গলা কই মানে?
তোমার ত গলা নাই। তোমার থুতনি সোজা নাইমা গেছে বুকে। আর তোমার কাধঁ ও ত নাই, ব্লাউজও তাই পিছলাইয়া পইরা যায়।
শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে মন্তব্য সংসারে নতুন নয়। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি শরীরের কোন অঙ্গ দেখতে কেমন, চোখ নাক কান ঠোঁট, শরীরের দৈর্ঘ্য প্রস্থ, ত্বকের রং ইত্যাদি নিয়ে আত্মীয়দের গভীর আলোচনা এবং তুলনা। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেও তা্ই হয়, অনেকদিন পর হয়ত আমাকে কেউ দেখলেন, দেখেই বলেন বাহ মেয়ে তো বেশ লম্বা হইতাছে। বাপের মত গড়ন পাইছে। অথবা কি ব্যাপার এত কালা হইতাছে কেন ও! চোখ নাক কানের দিকেও তীক্ষ ্ন দৃষ্টি ছুঁড়ে মন্তব্য করেন কোনটি ভাল কোনটি মন্দ, বাবার মত নাকি মার মত, নাকি মার বংশের বা বাবার বংশের কারও মত। মাও বলেন, ইয়াসমিনের হাত পাগুলা ওর ফুপুদের মত হইছে। রুনুখালা ঢাকা থেকে বেড়াতে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন ইস চোখগুলা এক্বেবারে বড়বু। চুলগুলা তো বড়বুই। মা নিঃশব্দে অনেকক্ষণ শরীরের খুঁত নিয়ে আমাদের খুঁতখুঁতুনি আর অভিযোগ শুনে বলেন, হ আমি ত পচা। আমি কালা। দেখতে খারাপ। তরা ত সুন্দর। তরা সুন্দর হইয়া থাক।
বাড়িতে গোসলের সাবান এলে মা তা ছেলেমেয়েদের জন্য রাখেন, নিজের জন্য জোটে না। গা থেকে গন্ধ বেরোলে কাপড় ধোয়ার সাবান দিয়ে গোসল সারেন। মাস চলে যায়, বাবা নারকেল তেল পাঠান না। খড়ি নেই, মা চুলো ধরান নারকেলের পাতা আর ডাল শুকিয়ে। এগুলোতে আগুন ভাল ধরে না কিন্তু বাবা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, নারকেলের ডাউগ্যা আর পাতা পুতা দিয়াই রানতে হবে। খড়ির দাম অনেক। খড়ির দাম অনেক বলে মাকে গাছ থেকে পড়া পাতা জড়ো করে রাখতে হয়। ডাবঅলা রশিদ এসে তাড়া খাওয়া কাঠবেড়ালির মত দ্রুত উঠে যায় নারকেল গাছে, দড়ি বেঁধে ডাব নারকেল মাটিতে ফেলার পর গাছগুলো সাফ করে দেয় বিনে পয়সায়। বাড়ির ডাব কিনে নিয়ে বাজারে লাভে বিক্রি করার কাজ রশিদের। রশিদ তিন চার মাস পর পর আসে এ বাড়িতে ডাব কিনতে। উঠোনে মাঠে নারকেল পাতার সপ্তূ হয়ে থাকে রশিদ গাছ পরিষ্কার করে যাওয়ার পর। সেইসব বিশাল বিশাল নারকেলের ডাউগ্যার কিনারে বটি নিয়ে বসে মা একটি একটি করে শলা বের করে উঠোন ঝাঁট দেবার, পায়খানা পরিষ্কার করবার, বিছানার ময়লা তাড়াবার ঝাঁটা বানিয়ে শলাহীন পাতা আর ডাউগ্যা কেটে জড়ো করে রাখেন। বৃষ্টি এলে উঠোনে শুকোতে দেওয়া নারকেলের ডাল পাতা, কাঁঠাল পাতা,আমপাতা, জামপাতা সব দৌড়ে দৌড়ে রান্নাঘরের বারান্দায় তোলেন। মার ছেঁড়া শাড়ি আরও ছিঁড়তে থাকে। মার বিছানার পুরোনো তোশক ছিঁড়ে শক্ত শক্ত জমা তুলো বেরিয়ে গেছে, তোশকের একদিকে