সাইদুজ্জামান কামান দাগান,
ধর্মের ঘোড়া স্কন্ধে চাপান
হাবিজাবি কন যেখানে যা পান
কাশি তো আছেই, আবার হাপাঁন
মাথায় একটি টুপিও লাগান
কোরান হাদিস মানেন নাকি মানার ভান?
সাইদুজ্জামানকে তুলোধুনো করে আমারই পরে দুঃখ লেগেছে, রীতিমত শার্টপ্যান্ট পরা ভদ্রলোক, কোনও টুপি তার চাঁদি স্পর্শ করেনি, তাঁকে কেন এই হেনস্থা! আসলে এ সাইদুজ্জামান বলে কথা নয়, যে কাউকে নিয়েই এমন হতে পারে, টেংরা মাছের মত দেখতে কাউকে বিশাল হাঁমখু বোয়ালও নির্বিঘ্নে বানানো চলে। বিশেষ করে চন্দনার আশকারা পেলে। বাংলার শিক্ষক সুরাইয়া বেগম হেলে দুলে হেঁটে যাচ্ছেন, পেছনে চন্দনা আর আমি দুটো পিপঁ ড়ের মত, চন্দনা ফিসফিসিয়ে বলছে—ওলো সুরাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, মখু ঘুরাইয়া
আমি যোগ করছি—আর কত হাঁটো, বেলা তো গেল
কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দনা শেষ করে, যেতে যেতে গেল ফুরাইয়া।
আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তনের শিক্ষকমণ্ডলী যে ছোটখাট ব্যাপার নয় তা জেনেও আমাদের ছড়া কাটা, যদিও প্রকাশ্যে কিছুই নয় সবই নিভৃতে-নির্জনে-নিরালায়, থেমে থাকে না। অন্য ইশকুলে বি এ পাশ নেবে, আবাসিকে ঢুকতে হলে হতে হবে এম এ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে যা হতে হয়। এই বিদ্যায়তনের শিক্ষক শিক্ষিকা কেউ এ শহরের নয়, দূর দূর শহর থেকে আসা, বেশির ভাগই ঢাকা থেকে। শিক্ষককুলের বাড়িঘর সবই ইশকুলের ভেতর। এক একজন শিক্ষকের জন্য এক একটি বাড়ি, বাড়ির সামনে মাঠ, পেছনে বাগান। যখন এ ইশকুলটি বানানো হয়, তখন কেবল শিক্ষককুলের জন্যই আবাসিক ব্যবস্থা ছিল না, ছাত্রীকুলের জন্যও ছিল। বাধ্যতামূলক আবাসিকতা। প্রায় ক্যাডেট কলেজের মত করে এই ইশকুলটির আগপাস্তলা গড়ার স্বপ্ন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহে, তাই এই শহরেই তাঁর মৃত স্ত্রীর স্মরণে রাবেয়া মেমোরিয়াল নামে এই আবাসিক ইশকুলটি তিনি বানাতে শুরু করেছিলেন প্রায় একশ একর জমির ওপর, হাওড় বিল সব ভরে। তারপর তো পাকিস্তান গেল, গভর্নর গেল, একাত্তরে বোমারু বিমান শহরে চক্কর খেয়ে রাবেয়া মেমোরিয়ালের একাকি দাঁড়িয়ে থাকা আধখেঁচড়া ইশকুল-দালানে বোমা ফেলে অনেকখানি ধসিয়ে ফেলল। যুদ্ধের পর ধস সরিয়ে অবশিষ্ট দালানটুকু সারাই করে চুনকাম করে রাবেয়া মেমোরিয়াল নাম তুলে দিয়ে আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তন বসিয়ে এটি চালু করা হল,ওই একই নকশায় বলা যায়, আবাসিকের নকশা, কিন্তু শিক্ষককুল দ্বারা আবাসিক ব্যবস্থা সম্ভব হলেও ছাত্রীকুল দ্বারা হল না। একটি নতুন দেশের পক্ষে অত বিশাল আয়োজনে সবকিছু করা সম্ভব হয়নি, তবু যা হয়েছে তাই বা কম কিসে! ছাত্রীদের ইশকুলের সীমানায় বাধ্যতামূলক করা হল না, ছাত্রীনিবাস পড়ে রইল মাঠের এক কোণে ভুতুড়ে নির্জনতায়। কেবল প্রধান শিক্ষিকা ওবায়দা সাদের বাড়ির নিচতলায় খুলনা রাজশাহি থেকে আসা কিছু মেয়ের থাকার