কাল তেল আসে তো পেঁয়াজ আসে না। পেঁয়াজের সঙ্গে বাজারের পচা কই মাছ থলে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাবা। থলে খুলেই মা দেখেন পচা মাছের গন্ধ বেরোচ্ছে। তাই বলে কি ছেলেমেয়ে উপোস থাকবে। লেবগুাছ থেকে মুঠো ভরে লেবপুাতা ছিঁড়ে এনে মাছের ঝোলে দেন। লেবুপাতার গন্ধের তলে যেন মাছের গন্ধ চাপা পড়ে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না, লেবপুাতার গন্ধ দিয়ে মাছের পচা গন্ধ হয়ত ঢাকা যায় কিন্তু লেবপুাতার উপস্থিতিই আমাকে সন্দিহান করে, খেতে বসেই নাক সিটকোই, লেবুপাতা দিছ কেন মা? মাছ নিশ্চয়ই পচা ছিল? এক চিলতে হাসি মার ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে যায়। মা আমার পাতে একটি না-ভাঙা মাছ তুলে দিয়ে বলেন, মাছগুলা জেতা ছিল। আল্লাহর কসম কইরা কও তো জেতা ছিল!
কথায় কথায় আল্লার কসম কাটতে হয় না। মা নরম ধমক লাগান।
দাদা একটি খেয়ে আরেকটি মাছ নেন। আমি থাল সরিয়ে বলি মাছ পচা, খাইতাম না।
মাছ আবার পচা কোত্থেকা হইল! মা রান্নাঘর থেকে জরির মাকে ডেকে আনেন, এই কও,কাটার সময় মাছ লাফাইতাছিল না?
জরির মা মাথা নেড়ে বলে, হ লাফাইতাছিল।
লাফাক। আমি মাছ খাইতাম না। অন্য কিছু থাকলে দেও।
দাদা মাকে বুদ্ধি দেন, মাছটা একটু নরম হইয়া গেলে ভাইজা ফেলবেন, ভাজলে আর গন্ধ থাকে না।
নাসরিনের ত শকুনের নাক। মা বলেন।
বাবা রাতে ফিরে যখন প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরতে থাকেন, মা বলেন পয়সা যে জমাইতাছুইন, কার লাইগা জমাইতাছুইন?
কার লাইগা জমাইতাছি মানে? এতগুলা মানুষ খাওয়াইতাছি, পরাইতাছি। চোক্ষে দেহ না?
আমি আমার কথা কই না। আমি ত ডাইল দিয়া খাইয়া উঠতে পারি। কইতাছি ছেলেমেয়েদের কথা!পচা মাছ পাঠান কেন? ইশকুল থেইকা ক্ষিদা পেটে আসে, ভাত খাইতে পারে না।
মাছ পচা ছিল নাকি?
পচা ছিল না মানে? গন্ধে তো বাড়ি উজাড় হইয়া যাইতাছিল।
হুম।
আর পিঁয়াজ যে নাই এক মাস হইয়া গেল। পিঁয়াজ কিননেরও কি পয়সা নাই?
পিঁয়াজ না পাঠাইলাম কয়দিন আগে। শেষ হইয়া গেল?
কয়দিন আগে? মা খানিকটা সময় নিয়ে হাতের কড়া গুনে বলেন, আজকে হইল রোববার, গত রোববারের আগের রোববারও পিঁয়াজ ছাড়া রান্ধা হইছে। তার আগের মঙ্গলবারে না পিঁয়াজ পাঠাইছেন!
এত তাড়াতাড়ি শেষ হইয়া যায় কেন? হিশাব কইরা খর্চা কর না কেন? বাজারে পিঁয়াজের দাম কত খবর রাখো? কামাই ত কর না, কামাই করলে বুঝতা।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কামাই কি তিনি শখে করেন না!
বাবার ওষুধের দোকানের কর্মচারি আবদুস সালাম বাজার-সদাই নিয়ে বাড়ি এলে মা তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। এক বিকেলে দেখি সালামকে মাছ ভাত খাওয়াচ্ছেন রান্নাঘরে বসিয়ে। সালাম ভাল কইরা খাইয়া লও, সেই সকাল বেলা কি মুখে দিয়া যে আসো, তারপর ত সারাদিন খাওয়া নাই!
