মাকে ছেড়ে সবাই চলে যায়। মা একা বসে থাকেন ছেঁড়া শাড়ি, উড়ো চুল রুখো ত্বক নিয়ে। ছেঁড়া তোশকের ওপর ছেঁড়া মশারির তলে সারারাত এপাশ ওপাশ করেন। মার ফুসফুস জুড়ে কফ জমে, মা কফ থুতু ঘরের মেঝেতেই ফেলেন, দেখে আমার ঘেন্না লাগে। মা নিজের জন্য কাউকে চেয়েছিলেন, মানুষ নয়ত পশু পাখি। মানুষ তো থাকেই নি, পশু পাখিও থাকেনি। ভোর বেলা থেকে রাত অবদি মা আমাদের জন্য রান্না করবেন, আমাদের খাওয়াবেন, বাড়ি ঘর গোছাবেন, কাপড় চোপড় ধোবেন, আমরা খাব দাব, হৈ হুল্লোড় করব, আমরা আমাদের লেখাপড়া খেলাধুলা গান বাজনা ইত্যাদি নিয়ে থাকব। মার জন্য কেউ থাকবে না, কিছু থাকবে না। এরকমই নিয়ম। মার কর্তব্য মা পালন করবেন। মা করেনও। সংসারের কাজ কর্ম সেরে মা একা বসে দরুদ পড়েন, আল্লাহর কালামে মন ঢালতে চেষ্টা করেন। আর থেকে থেকে বাবা যে রাজিয়া বেগমকে বিয়ে করেছেন, এ যে মিথ্যে কথা নয় তা বলেন। পীর বাড়ি যেতে আসতে মা নাকি প্রায়ই বাবাকে দেখেন নওমহলের রাস্তায়। আমি ধারণা করি বাবার বিরুদ্ধে মা কথা যা বলেন, বানিয়ে বলেন। বাবা যত দূরের মানুষই হন, বাবার প্রতাপ আর প্রভাবে আমি যতই নুয়ে থাকি, যতই কিল ঘুসি চড় চাপড় খাই, যতই সন্ধিবেতের আর চাবুকের মার পিঠে এসে পড়ে, বাবার প্রতি এক ধরণের শ্রদ্ধা আমার থেকে যায়, সেটি ঘোর দুর্যোগের সময়ও মরে না। মার অভিযোগ শুনেও আমরা রা করি না। যা চোখের সামনে ঘটে না, তা বিশ্বাস করার অভ্যেস অন্তত আমার নেই। মাকে ছিঁচকাঁদুনে অবুঝ একটি মেয়েমানুষ ছাড়া আমার কিছু মনে হয়না। মার বুদ্ধি সুদ্ধি কিছু আছে বলেও মনে হয় না, থাকলে তিনি কেন আল্লাহ রসুলে বিশ্বাস করেন! থাকলে তিনি কেন আমান কাকার সঙ্গে ওরকম একলা ঘরে নসিহতের নাম করে বসে ফিসফিস কথা বলতেন! এবাড়িতে আমান কাকার আসা বন্ধ করে দিয়েছেন বাবা। আমান কাকার বউ এসে একদিন মাকে জানিয়ে যান, তাঁর স্বামী গফরগাওঁ এ চাকরি করছিলেন, ওখানে এক মহিলাকে সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। মা শুনে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলেছেন, বেডার জাত তো, করবই। কোনও বেডার জাতের প্রতি মার কোনও রকম শ্রদ্ধা নেই সম্ভবত। কিন্তু বাবা তু তু করলেই মা যে কেমন মুরগির মত দৌড়ে যান বাবার কাছে!মার বসে থাকা, শুয়ে থাকা, হাঁটা চলা, দৌড়ে যাওয়া সবই বড় বিচ্ছিজ্ঞর লাগে দেখতে।
