বাবা বলেছেন, না।
এই যে এত্ত এত্ত রক্ত যায়। পায়খানা ভইরা রক্ত যায়। এইভাবে রক্ত যাওয়া খারাপ না?
গম্ভীর কণ্ঠে বাবা উত্তর দেন, না।
মার চটি ছিঁড়ে পড়ে আছে অনেকদিন, বাবাকে চটি কেনার কথা বলা হয়, বাবা শুনেও শুনলেন না। আমার বা ইয়াসমিনের চটি পরে কোথাও যাবার হলে মা যান, আর ঘরে বারান্দায় উঠোনে তো খালি পায়েই। বাড়ির লোকের খুব একটা চোখে পড়ে না আজকাল মার কি নেই, মার কি প্রয়োজন। নানার মত বেহিসেবি বাউণ্ডুলে মানুষের নজরে পড়ে মার পাদুকাহীন জীবন। তিনি একদিন মার জন্য একজোড়া শাদা কাপড়ের জুতো কিনে নিয়ে এলেন। এরকম জুতো যে মেয়েরা কখনও পরে না সে ধারণা নানার নেই। কিন্তু মা জুতো জোড়া পেয়েই খুশিতে আটখানা, বাড়ির সবাইকে দেখালেন যে তাঁর বাজান তাঁর জন্য জুতো এনেছেন। সেদিন মা নানার জন্য বেশি মিষ্টি দিয়ে,নানার চিনি খাওয়া বারণ জেনেও,পায়েশ রাঁধেন। নানা খেয়ে দেয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়ের জন্য দোয়া করেন, মেয়ের যেন বেহেসত নসীব হয়। বেহেসতের খাবার দাবারের বর্ণনা করেন নানা, বেহেসতে এমন খানা একবার খাইব তো চল্লিশ হাজার বছর খাইতেই থাকব, ঢেকুর একটা আইব তো মেসকাম্বর। নানার বর্ণনা শুনে আমার ধারণা হয় বেহেসতের ভাল ভাল খানা খাওয়ার লোভেই নানা বুঝি নামাজ রোজা করেন। নওমহলে পীরের প্রতাপ এমনই বেড়েছে যে, এখন আর রিক্সাঅলাকে বলতে হয় না, নওমহল চান্দুর দোকানের পিছনে যাইবা? নওমহলের পীর বাড়ি বললে রিক্সাঅলা চেনে। আগে মা চারআনা করে যেতেন, দাম বেড়ে পরে আট আনা হল, আট আনা থেকেও লাফিয়ে এক টাকা। মার হাতে অত পয়সা নেই যে ঘন ঘন তিনি বাপের বাড়ি বা পীর বাড়ি ছুটবেন। অনেক সময় যেতে ইচ্ছে করলেও মাকে ইচ্ছের লাগাম টেনে ধরতে হয়। সেদিন সকালে আমি ইশকুলে যাব, এক প্যাঁচে শাড়ি পরে, তার ওপর রংচটা বোরখাটি পরে, পায়ে নানার দেওয়া কাপড়ের জুতো, বললেন আমারে নামাইয়া দিবা রেললাইনের মোড়টায়? মার আপাদমস্তক দেখে আমি নাক কুঁচকে বলি, তুমি আরেকটা রিক্সা নিয়া গেলেই তো পারো!
রিক্সাভাড়া নাই যে।
নাই তো কারও কাছ থেইকা নেও।
কেউ ত দিল না।
আজকে যাইও না তাইলে,বাদ দেও। অন্যদিন যাও।
মা আমার উপদেশ মানেন না। মার কাছে আজ এবং অন্যদিনে কোনও পার্থক্য নেই। অগত্যা সঙ্গে নিতে হয় মাকে। মনে মনে প্রার্থণা করতে হয় যেন রাস্তায় চেনা কেউ না পড়ে, রংচটা বোরখা আর মোজাহীন কাপড়ের জুতো পরা কারও সঙ্গে আমাকে যেন কেউ না দেখে। সি কে ঘোষ রোড পার হয়ে রেললাইনের সামনে মা নেমে যান। বেশির ভাগ রাস্তাই সামনে পড়ে আছে, পীর বাড়ি যেতে আরও দুমাইল পথ, তিনি হেঁটে পার হবেন। ইশকুলে পৌঁছলে আশরাফুন্নেসা সগৌরবে জানায় ,তরে দেখলাম রিক্সা কইরা আইতাছস। আমি হাত নাড়লাম, তর খবর নাই।
আমি ত তরে দেখলাম না।
দেখবি কেমনে। মাটির দিকে তাকাইয়া ছিলি ত। মনে হইতাছিল লজ্জাশীলা কুলবধূ। যাহ!
