মা বারান্দায় এসে বসেন, জরির মার উনিশ-উত্তর পছন্দ হয়নি বলে মাকে জিজ্ঞেস করি জরির মার বয়স।
চল্লিশ বিয়াল্লিশ তো হইবই। মা তেরচা করে জরির মার ঝুলে থাকা শরীরের ঝুলে থাকা বুকের দিকে তাকিয়ে বলেন, পঁয়তাল্লিশও হইতে পারে।
জরির বয়স কত জরির মা?
জরির বয়স বলতে এবারও জরির মা কোমর টান করে দাঁড়ায়। মা ধমকে বলেন তাড়াতাড়ি কর, উঠান ঝাঁট দিয়া তাড়াতাড়ি খাইতে যাও। খাইয়া বাসন মাইজা রাইতের ভাত চড়াইয়া দেও।
দুপুরের খাওয়া আমাদের দুপুরেই শেষ। কেবল জরির মারই বাকি। কেবল জরির মার জন্যই রান্নাবান্না শেষ করে সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে বাসন মেজে ঘর দোর ধুয়ে মুছে উঠোন ঝাঁট দিয়ে তবে খাওয়া।
জরির বয়সের কথা ভাবতেও জরির মাকে আকাশের দিকে তাকাতে হয়। লালচে আকাশ জুড়ে পাখির দল নীড়ের দিকে যাচ্ছে, জরির মার কোনওদিন কোনও নীড়ে ফেরা হয়নি তার জরিকে নিয়ে। জরির জন্মের পর থেকেই এ বাড়ি ও বাড়ি বাঁধা কাজে বাধাঁ পড়ে আছে।
কত আর, বারো !খালা, বারো হইব না জরির বয়স?
জরির মা অসহায় তাকায় মার দিকে।
বারো কও কি, ওর তো মনে হয় চোদ্দ পনর হইব।
মা জানেন না কবে জরির জন্ম হয়েছে, জরিকে মা জন্মাতে দেখেননি, মাত্র বছর দুই আগে জরিকে নিয়ে জরির মা এ বাড়িতে উঠেছে। জরির মাকে এ বাড়ির জন্য রেখে জরিকে নানিবাড়িতে দিয়ে এসেছেন মা নানির ফুটফরমাশ করতে। বয়স নিয়ে মা যা বলেন, সবই অনুমান। মা শরীর দেখে বয়স অনুমান করেন। মার এই অনুমান জরির মা সানন্দে মেনে নেয়, জরির বয়স এখন থেকে জরির মা জানে যে চোদ্দ পনর, আর তার নিজের চল্লিশ বিয়াল্লিশ, অথবা পঁয়তাল্লিশ।
জরির মা উঠোনে পড়া ঝরা পাতা ঝরা ডাল ঝরা পালক জড়ো করে পুকুর ধারে আবর্জনার স্তূপে ঢেলে দিয়ে রান্নাঘরে কুপি জ্বেলে ভাত আর বেগুনের তরকারি যখন খাচ্ছে, বারান্দায় বসে হাঁস মুরগির খোপে ফেরার দিকে উদাস তাকিয়েছিলেন মা, মার পায়ের কাছে সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে মাথার ওপরে চক্রাকারে ঘুর্ণি খেতে থাকা সন্ধ্যাৎসবে নৃত্যরত মশককূলের সঙ্গীত আর ডলি পালের বাড়ি থেকে ভেসে আসা উলু ধ্বনির শব্দ শুনতে শুনতে দেখতে থাকি কি করে বিষণ্ন কিশোরির ভেজা চুল বেয়ে টপু টুপ করে জল ঝরার মত আকাশ থেকে অন্ধকার ঝরে আমাদের ঝাঁট দেওয়া মেটে উঠোনটিতে।
টিনের ঘরের পেছনের সেগুন গাছটির দিকে তাকিয়ে মাকে মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করি, সেগুন গাছটার বয়স কত মা?
মা অদ্ভুত চোখে গাছটির দিকে তাকিয়ে বলেন, মনে হয় তিনশ বছর।
মা কি করে সব মানুষ আর গাছপালার বয়স অনুমান করেন, আমি বুঝে পাই না।
মানুষ কেন তিনশ বছর বাঁচে না মা?