ভারি, আরেক দিকে হালকা, শুলে মনে হয় রেললাইনের পাথরের ওপর শুয়েছি। একটি নতুন তোশকের কথা অনেকদিন ধরে বলছেন মা, কিন্তু মার বলায় কার কি আসে যায়! মার মশারির ছিদ্রগুলো বড়, আমাদের মশারিতে ছিদ্র নেই বললে ঠিক হবে না, আছে, তবে ছোট। আমাদের মশারির ছিদ্রগুলো বুজে দিয়েছেন মা। বড় ছিদ্র বোজা সম্ভব হয় না, মার গায়ে মশার কামড়ের দাগ ফুটে থাকে প্রতিদিন। মা একটি নতুন মশারির কথা কয়েক বছর ধরে বলেন, বাবা রা করেন না। মশারি যখন আসে শেষ অবদি, সেটি আমাদের খাটে টাঙিয়ে নিজে তিনি পুরোনো ছিদ্রঅলা মশারি টাঙান নিজের খাটে।
বাড়িতে রান্না হচ্ছে, একদিন নুন আছে তো আরেকদিন পেঁয়াজ নেই, পেঁয়াজ আছে হলুদ নেই, হলুদ আছে তো তেল নেই। নেই শুনলেই বাবা ধমকে ওঠেন, পরশুদিন না তেল কিইন্যা দিলাম, তেল গেছে কই?
রান্ধায় লাগছে।
দুইদিনের রান্ধায় এক বোতল তেল শেষ হইয়া যাইব?
দুইদিন না, দুই সপ্তাহ আগে তেল কিনা হইছিল।
দুই সপ্তাহেই বা এক বোতল শেষ হইল কেমনে?
কম রান্ধা?
রান্ধা বন্ধ কইরা দেও। দরকার নাই রান্ধার আর।
আমার লাইগা চিন্তা করি না। পুলাপান কি খাইব?
পুলাপানের খাওন লাগব না। পুলাপান আমারে সুখ দিয়া উল্ডাইয়া দিতাছে। এমন পুলাপান থাকার চেয়ে না থাকা ভাল।
মার জীবন আমাকে কোনও রকম আকর্ষণ করে না, করে বাবার জীবন। বাবার ক্ষমতা অনেক, বাবা ইচ্ছে করলে আমাদের সবকটাকে উপোস রাখতে পারেন, ইচ্ছে করলে সবকটাকে ভরপেট সখু দিতে পারেন। ইচ্ছে করলে সারা বাড়িকে ভয়ে তটস্থ করে রাখতে পারেন, ইচ্ছে করলে হেসে কথা বলে সবাইকে অমল আনন্দ দিতে পারেন। মার ইচ্ছেতে সংসারের কিছুই হয় না। মার জগতটি খুব ছোট। ছেঁড়া শাড়ি ছেঁড়া মশারি ছেঁড়া লেপ ছেঁড়া তোশক আর মাটির চুলোয় ফুঁকনি ফোঁকা তেল হীন সাবানহীন জীবন মার। এই জীবন নিয়ে তিনি দৌড়োন পীর বাড়ি, কখনও কখনও নানির বাড়ি। এ দুটো বাড়ি ছাড়া মার আর কোনও বাড়ি নেই যাওয়ার। বাড়িতে মার নিয়মিত অতিথি বলতে এক নানা। নানা যখন দুপুরবেলার দিকে আসেন, মা নানাকে গা মেজে গোসল করিয়ে ভাত খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন। বাবা বাড়ি আসার আশংকা না থাকলেই নানাকে খেতে বসান মা। আমরাও যদি দেখে ফেলি নানা খাচ্ছেন, মা অপ্রস্তুত হন, কিছু বলার আগেই তিনি বলেন, আমার ভাগেরটা বাজানরে খাওয়াইতাছি। বাড়িতে তো পীরবাড়ির কেউ আসেই না আর, ওরা আর যে বাড়িতেই যাক, কোনও কাফেরের বাড়িতে যাবে না। বাড়িতে কোনও মামা খালা এলে বাবা কটমট করে তাকান। বাবা যে ওদের কারও আসা পছন্দ করেন না, সে মা কেন, আমরা সবাই বুঝি। মার আত্মীয় কেউ বাড়ি এলে বাবা কাজের মানুষকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জানতে চান, মা কিছু দিয়েছেন কি না ওদের হাতে। কিছু খাইয়েছেন কি না, খাওয়ালে কি