আজাইরা ফুর্তি ফার্তা বাদ দেও। মেয়ে নাচে, সাথে দেখি মাও নাচে। যত্তসব বান্দরের নাচ।
বাবার ভ্রুকুটিতে মা দমে যান না। বাবার সর্দি লাগা শরীরের বুক পিঠ গরম রসুনতেল দিয়ে মালিশ করতে করতে আবদার করে যান। মেয়েরা ত বিয়া দিলেই পরের বাড়িতে চইলা যাইব। মেয়েদের সাধ আহলাদ যা আছে তা তো বাপের বাড়িতেই পূরণ করতে হয়। রসুন তেল বাবার ত্বক নরম করলেও মন নরম করে না। ইয়াসমিন মন খারাপ করে বসেছিল, জন্মদিনের কোনও উৎসব শেষ অবদি হচ্ছে না। কিন্তু বাড়ির সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেদিন দুপুরে বাবা খাবার পাঠিয়ে দিলেন ইয়াসমিনের লিস্টি মত। পুলকে নাচে মেয়ে। পিরিচে খাবার সাজিয়ে সেজেগুজে কালো ফটকের দিকে চোখ ফেলে অতিথিদের অপেক্ষায় সারা বিকেল বসে থাকে। কারও দেখা না পেয়ে অগত্যা শেষ বিকেলে গোল্লাছুট খেলার সঙ্গী পাড়ার তিনজন মেয়ে মাঠে খেলতে এলে ওদের ঘরে ডেকে জন্মদিনের খাবার খেতে দেয় ইয়াসমিন।
সন্ধেয় বাড়ি ফিরে রকমারি খাবার দেখে ছোটদা অবাক,কি রে কিয়ের উৎসব আজকে?
ইয়াসমিন লাজুক হেসে বলল আমার জন্মদিন।
কেডা কইছে এই তারিখে তর জন্ম হইছিল?
বাবা কইছে। বাবা কওয়ার পর আর কারও মুখে টুঁ শব্দ মানায় না। কারণ বাবা যা কন, বাড়ির সবাই জানি যে তা খাঁটি,কারণ বাবার চেয়ে বেশি জ্ঞান বুদ্ধি কারও নেই। হ বুঝছি, একটা জন্মদিনের দরকার, তাই তুই চাইলি একটা জন্মদিন, আর বাবাও বানাইয়া কইয়া দিল।
ছোটদার স্পর্ধা দেখে ইয়াসমিন থ হয়ে গেল।
সেদিনও যার ভাগে ইয়াসমিনের জন্মদিনের কোনও কেকের টুকরো পড়েনি, সে মা। মা সেই যে দুপুরের পর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, ফিরলেন সন্ধেয়। হাতে বাদামি রঙের একটি কাগজের মোড়ক, ভেতরে ইয়াসমিনের জন্য লাল একটি জামার কাপড়। মা নিজেই এই কাপড় দিয়ে কুচিঅলা একটি ফ্রক বানিয়ে দেবেন ওর জন্য। হাতে টাকা ছিল না বলে হাশেমমামার কাছ থেকে টাকা ধার করে নিজে গৌরহরি বস্ত্রালয়ে গিয়ে তিন গজের এই কাপড়টি কিনেছেন।
আমি হায় হায় করে উঠি,কিন্তু আজকে ত ওর জন্মদিন না!
কেডা কইছে জন্মদিন না?
ছোটদা কইছে।
কি হইল তাতে! মা ধমকে ওঠেন। না হোক জন্মদিন। একটু আমোদ করতে চাইছে মেয়েটা, করুক।
ঈদ উৎসব ছাড়া কোনও জামা আমাদের জোটে না। বছরে বাবা একবারই আমাদের জামা দেন, সে ছোট ঈদে। পরের বছর ছোট ঈদ আসার আগেই আমাদের জামা হয় ছিঁড়ে যায় নয় ছোট হয়ে যায়। বাবার কাছে নতুন জামার আবদার করলে বাবা দাঁত খিঁচিয়ে বলে দেন,জামা দুইটা আছে না? একটা পরবি,ময়লা হইলে ধইয়া দিয়া আরেকটা পরবি। দুইটার বেশি জামা থাকার কোনও দরকার নাই। মা আমাদের ছেঁড়া আর ছোট হয়ে আসা জামা শাড়ির পাড় বা বাড়তি কোনও টুকরো কাপড় লাগিয়ে বড় করে দেন, ছেঁড়া অংশ সেলাই করে দেন। ইশকুলের মেয়েদের ঘরে পরার আর বাইরে পরার দুরকমের জামা থাকে। কোনওদিন কোনও ঈদের জামাকে বাইরে পরার জামা হিসেবে রেখে ঘরে পরার জামা চাইলে বাবা বলেন,বাইরে তর যাইতে হইব কেন? ঘরের বাইরে যদি কোথাও যাস, সেইডা হইল ইশকুল। ইশকুলের জন্য ইশকুলের ইউনিফর্ম আছে। ইশকুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা বনভোজনের