মার এমন একে ওকে খাওয়ানো নতুন কিছু নয়। বাড়িতে শুকনো মুখের কোনও ভিখিরি এলে মা ওদের বসিয়ে খাওয়ান। বাসি তরকারি পান্তা ভাত শুকনো মরিচ। ওসবই ওরা পরম সুখে খেয়ে নেয়। কারও জমিজিরেত ছিল, হঠাৎ অভাবে পড়ে ভিক্ষে করছে শুনলে পাতিল থেকে দুটুকরো নতুন রান্না করা মাংসও তুলে দেন। মার দয়ার শরীর। সালাম খেয়ে দেয়ে হাসিমুখে বিদেয় নেওয়ার পর মা আমাকে ডাকলেন, দাদাকে ডাকলেন,বললেন এই যে তর বাপ পচা মাছ কেন পাঠায়, জানস? কেন বাড়িত তেল আনেনা, পিঁয়াজ আনেনা?
কেন মা? দাদা জিজ্ঞেস করেন।
কিরীটি রায়ের মত বহুকালের রোমহর্ষক রহস্য উদঘাটন করার ভঙ্গিতে মা বলেন, কারণ দুই জায়গায় বাজার পাঠাইতে হয় ত! এত কুলাইব কেমনে! ওই বেড়ি তার কাজের লোক পাঠাইয়া দেয় ফার্মেসিতে আর তর বাপে নিজে বাজারে হাইটা যাইয়া বাজার কইরা পাঠায় বেড়ির বাড়িত। ওই বেডিরে ত বিয়া করছে। বেডির ছোট ছেলেডাও ফার্মেসিতে আইসা বইসা থাকে। ওরে লেখাপড়ার খরচ দেয়। ও ত আসলে তর বাপের ছেলে, চাকলাদারের না।
আমার অস্বস্তি হয় মার অভিযোগ শুনতে। দাদারও হয়। দাদা বলেন কী যে কন না কন, কার কাছে কি শোনেন আর চিল্লাচিল্লি করেন।
কার কাছে শুনি? আচ্ছা যা না, নওমহলেই ত থাকে বেডি, বেডির বাড়িত যাইয়া দেইখা আয়, জাইনা আয় তর বাপ বিয়া করছে কিনা, প্রত্যেকদিন বাজার-সদাই পাঠায় কি না।
হ। আমার আর কাম নাই বেডির বাড়িত যাইয়াম! দাদা সরে যান মার সামনে থেকে। আমিও যাই। মার অভিযোগ অনুযোগ সবই আমাদের চেনা। মার বিলাপ প্রলাপ সব চেনা। মার চিল্লাচিল্লিতে কোনও করুণার উদ্রেক আমাদের হয় না, যদি হয় কিছু সে বিবমিষা।
মা একা বসে থাকেন। তাঁর দুঃখ শোনার বাড়িতে আর কেউ নেই। তিনি জরির মাকে ডাকেন, বলেন, দেখ জরির মা, এই সংসারে আমার শান্তি নাই। আমার ত কপাল পুড়ছে, লেখাাপড়াডা যেদিন বন্ধ করল, সেইদিনই। আইজ যদি লেখাপড়া জানতাম, তাইলে কি আর নিজের সংসারে নিজে বান্দিগিরি করি! ছেলেমেয়েগুলাও হইছে বাপের ভক্ত। আমারে মা বইলা গ্রাহ্যই করে না।
জরির মা মার দুঃখ বোঝে না। তার নিজের দুঃখের সঙ্গে তুলনা করলে মার দুঃখ তার কাছে কিছুই মনে হয় না। তার বিয়ে হয়েছিল তিন সতিনের সংসারে, সতিনের জ্বালায় সে জ্বলেছে অনেক। স্বামীও তাকে কম জ্বালায়নি। জরি জন্ম নেওয়ার পর জরির মাকে ভাত দেওয়া বন্ধ করে দিল। শেষে তো লাত্থি গুঁতা দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়েই দিল। আর এ সংসারে মা তো অন্তত ভাত পাচ্ছেন। সতিন? সে তো অন্য বাড়িতে থাকে, এক বাড়িতে নয়। জরির মার কাছে মার সংসারকে সোনার সংসার বলে মনে হয়। জরির মা মার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমি নিশ্চিত, দীর্ঘশ্বাসটি নকল।