খাইয়েছেন, এসব। কাজের মানুষও বোঝে, এ বাড়িতে মার আত্মীয়রা অনাকাঙ্খিত ছটকু পীর বাড়িতে ঢুকে নতুন মুন্সি হয়েছে। ইয়া লম্বা পাঞ্জাবি আর টুপি পরে একদিন এসেছিল অবকাশে, বাবা ঘাড় ধাককা দিয়ে বের করে দিয়েছেন। মার জগতের মানুষেরা যখন এ বাড়িতে নিগৃহীত হতে থাকে, মা একা হয়ে যান। তিনি তাঁর জগত বাড়াতে থাকেন পশুপাখিতে। মার শখ হয় মুরগি পালার। বাবার কাছে মার আবদার প্রতিদিনই চলতে থাকে, বাবার হাত পা পিঠ সর্ষের তেল মেখে টিপে দিতে দিতে। বাবা অবশ্য একে আবদার বলেন না, বলেন ঘ্যানর ঘ্যানর। কেন, মুরগি দিয়া কি হইব? মুরগি ডিম পাড়ব, সেই ডিম পুলাপান খাইতে পারব, ডিম ফুইটা বাচ্চা হইব, সেই বাচ্চা বড় হইব। মার স্বপ্ন শেষ অবদি সফল হয়, এক মুরগি থেকে দশ মুরগি হলে যে বাবারই লাভ, তা যখন তিনি বুঝলেন, চারটে মুরগি কিনে দিলেন মাকে। মা সেই মুরগিগুলোর জন্য নিজে হাতে খোঁয়াড় বানালেন। সকালে উঠে খোঁয়াড় খুলে মুরগিদের খুদ কুঁড়ো খেতে দেন। উঠোন জুড়ে মুরগি হেঁটে বেড়ায়, হেগে বেড়ায়। মা অপেক্ষা করেন, মুরগি একদিন ডিম দিতে বসবে। বাবার খাটের তলায় চটের ওপর বিছানো পেঁয়াজ থাকে, আলু থাকে। সেই পেঁয়াজ আলুর পাশে মা একটি ডালা পেতে দিলেন, খড় বিছানো সেই ডালায় লাল একটি মুরগি সারাদিন বসে থাকে। একদিন দেখি ঘর বারান্দা উঠোন জুড়ে একটি মা মুরগির পেছনে অনেকগুলো বাচ্চা মুরগি হাঁটছে। বাচ্চাগুলো দেখতে এত সুন্দর, হাতে নিতে ইচ্ছে করে। হাতে নিলে মা বলেন বাচ্চা বড় হবে না। মার খুশি উপচে পড়ে মুরগির বাচ্চাগুলো দেখে। কিন্তু বারোটা বাচ্চা মা গুনে গুনে খোঁয়াড়ে তোলেন, দেখা যায় পরদিন দুটো বাচ্চা নেই। উঠোনে মা মুরগির পেছনে যখন হাঁটছিল, এক ফাঁকে চতুর বেজি ধরে নিয়ে খেয়েছে। টিনের ঘরের পেছনে কোনও এক গর্তে বেজি থাকে, হঠাৎ হঠাৎ ওদের দৌড়োতে দেখি। মার ইচ্ছে হয় হাঁস পালতে। বাবা হাঁসের বেলাতেও দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, আবার হাঁস কেন? হাঁস যে কেন, মাকে তাও বোঝাতে হয় অনেক সময় নিয়ে। বাবা নাকচ করে দিলেন মার প্রস্তাব। মা নানার কাছে পাড়লেন। নানা দুটো হাঁস কিনে নিয়ে এলেন। শাদা হাঁস, বাদামি হাঁসি। বাড়িতে যখন হাঁস এল, বারোটি মুরগির বাচ্চার মধ্যে দুটি কেবল বেঁচে আছে। বাকিগুলো অসুখে, কুকুরে আর বেজিতে ফুরিয়েছে। হাঁসি ডিম দিল। সে ডিমের ওপর মা লাল মুরগিটিকে বসিয়ে দিলেন। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলো হাঁসের। হাঁস যায় বিলে সাঁতার কাটতে। রান্নাঘরের পেছন দিকে বাড়িঘেরা দেয়ালে মেথর আসার ছোট্ট কাঠের দরজাটি পেরোলেই বাঁদিকে প্রফুল্লর বাড়ির পায়খানা, ডানে কচুরিপানায় ঠাসা ঘোলা জলাশয়, একে পুকুর বললেও অতিরিক্ত হয়, বিল বললেও আসলে ঠিক মানায় না কিন্তু এটি বিলই, একধরণের বিল, মাছহীন ময়লা কাদা সাপ জোঁকের বিল। হাঁসের বাচ্চাগুলো মুরগির বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে, একরকম দেখতে, রংও একই রকম হলুদ। কোনটি হাঁসের, কোনটি মুরগির ঠিক ঠাহর করা যায় না। হাঁস মুরগি বেশি দিন টেকেনি মার।