রাহাত খানের গল্প শুনতে আমি যত আগ্রহী, মা তত নন। বই পড়া মেয়ের কাছে লেখক মানে বিশাল কিছু না ছুঁতে পারা আকাশ। যাঁরা বই লেখেন, তাঁরা যে আর সবার মত মানুষ, তাঁরা যে আর মানুষের মত পেচ্ছাব পায়খানা করেন, তাঁদের নাকেও যে মাঝে মধ্যে সর্দি জমে, ছিৎ করলে থিকথিকে মোটা হলদে সর্দিও যে তাঁদের নাকের ফুটো দিয়ে কখনও বেরোতে পারে, তা আমার বিশ্বাস হয় না। সিনেমার লোকদের বেলাতেও আমার একই বিশ্বাস। তাঁরা সুন্দর-শোভন জীবন যাপন করেন, ঝলমলে জগতে বাস করেন, ঝকঝকে গাড়িতে চড়েন, চোখ ঝলসানো জামা কাপড় পরেন, রাজা বাদশাহর মত তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আপেল আঙুর খান, তুলো-নরম বিছানায় ঘুমোন, গা থেকে ঘামের গন্ধ তো দূরের কথা, গায়ের গন্ধও নয়, বেরোয় গোলাপের সুঘ্রাণ, কখনও কোনও কাজে একবিন্দু ভুল করেন না, মিথ্যে বলেন না, কাউকে কষ্ট দেন না। অতিমানব যাকে বলে। বইয়ের যেমন পোকা আমি, সিনেমারও। চন্দনারও একই হাল। দাদাকে অনুরোধ আবদার করে সিনেমায় যেতে রাজি করিয়ে যাওয়ার পথে চন্দনাকেও উঠিয়ে নিই। হুজ্জত হাঙ্গামা করে মাঝে সাঝে সিনেমা দেখাবার ব্যবস্থা দাদা করেন বটে, কিন্তু ঘরে বসে সিনেমা পত্রিকার দেখা পাওয়া ছোটদার কারণেই আমার প্রথম হয়। ছোটদা পড়াশোনায় মন না বসা টই টই করে শহর ঘুরে বেড়ানো সাত কাজের কাজি অকাল-বিবাহিত তরুণ, প্রতি সপ্তাহে দুপুরের পর হাতে করে চিত্রালী নিয়ে আসেন বাড়িতে অবসরে তাঁর চিত্ত বিনোদনের তাগিদে। ছোটদার বিত্ত নেই কিন্তু চিত্ত আছে। ছোটদার চিত্তের বিনোদন সাঙ্গ হলেই আমার ঔৎসুক্য লম্ফ দিয়ে ওঠে। কি আছে লেখা ওই ছবিঅলা কাগজে? কোথাও কোনও মুদ্রিত অমুদ্রিত শব্দ দেখামাত্র পড়ে ফেলা মেয়ে আমি। ইশকুলে যাওয়ার পথে ছেলেছোকড়া না থাকলে সহস্রবার পড়া সাইনবোর্ড আবারও নতুন করে পড়তে পড়তে যাই। বাদাম কিনে বাদাম খেতে খেতে বাদামের ঠোঙার লেখা পড়ে ফেলি। তেঁতুলের আচার কিনলেও সে আচার চেটে খেয়ে আচারের তেলের তলে আবছা লেখাও উদ্ধার করে ছাড়ি। এমন যে পড়ুয়া, সে কেন চিত্রালী বলে চিত্ত বিনোদনের কাগজটি ফেলে রাখবে!ছোটদার সেই চিত্রালীতে চোখ বুলোতে বুলোতে অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায় চোখ বুলোনো। অভ্যেস গড়াতে গড়াতে নেশায় গিয়ে নামে। অথবা ওঠে কে জানে! ছোটদা যদি চিত্রালী কেনায় অনিয়ম করেন, তবে আর কী! ইশকুলের রিক্সাভাড়া বাঁচিয়ে চিত্রালী কেনো, প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা অবদি পড়ে ফেলো যা লেখা, নায়ক নায়িকার বাড়ির গাড়ির হাঁড়ির, প্রেমপ্রণয়বিরহের খবর সব নখদর্পণে নিয়ে রাতে ঘুমোতে যাও, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখো কোনও এক নায়কের সঙ্গে ঝিকমিক জ্যোৎস্নায় ঝিলমিল করা ঝিলের ধারে ঝিরঝিরে হাওয়ায় তোমার দেখা হচ্ছে, সেই নায়ক তোমার উদ্দেশে নেচে নেচে গান গাইছে, গাছপালাআকাশবাতাসঝিলেরজলচাঁদেরআলো সবকিছুকে সাক্ষী রেখে বলছে যে তোমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। শুক্রবার চিত্রালী হাতে না পেলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না, মা অন্তত তাই