইখাতা দুইটাকা। কি কন তিন টাকা! চাইর টাকা কইরা নিলে কন। চাইর টাকা বেশি হইয়া যায়, সাড়ে তিন টাকাই দিয়েন। পাল্লা পাত্থর ঠিক আছে? দেইখা লইয়েন। ঝাঁকা নামিয়ে শিশিবোতলকাগজঅলা বারান্দায় বসলে শোবার ঘরের খাটের তলে রাখা পুরোনো পত্রিকা মায়া কাটিয়ে নিয়ে এসে সামনে দিই। খুঁজে খুঁজে পুরোনো বইখাতাও নিয়ে আসি। বিক্রি করে দশ পনেরো টাকা হয়। দশপনেরোটাকাই নিজেকে রাজা বাদশাহ মনে করার শক্তি যোগায়। ছোটদাও বিক্রি করেন পত্রিকা, মাও করেন পুরোনো শিশিবোতল জমিয়ে রেখে, উঠোন ঝাঁট দিতে গিয়ে পাওয়া ছেঁড়া কাগজের টুকরোও ধুলো ঝেড়ে জমা করে রেখে। ভাঙা শিশি আর ছেঁড়া কাগজ থেকে যে দপু য়সা আয় করেন মা, তা তোশকের তলে রাখেন, অথবা আঁচলের কোণায় বেঁধে যা আমার ছোটদার আর ইয়াসমিনের বিষম হাহাকার থামাতে কোনও এক সময় কাজে লাগে। চন্দনাকে দারিদ্র এমন কষাঘাত করে না, পণ্ডিতপাড়ার একটি সবুজ টিনের ভাড়া বাড়িতে থেকেও চন্দনা দিব্যি পত্রিকার টাকা জুটিয়ে নেয় প্রতি সপ্তাহে। চন্দনা পুরুষভরা টাউনহল প্রাঙ্গনে না যেতে পারুক, কিন্তু বিস্ময়কর কাণ্ডও হঠাৎ হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলতে পারে, খুব ভোরবেলা কাকপক্ষী জাগার আগে ও একদিন চলে এল অবকাশে ছোট ভাই সাজুর সাইকেল চালিয়ে। চন্দনাকে দেখে আমার হৃদয়ে খুশি উথলে ওঠে। বাড়ির সবাই হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে হাঁ হয়ে চন্দনার দিকে তাকিয়ে রইল। কত বড় দুঃসাহসী হলে মেয়ে হয়ে সাইকেল নিয়ে শহরের রাস্তায় বের হতে পারে, সে ভোর হোক কি শুনশান মধ্যরাত হোক—তা অনুমান করে সবাই বিমূঢ় বিস্মিত। চন্দনাকে ভেতরঘরে বসিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে চালের রুটি আর মাংস গরম করে এনে মা ওকে পাশে বসিয়ে খাওয়ালেন। নাকে মুখে গুঁজে চন্দনাকে অবশ্য দৌড়োতে হল, রাস্তায় লোক বের হওয়ার আগেই বাড়ি পোঁছতে হবে ওকে। চন্দনা যখন সাইকেলে চড়ে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় চুল উড়িয়ে চলে যাচ্ছিল, কালো ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে আমি মুগ্ধ তাকিয়ে ছিলাম। পৃথিবীতে ওই দৃশ্যের চেয়ে চমৎকার আর কোনও দৃশ্য আমার দেখা হয়নি। যেন সাইকেলে চুল উড়িয়ে চলে যাওয়া মেয়েটি চন্দনা নয়, আমি। আমার ইচ্ছে করে চন্দনার মত সাহসে ভর করে সারা শহর ঘুরে বেড়াতে সাইকেলে।