ডিম ভেজে দিতে হয় বাড়ির মানুষকে। মুরগির বাচ্চা খানিকটা বড় হলেই দাদা বলেন, বেজিই তো খাইয়া ফেলব, তার চেয়ে বেশি কইরা পিঁয়াজ দিয়া আমার লাইগা একটা মুরগি ভুনা কইরা দেন মা। মা মুরগি রাঁধেন আর আড়ালে চোখের জল মোছেন। বাড়িতে অতিথি এল, কি খাওয়ানো যায়? কিছুই তো নাই, ঠিক আছে, মুরগি জবো করা হোক। মা উঠোনে খেলতে থাকা মুরগিরগুলোর দিকে স্বপ্ন-চোখে তাকিয়ে বলেন,পালা মুরগি আবার জবো করে কেমনে? দাদা বলেন, গলাডার মধ্যে আল্লাহু আকবর কইয়া বটির পুচ মাইরা জবো করে মা। এক্কেবারে সোজা। শেষ অবদি মার পালা মুরগি দাদার রসনা তৃপ্ত করতে, আমাদের পেট ভরাতে আর অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহার হতে থাকে। মা পালা মুরগি বা হাঁসের একটি টুকরোও মুখে দেন না, আলু ভর্তা করে খেয়ে ওঠেন। হাঁস মুরগির খোঁয়াড় খাঁ খাঁ করে মাস না যেতেই। কেবল হাঁস মুরগি নয়, মার গাছের লাউ, সীম, কুমড়ো, ফুলকপি বাধাঁকপি, টমেটো, পুঁইশাক খেতে থাকি আমরা। চাল ডাল তেল নুন ছাড়া বাজার থেকে মাস যায় বছর যায় তেমন কিছু আনার প্রয়োজন হয় না। বাবার খরচ বাঁচান মা। ছেঁড়া শাড়ি, উড়ো চুল, রুখো ত্বকের মা সংসারে আয়ের পথ খোলা রেখেছেন। বাবা বাড়িতে যে ফলই নিয়ে আসেন, মা সে ফলের বিচি মাটিতে পুঁতে রাখেন। পোঁতা বিচি থেকে ডালিম গাছ, ফজলি আমের গাছ, জামরুল গাছ, লাল পেয়ারার গাছ, লিচু গাছ সবই গজাতে থাকে। হাঁস মুরগির শোক থেকে একদিন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দুটো ছাগলের বাচ্চা আনলেন মা, মানুষের বাচ্চার মত ছাগলের বাচ্চাদুটোকে বোতলে দধু খাইয়ে বড় করে তুললেন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাগলদুটো মার ফলের গাছ গুঁড়িসুদ্ধ খেয়ে ফেলতে লাগল, মা বেড়া দেন, বেড়া ডিঙিয়ে ছাগল তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। মা মরিয়া হয়ে ওঠেন গাছ বাঁচাতে, আবার ছাগলদেরও সুখী রাখতে। ছাগলদুটোর নাম রাখা হল, লতা আর পাতা। লতা আর পাতা লতা-পাতা খেয়ে চমৎকার জীবন যাপন করছে। এমন আদর মার লতা আর পাতার জন্য, রাতে উঠোনে বা বারান্দায় ঘুমোলে কে আবার কামড় দেয় ওদের, নিজের ঘরে এনে রাখেন। ছাগলের ভ্যা ভ্যা গু মুতে মার ঘর ভেসে থাকে। কাঁঠাল গাছে উঠে লতা পাতার জন্য কাঁঠাল পাতা পেড়ে দেওয়ার কাজ আমি নিজে চেয়ে নিই। কাঁঠাল পাতা লতা খায় তো পাতা খায় না। ওর মখু টি বড় উদাসীন দেখতে লাগে। ওর পাতা নাম ঘুচে যায় আমি