বলেন। হজম নিয়ে আমি মোটেও উদ্বিগ্ন নই, তবে ভাত খাচ্ছি, চিত্রালী এল বাড়িতে, ব্যস ভাতের থালা ঠেলে উঠে গেলাম নয়ত এক হাত চিত্রালীতে, আরেক হাত ভাতে, ভাতের হাত অচল হতে থাকে, চিত্রালীর হাত সচল। চিত্রালী আমার ক্ষিধে কেন বাপ মা ভুলিয়ে দেওয়ার মত শক্তি রাখে। এমন শুরু হয়েছে চিত্রালীর পাঠকের পাতায় আমার একটি লেখা ছাপা হওয়ার পর। এমনি একটি লেখা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্নরকণ্ঠী সাবিনা কেন অবহেলিত, সাবিনার কণ্ঠে মাধুর্য, রুনার কণ্ঠ কর্কশ ইত্যাদি। ওই আমার প্রথম কিছু ছাপা হওয়া কোনও পত্রিকায়। লেখা পাঠানোর আগে ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যদি চিত্রালীতে লেখা পাঠাই, তবে কি ছাপবে ওরা! ছোটদা দুব্বোকা বলে আমাকে সরিয়ে দিয়ে বলেছেন যে চিত্রালীতে দিনে পাঁচ হাজার চিঠি পৌঁছয়, পাঁচ হাজারের মধ্যে চার হাজার বিরানব্বইটি চিঠি ওরা পড়া তো দূরের কথা, খোলেই না, ছুঁড়ে দেয় ময়লা ফেলার বাক্সে, আমি যদি কোনও চিঠি পাঠাই তা সোজা ওই ময়লার বাক্সেই যাবে। ছোটদা যদিও ঝাড়বাতি এক ফৎু কারে নিবিয়ে আমার আশার ঘরে হতাশার বস্তা বস্তা বালু ঢেলে দিয়েছেন, তবু আমি গোপনে লেখাটি পাঠিয়েছিলাম চিত্রালীর ঠিকানায়, ভাগ্য পরীক্ষা করা অনেকটা। দিব্যি পরের সপ্তাহে ছাপা হয়ে গেল, লেখাটির পাশে সাবিনা ইয়াসমিন আর রুনা লায়লার ছবি বসিয়ে। বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেল, হিপ হিপ হুররের তোড়ে ভাসতে থাকি। আমার নামখানি পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে, অবিশ্বাস্য কাণ্ড বটে। ছোটদা কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে থেকে তোতলালেন, বাহ ত-তর লে-লেখা ছাপা হইয়া গে-গেল! যেন আমি সাংঘাতিক অসম্ভব কিছু সম্ভব করে ফেলেছি! আমার ঠোঁটে সারাক্ষণই রাজ্য জয় করার হাসি মিছরির গায়ের লাল পিপঁড়ের মত লেগে থাকে। বাবাকে বাদ দিয়ে পত্রিকাটি সবার চোখের সামনে একাধিকবার উঁচু করি, এমনকি জরির মার চোখের সামনেও। জরির মা অবাক হয়ে পত্রিকাটির দিকে তাকিয়ে বলে, এইডারে ত ঠোঙ্গার কাগজের মতই দেহা যায়। অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর আরও একটি ঘটনা ঘটে, এটিও অবিশ্বাস্য। পরের সপ্তাহে দেখি আমার লেখার প্রশংসা করে এবং আপত্তি জানিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা চিত্রালীতে ছাপা হয়েছে। আমার উৎসাহ তখন ভাত ফোটার মত টগবগ করে ফোটে। এরপর পাঠকের পাতায় তো বটেই চিঠিপত্র বিভাগেও লেখা পাঠানো শুরু করি। চিত্রালীর ধাঁচে শরীর সাজিয়ে পূর্বাণী নামের নতুন একটি পত্রিকা উঁকি দিচ্ছে শিল্প-সাহিত্য-বিনোদনের জগতে। পূর্বাণীকে হেলা করব, এমন হৃদয়হীন আমি নই। চিত্রালী পূর্বাণী, এ দুটো পত্রিকা প্রতি সপ্তাহে আমার না হলেই নয়। চিত্রালী বা পূর্বাণীতে আমার লেখা থাকলে ঠোঁটে চিকন হাসি ঝুলিয়ে ছোটদা প্রতি সপ্তাহে বলেন হ হইছে ছাপা, আর না থাকলে কি রে তর লেখা ত ছাপল না! চন্দনাকে এই জগতটিতে টেনে নামাতে হয় না, আড়ম্বর দেখে ও নিজেই নামে। আমি যত না লিখি, আমাকে নিয়ে লোকে তার চেয়ে বেশি লেখে। রীতিমত আসরের অন্যতম