আয়োজন হলে মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া হয় ইউনিফর্মের বাইরে অন্য জামা পরে যাওয়ার। মেয়েরা নানান রকম জামা পরে সেসব অনুষ্ঠানে যায়, আর আমি প্রতিটি অনুষ্ঠানে একটি জামাই পরে যাই বলে ক্লাসের এক মেয়ে একবার প্রশ্ন করেছিল, তোমার কি আর জামা নাই? লজ্জা আমাকে সেদিন এমনই তাড়া করেছিল যে দৌড়ে বড় একটি থামের আড়ালে গিয়ে অনেকক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে। ইশকুলের ইউনিফর্ম বানিয়ে দিতে বাবা কোনওদিন না করেননি। নিজে তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে গৌরহরি বস্ত্রালয় থেকে কাপড় কিনে গাঙ্গিনার পাড়ের দরজির দোকানে যান, দরজি যখন গায়ের মাপ রাখে, দরজিকে বারবার বলে দেন, যেন বড়সড় করে বানায়, যেন অনেকদিন যায়। জুতোর দোকানে গিয়েও বাবা বলেন, এই মেয়েদের পায়ে জুতা দেন তো। একটু বড় দেইখা দিবেন, যেন অনেক দিন যায়। মাপের চেয়ে বড় জামা জুতো পরেও দেখতাম, আমাদের জামা জুতো ছোট হয়ে যায় দ্রুত। মা বলেন, জামা জুতা ছোট হয় না, তরা বড় হস। আমরা গায়ে বড় হতে থাকি বলে, আমার ভয় হয়, বাবা রাগ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দাদা মাসোহারার টাকা বাঁচিয়ে আমাকে আর ইয়াসমিনকে দুটো সিল্কের জামা কিনে দিয়েছিলেন। ফুটপাত থেকে কেনা বিদেশি পুরোনো জামা, সস্তার মাল, লান্ডির মাল। ও পেয়েই খুশির শেষ ছিল না।
মার কিনে আনা লাল কাপড়টি গায়ে জড়িয়ে ইয়াসমিন মহা আহলাদে বাড়িময় লাফাচ্ছিল যখন, অন্ধকার বারান্দায় চুল খুলে বসে ঘরের উজ্জ্বল আলোয় লাল টুকটুকে ইয়াসমিনকে বড় সুন্দর লাগছে, দেখছিলেন মা।
০২. উতল হাওয়া
কুমিল্লা থেকে বদলি হয়ে ময়মনসিংহের নতুন ইশকুলে ভর্তি হয়ে যেদিন প্রথম এল ও ক্লাস করতে, সেদিনই ওর সঙ্গে আমার কথা হল, চোখে চোখে। ওর প্রায় বুজে থাকা চোখ দুটো একই সঙ্গে এত কথা বলল সেই প্রথম দিনই, প্রথম দিন ও অবশ্য ওর মামাতো নাকি কাকাতো নাকি ফুপাতো বোন সীমা দেওয়ানের গা ঘেঁসে ছিল, দ্বিতীয় দিনও তাই, আমার বেঞ্চে বসল তৃতীয় দিন আর ওদিনের পর আমার বেঞ্চ ছাড়া কারও বেঞ্চে ও বসেনি। চন্দনার গায়ের রং না-লেখা কাগজের মত শাদা, নাক যেন ইটে থেতলে দেওয়া হয়েছে এমন, আধেক চোখ আড়াল করা চোখের পাতায়, বাকি আধেকের দ্যুতি আমারই অলক্ষ্যে আমার হৃদয় আলোকিত করে। ওর বিনুনিবিহীন দীঘল ঘন চুল বন্ধন মুক্ত হলেই পিঠে বর্ষার জলের মত উপচে পড়ে আর আশরীর ভিজে গোপনে গোপনে স্নিগ্ধ হতে থাকি আমি। দিলরুবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমার পাশের জায়গাটি কারও জন্য নির্দিষ্ট ছিল না, আমার বুঝে ওঠার আগেই চন্দনা আমার পাশে নির্দিষ্ট হয়ে গেল। প্রতিদিন চন্দনার শব্দ গন্ধ বণর্ আর প্রতিদিনই দিলরুবার না থাকা দুটোই আমার পাশে বসে থাকে আমারই ছায়ার মত। কেবল চন্দনাই তখন ক্লাসে নতুন ভর্তি হওয়া মেয়ে ছিল না, বিদ্যাময়ী থেকে দলে দলে মেয়ে আসছে, আমার সেই যুদ্ধংদেহি বন্ধুরাই। কিন্তু কেউ আমার কপালের চন্দন-তিলকে একতিল কালি ছোঁয়াতে পারেনি। একটি তরঙ্গও তুলতে পারেনি সেই চন্দন-সুবাসে, যেখানে অহর্নিশি আমার আকণ্ঠ অবগাহন।