যখন ওকে বৈরাগি বলে ডাকতে শুরু করি। বৈরাগি একদিন হারিয়ে যায়। মাঠে ঘাস খাচ্ছিল, ফটক খুলে বাড়িতে কেউ এসে খোলাই রেখেছে ফটক, ফাঁক পেয়ে বৈরাগি সত্যিকার বৈরাগি হয়ে ঘর সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। পাড়াসুদ্ধ খোঁজা হয়। নেই। আকুয়ার গরুর খোঁয়াড়ে, যেখানে ছাড়া-গরু ছাড়া-ছাগল রাস্তাঘাটে পেলে জমিয়ে রাখা হয়, খুঁজে এলেন মা, নেই। মা চোখের জলে নাকের জলে ডুবে নদীর পাড়ে বুড়া পীরের মাজারে গিয়ে টাকা পয়সা ঢেলে মোমবাতি জ্বেলে পীরের দোয়া চেয়ে এসেছেন যেন বৈরাগি বৈরাগ্য ভুলে ঘরে ফিরে আসে। এই বুড়া পীরের মাজারটি অদ্ভুত এক মাজার। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একটি খোলা ঘরের প্রায় সবটা জুড়ে লাল কাপড়ে মোড়া বিশাল একটি বাঁধানো কবর, সকাল সন্ধ্যা মানতকারীদের ভিড়। বুড়া পীর কে ছিলেন, কি করতেন, কবে মরেছেন, কেন তার কবরে লোকে মোম আর আগরবাতি জ্বেলে নিজের ইচ্ছের কথা শুনিয়ে আসে, মাকে জিজ্ঞেস করি। বুড়া পীর লোকটি কি মৃত্যুর ওপার থেকে কারও সাধ আহলাদ মেটাতে পারেন, যদি পারেন কি করে পারেন? আমার এই কঠিন প্রশ্নটির খুব সরল একটি উত্তর দেন মা, নিশ্চয়ই পারেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই উনারে ক্ষমতা দিছেন পারার, না পারলে এত লোক যায় কেন মাজারে! হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই যায়। পীর মুসলমান ছিলেন, কিন্তু হিন্দুর ভিড় ওখানে মুসলমানের চেয়ে কম নয়।মার বিশ্বাস যত গভীরই হোক, বুড়া পীরে কাজ হয় না, বৈরাগি আর ফেরে না। লতা তার সঙ্গী হারিয়ে নিজেও উদাস হতে থাকে দিন দিন। বারান্দায় লতার গু মুত দেখে বাড়ির সবাই বিরক্ত কিন্তু মার কিছুতে বিরক্তি নেই। নিজে হাতে তিনি গু মুত সাফ করেন, লতাকে উঠোনে বেঁধে রাখেন, মাঠে বাধঁ লে আবার যদি খোলা ফটক পেয়ে বৈরাগির মত সেও বৈরাগ্য বরণ করে! হরিণের রঙের মত রঙ লতার, শিং আরও পেঁচিয়ে ওপরে উঠলে হরিণ বলেই মনে হত, মা বলেন। মাকে বলি, আবার হরিণ পালার শখ কইর না যেন। মা বড় শ্বাস ছেড়ে বলেন, হরিণ কি আর পোষ মানার প্রাণী! মার এত আদরের লতা, পুত্রবৎ স্নেহে যে বাচ্চাকে ছাগল করে তুলেছিলেন, সেও বৈরাগির মত একদিন নেই হয়ে গেল। মা লতার দুধের বোতল, লতার দড়ি, খুঁটি, আধখাওয়া কাঁঠাল পাতা সামনে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। মার শোক তখনও সম্পূণর্ ফুরোয়নি, বাড়িতে দেখি একটি লাল রঙের গরু। মা এনেছেন। গরু কোত্থেকে এল, গরু কেন এল বাবা এসব কোনও প্রশ্নে গেলেন না। সম্ভবত গরুর প্রতি মায়া বাবার সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল বলে গরুর এ বাড়ি থাকা চলবে না এরকম কোনও আইন জারি করলেন না। এই গরু কোনও একদিন বাছুর বিয়োবে, সের