একজন হয়ে উঠি। চিত্রালীতে চিঠির উত্তর যিনি দেন, যাঁকে সবাই উত্তরদা বলে ডাকে, রসের কলসে চুবিয়ে তাঁর উত্তর তোলেন। লিখতে লিখতে সেই কোনওদিন দেখা না হওয়া উত্তরদাকে আমার আপন দাদার মত মনে হতে থাকে। ইয়াসমিনের সঙ্গে পেনসিল নিয়ে ছোটখাট একটি চুলোচুলির যুদ্ধ হয়ে গেল, সবার আগে উত্তরদাকে চিঠি লিখে জানাই আজ আমার মন ভাল নেই। মনে ফুর্তি হলেও তাঁকে জানানো চাই সবার আগে। গোলপুকুর পাড়ের আড্ডা থেকে ছোটদা একটি বাক্য তুলে একদিন অবকাশে বিতরণ করলেন কুড়িটা বসন্ত পার হয়ে গেল, কোনও কোকিল তো দূরের কথা, একটা কাকও ডাকল না। বাক্যটি লুফে নিয়ে উত্তরদাকে জানিয়ে দিই, ঘটনা এই। তিনি এমনই মর্মাহত শুনে যে ঢাকা শহরের সবগুলো কাককে ময়মনসিংহের দিকে ধাওয়া করলেন, যেন কা কা রব তুলে আমার বসন্তকে সার্থক করে এবং তিনি এবং তাঁর শহরবাসি কাকের যন্ত্রণা থেকে এই জনমের মত মুক্তি পান। ধুত্তোরি, আমি কি এমনই বুড়ি যে কুড়ি হব! ও তো মজা করতে! কেবলই মজা করার জন্য সে আসর নয়, যথেষ্ট গুরুগম্ভীর কথাবার্তাও হয়। লোকের সত্যিকার মান অভিমান, দুঃখ শোক, প্রেম বিরহ, কূটকচাল এমনকি সংসারের ঝুটঝামেলারও মীমাংসা হয় পত্রিকার পাতায়। পাঠকসংখ্যা এত ব্যাপক যে তখন দেশের প্রতিটি শহরে চিপাচস নামে চিত্রালী পাঠকপাঠিকা সমিতি খোলা শুরু হল। ময়মনসিংহে চিপাচসের কণর্ধার বনে বসলেন স্বয়ং ছোটদা। হতেই হবে, লেখক না হলেও পাঠক তো তিনি। পড়াশোনা লাটে উঠেছে, কাজ নেই কম্ম নেই, তাঁর পক্ষেই সম্ভব চিপাচস নিয়ে চব্বিশ ঘন্টা পড়ে থাকা। চিপাচসের একটি সভাও একদিন হয়ে গেল টাউন হলের মাঠে। ঘন সবুজ মাঠের বটবৃক্ষ ছায়ায় বিকেলের সভাসমিতি জমে ওঠে বেশ। এক বটতলায় চিপাচস গড়ে তোলা হচ্ছে, অন্য বটতলায় ধাড়ি ধাড়ি ছেলেমেয়ে নিয়ে বসেছে পুরোনো কচি কাঁচার মেলা। কাঁচারা এদ্দিনে পেকে লাল, কিন্তু কাঁচা নামটি খোয়াতে নারাজ। ইত্তেফাক পত্রিকার রোকনুজ্জামান খান যাঁকে কচি কাঁচারা দাদাভাই বলে ডাকে, পত্রিকায় কচিকাঁচার আসরও যেমন খুলেছেন, কচিকাঁচাদের সংগঠনও গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন শহরে। সংস্থা সমিতি সংগঠন পরিষদ এসবের কমতি নেই ময়মনসিংহ শহরটিতে। ছোটদার কাছেই খবর জোটে শহরের এখানে ওখানে নানা রকম আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে, সাহিত্য সভা হচ্ছে, নাচ গান নাটক হচ্ছে। শুনে ইচ্ছের জিভে লোল জমে। চিপাচসের সভা থেকে ফিরলে ছোটদাকে পই পই করে জিজ্ঞেস করি, কে কে এসেছিল, দেখতে কেমন? কেউ কি কিছু বলল, কি বলল? ছোটদা এক এক করে নাম বলেন, এক এক করে পরিচয়। এর ওর বলা দুএকটি শব্দ বা বাক্য উপরোধে ঢেঁকি গিলতে গিলতে শোনান। ময়মনসিংহের পদ্মরাগ মণি, চিত্রালীর আসরে নজর কাড়া মেয়ে, সগৌরবে চিপাচসের সভায় উপস্থিত থাকলেও আমার আর চন্দনার পক্ষে সম্ভব হয়নি পুরুষমানুষের ভিড়ভাট্টায় ছায়া সুনিবিড় শান্তির মাঠটির শীতল ঘাসে পা ফেলার অনুমতি পাওয়া। পুরুষ- আত্মীয় আর পুরুষ-শিক্ষক ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের আড্ডায় বা সভায় আমাদের অবাধ যাতায়াতের কোনও সুযোগ নেই, যতই আমরা যাওয়ার জন্য গোঁ ধরি না কেন।