ব্যবস্থা হল। তবু এই ইশকুল শহরের নামি ইশকুল, দামি ইশকুল। বাছাই করে ভাল শিক্ষক শিক্ষিকাদেরই কেবল চাকরি দেওয়া হয়েছে। বাছাই করে ভাল ছাত্রীদেরই কেবল ভর্তি করা হয়েছে। অন্য ইশকুলগুলোর চেয়ে এই ইশকুলের ঢংঢাং তাই অনেকটাই আলাদা। এই ইশকুলে ছাত্রীদের বৃত্তি দেওয়া হয়, অন্য ইশকুলে এমন ব্যবস্থা নেই। বৃত্তির জন্য অন্য ইশকুলে বোর্ডের পরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়। এই ইশকুলের অডিটোরিয়াম যেমন দেখার মত, অনুষ্ঠানও হয় দেখার মত। এ তো আর অন্য ইশকুল-অডিটোরিয়ামের মত মুরগির খোপ জাতীয় কিছু নয়, বড় কোনও সিনেমাহল বলা চলে। বোতাম টিপলেই ভারি মখমলের পর্দা মঞ্চের এপাশ থেকে ওপাশে সরে যায়। মঞ্চও চক্রাকারে ঘোরে। দর্শকের আসন নিচ থেকে ওপরে চলে গেছে। নাটক, নৃত্যনাট্য, সঙ্গীতানুষ্ঠান যা হয় এই মঞ্চে তা অন্য ইশকুলের সাধ্য নেই হওয়ানোর। প্রতি মাসে না হলেও দুমাস অন্তর অন্তর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, বারোই দিবস তেরই দিবস পালন তো আছেই। এমনিতেও চাপাচাপি করলে ডাকসাইটে শিক্ষক শিক্ষিকারা খোলস থেকে বেরিয়ে গান গেয়ে ওঠেন অদ্ভুত সুরেলা কণ্ঠে। বোমা ফেলার দরকার হয় না, পরিমাণ মত সুড়সুড়ি ফেললেই কবিতা বেরিয়ে আসে অনেকের পেট থেকে, এমন কি অংকের শিক্ষকের পেট থেকেও। অনুষ্ঠানাদি ছাড়া যে একেবারে নীরস সময় কাটে তা নয়, সুরাইয়া বেগম বাংলা পদ্য পড়াতে এসে প্রায়ই নিজের লেখা পদ্য শোনান। সুরাইয়া বেগমের মন কাদার মত নরম হলেও জিন্নাতুন নাহার শক্ত পাথর-মত। তিনি পড়ান ইংরেজি। ইংরেজির শিক্ষকদের কোনওকালেও আসলে আমার ভাল লাগেনি। বিষয়টি যেমন কঠিন, বিষয়ের শিক্ষকগুলোও তেমন। আমার ভাল লাগে বাংলা, চন্দনারও বাংলা। ওই সময় একদিন অন্যদিনের মতই ইশকুলে পৌঁছে সকাল বেলা মাঠে ক্লাস অনুযায়ী লাইনে দাঁড়িয়ে উঠবস করে আর ডানে বামে পেছনে সামনে মাথা থেকে পা অবদি নেড়ে চেড়ে অর্থাৎ দৈনন্দিন ব্যায়াম সেরে সোজা হও আরামে দাঁড়াও পবের্ আদেশ অনুযায়ী আরামে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকার সামনে সমস্বরে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গেয়ে লাইন করে ক্লাসঘরে ঢোকার পর যে সংবাদটি প্রধান শিক্ষিকা নিজে এসে আমাদের দিয়ে যান, সে হল লেখক কাজী মোতাহার হোসেন এখন আমাদের ইশকুলে, তাঁর সঙ্গে ইচ্ছে করলে আমরা দেখা করতে পারি। উত্তেজনায় বুক কাঁপে। কাজী মোতাহার হোসেন আমাদের প্রধান শিক্ষিকার বাবা। তিনি লেখেন ভাল, খেলেনও ভাল, মাথা ভালদের যা হয়—সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী। অনেকগুলো গুণী সন্তান জন্ম দিয়েছেন তিনি, এই ওবায়দা সাদ ছাড়া বাকি সবাই স্বনামধন্য, ছেলে কাজী আনোয়ার হোসেন নামি লেখক, মেয়ে সানজিদা খাতুন-ফাহমিদা খাতুন দুজনই বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী। আমি আর চন্দনা বিখ্যাত সন্তানদের বিখ্যাত বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অবশ্য