সের দধু দেবে, অথবা বড় হলে এটিকে ভাল দামে বিক্রি করা যাবে বাবা সম্ভবত এরকমও ভেবেছিলেন। মা মহা উৎসাহে গরুকে গোসল করানো, খাওয়ানো, গরুর গা থেকে মাছি তাড়ানো, এমনকি গরুর যেন ঠাণ্ডা না লাগে পিঠে পুরোনো একটি কম্বল বিছানো—সবই করতে লাগলেন। দধু ওয়ালি ভাগীরথীর মাকে ডেকে প্রতিদিন এক খাঁচা করে ঘাস আনার ব্যবস্থা করলেন। গরুর জন্য ভাল একটি খুঁটি নিজেই বানিয়ে নিলেন। গরুর নাম মা রাখলেন ঝুমুরি। ঝুমুরিকে তিনি কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবেন না। কিন্তু দিন যায়, ভাগীরথীর মার খাঁচায় ঘাস কমতে থাকে। ঝুমুরির খাদ্য যোগাতে মা অস্থির হয়ে পড়েন। মাঠে যা ঘাস ছিল, সবজির বাগান করে ফেলার পর ঘাস বলতে কিছু নেই। ঝুমুরিকে শেষ অবদি ঘাগডহরে আবদুস সালামের বাড়িতে লালন পালনের জন্য দিলেন মা। গ্রামের মাঠে অঢেল ঘাস আছে, সালামের বাড়ির অন্য গরুর সঙ্গে ঝুমুরিও মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে খাবে, হৃষ্টপুষ্ট হবে। ঝুমুরিকে রাখার জন্য মা সালামের হাতে কিছু টাকা পয়সাও মাসে মাসে দিতে থাকেন, নিজেও ঘাগডহরে প্রায়ই তাঁর আদরিণীকে দেখে আসেন, গায়ে হাত বুলিয়ে আসেন। দিন যায়, সালাম একদিন মখু মলিন করে বলে, গরু চুরি হইয়া গেছে। মার কিছুই থাকে না, সব চলে যায়। গরু চুরির পর মা কবুতর নিয়ে পড়লেন। প্রথম শাদামাটা বাজারের কবুতর নিয়ে এলেন। মা তো আর ইচ্ছে করলেই কিছু নিয়ে আসতে পারেন না। মাসের পর মাস স্বপ্ন দেখেন, বাবার কাছে আবদার করেন, বাবা আবদার ফিরিয়ে দিলে তিনি তাঁর নিজের আত্মীয়দের কাছে আবদার করেন, তাতেও ব্যথর্ হলে শেষ অবদি ধারই করেন। ধার শোধ করাও মার পক্ষে চাট্টিখানি কথা নয়। নিজের গাছে যে কটি ডাব হয় তা রশিদের কাছে বিক্রি করে মার টাকা শোধ করতে হয়। মা যে ডাবগাছগুলো লাগিয়েছিলেন এ বাড়িতে আসার পর, সেসব গাছ বড় হয়ে ডাব ধরার পর বাবাই অন্য গাছগুলোর ডাবের মত মার লাগানো গাছের ডাব বিক্রি করে নিজের পকেটে পয়সা ঢোকাতেন। মা মুরগি পালার পর থেকে নিজের লাগানো গাছগুলোর ডাব তিনি নিজে বিক্রি করতে পারবেন, এই অধিকারটি দিনরাত লেগে থেকে নেন। শাদামাটা কবুতরদুটো পরদিনই উড়ে চলে গেল, মা উন্মুক্ত আকাশটির দিকে সারাদিন উন্মখু তাকিয়ে ছিলেন হাতে খাবার নিয়ে, বাকবাকুম বাকবাকুম বলে ওদের ডেকেছেন অনেক, কেবল তাই নয়, অনেক রাত অবদি বারান্দায় বসে ছিলেন, পাখিরা রাত হলে নীড়ে ফেরে, যদি ফেরে এই আশায়। যদি বাড়ির পথ চিনতে ওদের ভুল হয়ে থাকে, রাত বিরেতে চিনে আবার ফিরতেও তো পারে, মা আশা ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন। ওরা ফেরেনি। বাইরের বারান্দার ওপর ঢেউ খেলানো খোপে জালালি কবুতরের বাসা। কবুতরের গুয়ে শাদা হয়ে থাকে বারান্দা। অনেকদিন