মহাকালির মোড়ে আমার রিক্সা তর রিক্সারে ক্রস করল। তর সাথে তোদের কাজের বেটি ছিল।
নিজের বুকের ধ্বক শব্দটি নিজেই শুনি। জিভের কাছে চলে আসা বাক্যটি যে না কোনও কাজের বেটি না, আমার সঙ্গে আমার মা ছিলেন নিঃশব্দে গিলে ফেলি। জানি না কে আমার ঠোঁট জোড়া শক্ত সুতোয় সেলাই করে রাখে। সারাদিন আশরাফুন্নেসার ভুলটি শুধরে দিতে চেয়েও আমি পারিনি।
ইশকুল থেকে ফিরে আমার কানে কানে একটি গোপন খবর বলে ইয়াসমিন, কোন এক মেয়ে নাকি তাকে বলেছে তোমার বাবা ত দুইটা বিয়া করছে।
কি কইলি তারপর?
ইয়াসমিন বলে, কইলাম দুইটা বিয়া আমার বাবা করে নাই, মিছা কথা।
আমিও ফিসফিস করে বলি, আমারেও সেদিন ক্লাসের এক মেয়ে কইল এই কথা।
মা একদিন মন খারাপ করে বসেছিলেন বারান্দায়। আমাকে কাছে পেয়ে বলেন, তর বাবা ত চাকলাদারের বউরে বিয়া কইরা ফেলছে।
আমি বললাম কি যে কও মা!
হ। নওমহলের সবাই কইল।
সবাই কারা? তারা জানে কি কইরা?
দেখছে।
কি দেখছে?
দেখছে যে বেডি নওমহলেই এক বাসায় থাকে। আর তর বাবা সবসময়ই ওই বাসায় যায়।
এইটা ত নতুন না। এই সন্দেহ ত তুমি বহুদিন ধইরা করতাছ।
নিজের চোখে ত ঢুকতে দেখছে তর বাপেরে। বেডির সাথে কথাও কইছে। বেডি নিজে কইছে যে বিয়া হইছে।
হুদাই।
হুদাই হইলে তর বাপে ওই বাড়িত যায় কেন?
যাইতেই পারে। তার মানে কি বিয়া করা?
কারও বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া মানে যে বিয়ে করা নয়, তা আমি যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি। কেন করি, মা যেন মন খারাপ না করেন, নাকি বাবার প্রতি আমার গভীর বিশ্বাস যে এমন মন্দ কাজ তিনি কিছুতেই করতে পারেন না, নাকি বাবা দুটো বিয়ে করেছেন এ আমার জন্যও এত লজ্জার যে আমি প্রাণপণে এই লজ্জার বোঝা বইতে অস্বীকার করি, বুঝি না।
সেইদিন আকুয়া গেছিলাম, সোহেলির মার সাথে দেখা, কইল তর বাবারে আর চাকলাদারের বউরে নাকি দেখছে সিনেমায় যাইতে। আমারে নিয়া তো কোনওদিন সিনেমায় যায় না তর বাপ!
সিনেমায় কি তুমি যাইবা নাকি! তুমি না আল্লার পথে গেছ ! বলে আমি মার সামনে থেকে সরে যাই।
রাজিয়া বেগম নিয়ে মার ঘ্যানর ঘ্যানরের পরও মা মন দিয়ে রান্নাবাড়া করেন, স্বামী ছেলেমেয়েদের খাওয়ান, তেল পেঁয়াজ না থাকলে, বিরস মুখে ওসব ছাড়াই রাঁধেন আর খেতে বসিয়ে বলেন তেল ছাড়া পিঁয়াজ ছাড়া কি আর রান্ধা ভাল হয়! কোনওমতে খাইয়া নে আজকে। দেখি কালকে যদি …