বিষম এক ফাপঁরে পড়ি। প্রথম কিছুক্ষণ উঁকি দিয়ে দরজায়, আলতো করে দরজা সরিয়ে পঁচাশিভাগ ভয়ে পনেরোভাগ নির্ভয়ে তাঁর ঘরখানায় উপস্থিত হতেই তিনি শাদা দাড়ি দুলিয়ে হাসলেন, কৌতূহলে চোখদুটো উজ্জ্বল, তাঁর কৌতূহল নিবৃত্ত করি আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি বাক্যটি বড় ব্রীড়িত বিনম্রস্বরে বলে। শুনে তিনি মধুর হাসলেন, হেসে টেবিলে একটি রেডিও ছিল সেটি বেজায় শব্দ করে চালিয়ে দিলেন। অনেকক্ষণ রেডিও চলল, আমি আর চন্দনা নিজেদের মধ্যে বিস্মিত দৃষ্টি বিনিময় করছি, তিনি শুভ্রকেশ শুভ্রশ্মশ্রু শুভ্রহাস্য অধরে, রেডিওতে কান পেতে আছেন। আমরা আবারও জানালাম কেন এসেছি, তিনি এবার মাথা নাড়লেন, অথার্ৎ তখন না হলেও এখন বুঝতে পেরেছেন আমরা কেন এসেছি। মাথা নেড়েই তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে, কেবল ঘর থেকে নয়, বাড়ি থেকে, হন হন করে হেঁটে সোজা ইশকুলের দিকে। পেছন পেছন গিয়ে দেখি ওমা তিনি তাঁর কন্যার কাছে গিয়ে বলছেন, তুমি আমাকে ডেকে পাঠালে যে! ওবায়দা সাদ তাজ্জব, তিনি মোটেও ডেকে পাঠাননি পিতৃদেবকে। ঘটনা কি? পিতৃদেব কানে খাটো। কানে খাটোর সঙ্গে আমরা কি করে কথোপকথন চালাবো তবে ওবায়দা সাদ এর কোনও মীমাংসা করতে পারলেন না। অতঃপর মান্যগণ্য প্রণম্য নমস্য সৌম্যদর্শনের আপাদমস্তকের দিকে নীরবে শ্রদ্ধা ছুঁড়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর রইল না। বুদ্ধি হওয়ার পর কোনও জলজ্যান্ত লেখককে চোখের সামনে এই আমার প্রথম দেখা। মার কাছে শুনেছি, যখন ছ মাস বয়স আমার, রাহাত খান, বাবার এক লেখকবন্ধু আমাদের বাড়ি আসতেন, আমাকে কোলে নিয়ে দোলাতেন, দোলাতে দোলাতে নিজের বানানো গান গাইতেন। মার ইশকুলের বান্ধবী ফরিদা আখতারের উদ্দেশে ছিল সে সব গান, আমার স্বপ্নে দেখা ফকিরকন্যা থাকে সে এক পচা ডোবার ধারে, কিস্তি নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে আমি দেখে এলেম তারে ..। রাহাত খান নাসিরাবাদ কলেজের মাস্টার ছিলেন। ডাক্তারে আর মাস্টারে খাতির হইল কেমনে? জিজ্ঞেস করলে মা উত্তর দিয়েছেন, দুইজনে এক মুক্তারনির প্রেমে পড়ছিল, সেই মুক্তারনি, মুক্তারের সুন্দরী বউ, যার বাড়িতে জায়গির থাইকা লেখাপড়া করছিল তর বাপ! ফরিদা আখতারের প্রেমেও নাকি বাবা পড়েছেন। মুখে বসন্তের দাগঅলা ফর্সা উঁচালম্বা ফরিদা আবার আমার শিক্ষিকা ছিলেন ছোটবেলার সেই রাজবাড়ি ইশকুলে। ফরিদা লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রী ছিল, আমি ছিলাম ফার্স্ট বেঞ্চের, আমার চেয়ে কত খারাপ ছাত্রী ছিল ফরিদা, সেই ফরিদা এখন ইশকুলে পড়ায় আর আমি চুলায় খড়ি ঠেলি। এই হইল আমার কপাল! মার কপাল নিয়ে আর যে কেউ ভাবুক, বাবা ভাবেন না। মা ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করবেন, রেঁধেবেড়ে খাওয়াবেন, চোর ছ্যাঁচড়ের উপদ্রব থেকে বাড়ি সামলাবেন, এই মহান দায়িত্ব যাঁর হাতে, তাঁর আবার কপালের কথা ভাবার অবকাশ আছে নাকি!