কবুতরগুলোকে তাড়াতে চেয়েছি, মা বলেছেন, জালালি কবুতর থাকলে সংসারে শান্তি থাকে, ওদেরে তাড়াইবি না। হাতের নাগালে ওদের একটিকে পেয়ে খপ করে ধরে দাদা মাকে ডেকে একদিন বললেন, জালালি কবুতরেরা বড় জালাইতাছে মা,এইটা রোস্ট কইরা দেন, খাই। মা দাদার হাত থেকে কবুতর কেড়ে নিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বলে দিলেন, জালালি কবুতর খাইতে হয় না। তর লাইগা অন্য কবুতর রাইন্ধা দিব নে, এদেরে খাইস না কোনওদিন। জালালি কবুতরের মনে কষ্ট দিলে সংসারের শান্তি জন্মের মত চইলা যায়। শাদামাটা কবুতরগুলো চলে যাওয়ার পর মোজাপরা টোপর পরা চমৎকার এক জোড়া কবুতর নিয়ে এলেন মা। এ জাতের কবুতর পাওয়া যায় না, মা মুল্লুক ঘুরে এদের এনেছেন। কবুতরের জন্য রান্নাঘরের চালের তলে কাঠের একটি ঘর বানিয়ে দিলেন মা, ঘরে ছোট্ট একটি দরজা, দরজা খুলে বেরোলে এক চিলতে বারান্দা। বারান্দায় ছোট একটি বাটিতে খাবার থাকে, কবুতরদুটো বাক বাকুম বলে ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার খায়। এবারেরগুলোয় মা পাখনা বেঁধে দিয়েছেন যেন খুব বেশিদূর উড়তে না পারে। কবুতরগুলোকে ওড়া থেকে বঞ্চিত করার কোনও ইচ্ছে মার নেই, মা চান ওরা মার হাত থেকে খাবার খাক, উঠোনের গাছ গাছালিতে বসুক, উঠোন শাদা করে হাঁটুক, উড়ুক, উড়ুক কিন্তু বেশিদূর না যাক, বেশিদূর গেলেও বাড়ির পথ চিনে সন্ধের আগে আগে কাঠের ঘরটিতে ফিরে আসুক। কবুতরদুটো ডিম পাড়ল, বাচ্চাও ফোটালো, বাচ্চাগুলোকে বেজি নিয়ে গেল, কাকে খেলো, তারপর মোজা পরা টোপর পরা ভাল জাতের দুটো কবুতর মনের দুঃখে বসে থেকে থেকে অসখু বাঁধালো শরীরে। মা অসখু সারাতে পারেননি। কবুতর মরে যাবার পর বাবা বললেন, এই অলক্ষুণ্যা মাগির কাছে কিছুই থাকে না। সব যায় গা। তা ঠিক, মার কাছে কিছু থাকে না, সব মাকে ছেড়ে চলে যায়। বারান্দার খোপে জালালি কবুতর তখনও বাকুম বাকুম দিন কাটায়। ওদের দেখলে দাদার মত আমারও খেতে ইচ্ছে করে। বাবা বাড়িতে মাস যায় কোনও মাছ মাংস পাঠান না। শাক সবজি আর শুটকি খেতে খেতে রীতিমত বিরক্ত আমি, মাকে জানাই এখন জালালি কবুতর রাঁধা ছাড়া আর উপায় নেই। ছেলেমেয়ের কিছু খেতে ইচ্ছে হলে মা যে করেই হোক সে জিনিস খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। একদিন পেয়ারা খেতে ইচ্ছে করছিল, পেয়ারার দিন নয় তখন অথচ মা শহর ছাড়িয়ে কোন এক গ্রামে এক সামান্য চেনা মহিলার বাড়ি গিয়ে, শুনেছিলেন সে মহিলার বাড়ির গাছে অসময়ের পেয়ারা জন্মায়, কিছু পেয়ারা নিয়ে এসেছিলেন আমার জন্য। কিন্তু আমার কবুতর খাওয়ার ইচ্ছের গোড়ায় মা মোটেও জল ঢালেন না। আমার ইচ্ছের পাশ কাটিয়ে তিনি চলে যান। সংসারের শান্তি তিনি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবেন না।