রুদ্রর দগুালে দুহাত রেখে হেসে উঠি। আঙুলের আদর দিয়ে সারা মুখে, বলি, তোমাকে ভালবাসি তাই।
ভালবাসো তাহলে চলে গেলেই বা কেন? আর চলেই যদি গেলে তাহলে এলেই বা কেন?
তুমি ডাকলে যে।
আমি ডাকলেই বা কি? আমার সঙ্গে তো তুমি কোনও সম্পর্কে রাখোনি।
আমি তো এখনও নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছি।
যুদ্ধ কেন?
নিজেকে যেন ভালবাসতে পারি। অন্যকে ভালবাসতে ভালবাসতে এই হয়েছে যে নিজেকেও যে ভালবাসা উচিত, সেটি ভুলে গিয়েছিলাম।
আমার বুকে মাথা রেখে ছোট্ট শিশুর মত শুয়ে থাকে রুদ্র। চুলে আঙুল বুলিয়ে দিই। বলে, চল উকিলের কাছে আবার। তালাকের কাগজটি তিনি যেন তৈরি না করেন।
আমি ম্লান হাসি।
সে রাতে কেঁপে জ্বর আসে আমার। পরদিনও জ্বর হু হু করে কেবলই বাড়ে। দুপুরবেলা আমার ওই জ্বর-শরীরের পাশ থেকে রুদ্র উঠে যায় কারও পায়ের আওয়াজ পেয়ে। কে যেন দরজায় কড়া নাড়ে, কে নাড়ে, কে জানে! পাশের ঘরে অতিথির সঙ্গে কথা বলছে রুদ্র। একটু জলের জন্য কাতরাই, রুদ্র নেই। ঘন্টা দুই পর সে ফেরে, খানিকক্ষণের জন্য।
কে এসেছে?
নেলি।
সেই নেলি! রুদ্রর নেলিখালা।
রুদ্র আর নেলির টুকরো টুকরো কথা, হাসি, অট্টহাসি, ফিসফিস, খিলখিল ভেসে আসে শোবার ঘরে। আমি সব নিয়ে জ্বরে ভুগি। মনে হতে থাকে রুদ্র আজও নেলিকে ভালবাসে। কিছু কিছু ভালবাসা আছে, সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও, থেকে যায়। জ্বর আমাকে যত না কাপাঁয়, তার চেয়ে বেশি কাপাঁয় নিঃসঙ্গতা। আরও ঘন্টা দুই গেলে রুদ্র যখন নেলিকে বিদেয় দিয়ে ফিরে আসে শোবার ঘরে, আমি জ্বর-কণ্ঠে জড়-কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, নেলি কি করে জানল এ বাড়ির ঠিকানা?
আগে এসেছে।
প্রায়ই আসে বুঝি।
প্রায়ই না। মাঝে মাঝে।
ও।
আমার কি সামান্য ঈর্ষা হয়! হয়। প্রলাপের মত শোনায় যখন বলতে থাকি যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি আর আমার থাকো না, তুমি হও যার তার খেলুড়ে পুরুষ। যার তার পুরুষকে আমি আমার বলি না।
প্রলাপের মত শোনায় যখন বলতে থাকি, ফুলশয্যা কাকে বলে আমি জানি। কাকে বলে সারারাত জেগে থাকা বন্দরের ভয়ানক রাত। আমি জানি, আমার হাড় মাংস জানে, জানে বন্দরের সব কটি সাম্পান মাঝি, জানে কা−র্গার শ্রমিক, ভোরের লঞ্চ জানে, তুমিও কি কিছু কম জানো? ভালবাসা কতটুকু সর্বনাশা হলে সাঁতার না জানা দেহ রূপসার জলে ভেসে ফের ফিরে আসে। দিগন্তের ওইপার থেকে ফের, চতুর্দোলায় দুলে, দ্বিধার আগুনে পুড়ে ফের, নর্দমায় পড়ে থাকা মাতালের অপুষ্ট বাহুতে মুখ রেখে আরেকবার কেঁদে উঠতে ফের ফিরে আসে, বানিশান্তা থেকে তুলে আনা পুঁজ রক্ত চুমুকে চুমুকে নিতে ফিরে আসে ভিনদেশি বেভুল বালিকা। তুমি মদে চুর, তুমি ঘুমে ঘোর, তবু তুমি কিছু কম জানো না, তোমাকে ভেলায় তুলে আমি বেহুলা হয়েছি কতবার কত ক্লান্ত যমুনায়।