বাড়িতে সবাই ব্যস্ত বাবা ব্যস্ত রোগী নিয়ে, গ্রামের জমিজমা নিয়ে। দাদা ব্যস্ত চাকরি নিয়ে। ছোটদা ব্যস্ত গীতা নিয়ে, গীতা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে পদার্থবিদ হওয়ার স্বপ্ন বিদেয় করে নৃত্যকলায় মন শরীর সব ঢেলে দিয়েছে। নাচের দলের সঙ্গে বার্মা যাচ্ছে। আমি ব্যস্ত লেখাপড়া নিয়ে। ইয়াসমিনও। মা পড়ে থাকেন একা। কালো কুচ্ছিত হতদরিদ্র মা। কিছু না থাকা মাকে একরকম মানিয়ে যায়। মার যে সায়া থাকলে শাড়ি নেই, শাড়ি থাকলে ব্লাউজ নেই এসব দেখে আমরা অভ্যস্ত মার ফিনফিনে তেলহীন চুল বাতাসে উড়বে, ফিতে না পেয়ে মা পাজামার দড়ি খুলে বা চটের দড়িতে চুল বাঁধবেন, দেখে আমরা মখু টিপে হাসব, আমাদের ওই হাসিতেও অনেকটা অভ্যস্ত আমরা। মা বাড়িতে অনেকটা হাস্যকর পদার্থ। মাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি হাসেন বাবা। চাকরি পাওয়ার পর দাদা মাকে শাড়ি সায়া কিনে দিয়েছেন, কিন্তু বিয়ের কথা ভেবে ভেবে নিজের সংসারের আসবাবপত্র বানাতে বানাতে আর নিজের জামা কাপড় সুটবুট কেনায় দাদাও এমন ব্যস্ত যে মাঝে মাঝেই ভুলে যান যে মার গত ঈদের শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে। মা তাঁর ছেঁড়া শাড়িগুলো নিয়ে গিয়ে নানিবাড়ির পেছনের বস্তি থেকে কাথাঁ বানিয়ে এনেছেন। একটু শীত নামলেই মা কাথাঁ বের করে প্রত্যেকের বিছানায় দিয়ে আসেন। মার কাথাঁর উষ্ণতায় আমাদের এত আরাম হয় যে আমরা সময়ের চেয়ে বেশি ঘুমোই, আর মা তুলো বেরিয়ে আসা ছেঁড়া লেপের তলায়, গা অর্ধেক ঢাকে তো অর্ধেক বেরিয়ে আসে, এপাশ থেকে ওপাশ ফিরলে খাট নড়বড় করে, শুয়ে থাকেন। মা স্বপ্ন দেখতে থাকেন একটি নকশি কাথাঁর, কাঁথাটি বানিয়ে যদি কোনও এক রাতে বাবার শীত শীত লাগা গায়ের ওপর আলগোছে বিছিয়ে বাবাকে চমকে দিতে পারতেন! বাবা অবশ্য মার কোনও কিছুতে চমকান না। মা খুব চমৎকার খিচুড়ি রাধঁলেও না, মাথায় তেল দিয়ে ভাল একটি শাড়ি পরে, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে মিষ্টি হেসে সামনে এলেও না। চাঁদনি রাতে জানালায় বসে ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত, আসে নি তো বুঝি আর জীবনে আমার! গাইলেও না। বাবার মন মায়ে নেই। মা বোঝেন তা। আমরাও বুঝি। সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনির মাঝখানে কখনও কখনও ক্লান্ত শুয়ে থাকেন তিনি। মার শুয়ে থাকা দেখলে বাবা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেন। এভাবে শুয়ে থাকলে সংসার উচ্ছন্নে যাবে বাবার ধারণা। বাড়িতে চোর ঢুকে সব নিয়ে যাবে। কাজের মানুষগুলো কাজে ফাঁকি দেবে, চুরি করে মাছ মাংস খেয়ে ফেলবে। মেয়েরা পড়াশোনা রেখে আড্ডা পেটাবে। বাবার অমন বাড়ি মাথায় করা চিৎকারের দিনে মা একদিন শুয়ে থাকা থেকে নিজের শরীরটি টেনে তুলে বলেন,পাইলসের রক্ত গেছে অনেক। শইল কাহিল হইয়া গেছে। বাবা শুনে বলেন, ঢং দেইখা বাচি না।
মা অনেকদিন বাবাকে খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করেছেন, পাইলসের কি কোনও চিকিৎসা নাই?