মা কোনও কথা বলেন না। আমি ফিরি মার দিকে, নৈঃশব্দের জলের ওপর গাঙচিলের মত উড়তে থাকা মার মুখটি তখন আর আমি দেখতে পাচ্ছি না। বাদুড়ের ডানার মত ঝটিতে এক অন্ধকার উড়ে এসে মখু টি ঢেকে দিয়েছে।
বয়স-ভাবনা সেই থেকে আমাকে ছেড়ে এক পা কোথাও যায়নি। মেট্রিকের ফরমে লেখা তারিখ মত নিজের একটি জন্মদিন করার ইচ্ছে জাগে আমার হঠাৎ, বাবার মন ভাল ছিল বলে রক্ষে, চাইতেই একটি কেক, এক খাঁচা মালাইকারি, এক প্যাকেট চানাচুর, এক পাউন্ড মিষ্টি বিস্কুট, এক ডজন কমলালেবু চলে আসে বাড়িতে। কেকের ওপর মোম জ্বেলে বিকেলে বাড়িতে যারা ছিল তাদের আর একজনই সবেধন নীলমণি অতিথি চন্দনাকে নিয়ে এক ফুঁয়ে মোম নিবিয়ে বাড়িতে ছুরি নেই কি করি রান্নাঘর খুঁজে কোরবানির গরু কাটার লম্বা ছুরি এনে এক পাউন্ড ওজনের কেকটি কাটি। কেকের প্রথম টুকরোটি আমাকে কে মুখে তুলে দেবে গীতা না কি ইয়াসমিন,ইয়াসমিন বলে ইয়াসমিন, গীতা বলে গীতা, গীতা এগিয়ে এলে যেহেতু গীতা এ বাড়ির বউ, বাড়ির বউএর সাধ আহলাদের মূল্য ইয়াসমিনের সাধ আহলাদের চেয়ে বেশি, ইয়াসমিন গাল ফুলিয়ে কেকের সামনে থেকে সরে যায় আর ক্যামেরা আলো জ্বলার আগে গীতা নিজের মুখে মিষ্টি একটি হাসি ঝুলিয়ে আমার মুখে কেকের টুকরো তুলে দেয়, চোখ ক্যামেরায়। কেক কাটা, হাততালি, ক্যামেরার ক্লিক, আর মালাইকারির রসে ভিজিয়ে বিস্কুট আর কেকের ওপরের শাদা ক্রিম জিভে চেটে খেয়ে আমার জন্মদিন পালন হল এবং এ বাড়িতে প্রথম কারও জন্মদিন হল এবং হল সে আমার এবং সে আমার নিজের উদ্যোগেই। চন্দনা তিনটে কবিতার বই উপহার দিয়েছে। রাজা যায় রাজা আসে, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি আর না প্রেমিক না বিপ্লবী। দাদা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। জীবনে ওই প্রথম কিছু উপহার পাওয়া আমার জন্মদিনে। বই থেকে হাত সরে না, চোখ সরে না, মন সরে না। অনেক রাতে মা শুকনো মুখে বললেন, মিষ্টির একটা কোণা ভাইঙ্গা জরির মার হাতে দিলে পারতি। কোনওদিন মিষ্টি খায় নাই। দেখত কিরকম লাগে খাইতে। হঠাৎ খেয়াল হয়, কেবল জরির মা নয়, মার ভাগেও জন্মদিনের খাবার জোটেনি। মা অবশ্য বলেন, এসব না খেলেও মার চলে। কখনও কোনও বিস্কুট বা এক মুঠো চানাচুর মার দিকে বাড়ালে মা বলেন, আমি ত ভাতই খাই। তরা পুলাপান মানুষ, তরা খা। তরা ত পাখির দানার মত ভাত খাস, তগর এইডা ওইডা খাইতে হয়।
আমার জন্মদিন পালন করা দেখে ইয়াসমিনেরও নিজের জন্মদিন পালনের ইচ্ছে হল খুব। কোন মাসে তার জন্ম, কোন তারিখে তা জানতে সে বাবাকে ধরল। বাবা ওকে আজ বলেন তো কাল বলেন, ইয়াসমিনও ঝুলে রইল। মাস দুয়েক ওকে ঝুলিয়ে রাখার পর বাবা একদিন বলে দিলেন নয়ই সেপ্টেম্বর। ব্যস,সেপ্টেম্বরের নয় তারিখ আসার আগেই ইয়াসমিন বাবার কাছে একটা লম্বা লিস্টি পাঠিয়ে দিল, তিনরকম ফল আর দুরকম মিষ্টি, সঙ্গে চানাচুর আর বিস্কুট। ইশকুলের মেয়েদের প্রায় সবাইকে ওর নেমন্তন্ন করা হয়ে গেছে। লিষ্টি পেয়ে বাবা বললেন, জন্মদিন আবার কি? এইসব জন্মদিন টন্মদিন করতে হইব না। লেখাপড়া কইরা মানুষ হও। আমার বাড়িতে যেন কোনওরকম উৎসবের আয়োজন না হয়। মা আবদারের ঝুড়ি উপুড় করেন বাবার সামনে, নিভৃতে। জন্মদিন করতে চাইতাছে, করুক না! মেয়েরা হইল লক্ষ্মী, ওদেরে মাইরের ওপর রাখা ঠিক না। শখ বইলা ওদেরও কিছু আছে। আবদার করছে, আবদারটা রাখেন। মা অনেকদিন থেকেই বাবাকে আপনি বলতে শুরু করেছেন, তুমি থেকে আপনিতে নামার বা ওঠার এত বেশি কারণ যে মার এই আপনি সম্বোধন শুনে বাবা যেমন চমকে ওঠেন না, আমরাও না। তবে তুমি বা আপনিতে, লঘু বা গুরু স্বরে, কেঁদে বা হেসে যে আবদারই করুন না কেন মা, মার আবদারের মূল্য বাবার কাছে যে একরত্তি নেই, এ বাবা যেমন জানেন, মাও জানেন।