যেদিন জ্বর সারে, দুজন বাইরে বেরোই। সেই আগের মত বেরোই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে কিছু তরুণ কবির সভা বসেছে। সভায় আমাদেরও অংশ নেওয়ার কথা। বসে যাই ঘাসে, সেই আগের মত ঘাসে। এরশাদের এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজনের প্রতিবাদে পাল্টা একটি কবিতা উৎসব তৈরি করার জন্য সভাটি। কিছু তরুণ কবি, আমি, রুদ্র জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রথম সভার উপস্থিত সদস্য হিসেবে কাগজে সই করি। এসবে রুদ্র অত্যন্ত উৎসাহী। বহুদিন থেকে স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে কবিতা লিখছে, এবার একটি মোক্ষম অস ্ত্র তার হাতে, এক উৎসব দিয়ে আরেক উৎসব ঠেকানো। গুটিকয় হাতে গোনা সরকারি আর ইসলামপন্থী কবি এরশাদের দলে ভিড়েছে, বাকি সব জাতীয় কবিতা উৎসবে। এরশাদ ওই গুটিকয় নিয়েই নিজের কবিতা উৎসবের নাম দিয়েছেন এশীয় কবিতা উৎসব। এশীয়র আয়োজন বন্ধ ঘরে, জাতীয় খোলা রাস্তায়। এশীয় ঢুকে যায় কুয়োয়, জাতীয় সাঁতার কাটে সমুদ্রে।
জাতীয় কবিতা উৎসব নিয়ে রুদ্রর উৎসাহ যখন চরমে, এদিক ওদিক ছুটোছুটির করতে চায় সে, পারে না। ছুটোছুটি তো দূরের কথা, হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা হয়, আগে দশ গজ হাঁটলে হত, এখন চার গজেই হয়। দিন দিন কমে আসছে দূরত্ব। রুদ্র তবু দমে যায় না, থেমে থেমে হলেও হাঁটে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটির রং বদল হচ্ছে, কালচে হয়ে আসছে, ঠাণ্ডা হয়ে আসছে কালচের ত্বক। যেন আঙুল নয়, গাছের শেকড় এটি। রোগটি নিশ্চিত বারজারস ডিজিজ। আঙুলে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেলে পা কেটে ফেলা ছাড়া আর উপায় নেই। আশংকায় নীল হয়ে থাকি। সিগারেট বন্ধ কর। তোমার রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। এ হচ্ছে একধরনের পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ। তোমার ইন্টারমিটেন্ট ক্লডিকেশন হচ্ছে। এ তোমার কাফ মাসলে হচ্ছে, ফুটে হচ্ছে। এরপর পা রেস্টে থাকলেও ব্যথা হবে। রুদ্র বিশ্বাস করে না সিগারেটের জন্য এসব হতে পারে। কত লোক তো সিগারেট খায়, তাদের হয় না! সবার হয় না, কারও কারও হয়। আমার উপদেশ বাজে কবিতার কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দেওয়ার মত সে উড়িয়ে দেয়। বড় ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলবে আশায় শান্তিনগর মোড়ে বি এন মেডিকেল হলে ডাক্তার প্রজেশ কুমার রায়ের কাছে রুদ্রকে নিয়ে যাই। যে কথাটি তাকে বারবার বলেছি, ডাক্তার প্রজেশও তাই বলেন, সিগারেট ছাড়তে হবে। তা না হলে পা কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না। ডাক্তার কিছু ওষধু ও লিখে দেন। যতদিন ঢাকায় থাকি, রুদ্রকে নিয়মিত ওষধু খাওয়াই, গামলার গরম জলে তার পা দুটো ডুবিয়ে রাখি যেন রক্তনালী সামান্য হলেও প্রসারিত হয়। রুদ্রর ঠোঁট থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিই। ভীষণ রাগ করে সে। আমাকে ঠেলে সরিয়ে প্রতি সন্ধেয় সে মদ খেতে চলে যায়, টাকা বেশি থাকলে সাকুরায়, কম থাকলে মেথরপট্টিতে। রাস্তায় সুন্দরী মেয়ে দেখলে রিক্সায় বসে এক চোখ টিপে শিস বাজায়, খাসা মাল বলে চেঁচিয়ে ওঠে, হি হি করে হাসে। আমার সঙ্গে তালাক হয়ে গেছে, আমি আর কোনও বাধা নই রুদ্রর এসব কাজে। অবশ্য ছিলামই বা কবে! ময়মনসিংহে ফেরত যাওয়ার আগে বার বার বলি নিয়মিত ওষধু খেতে, ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলতে, বলি, জীবনের চেয়ে মূল্যবান অন্য কিছু নয়। রুদ্রর প্রেমিকা বা স্ত্রী মনে হয় না নিজেকে, বরং মনে হয় একজন বন্ধু একজন শুভাকাঙ্খি, একজন ডাক্তার।