আমি যখন শহরের সূর্যকান্ত হাসপাতালে বানের জলের সঙ্গে ভেসে আসা কলেরায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করছি, রুদ্র মোংলায় বসে লিখছে
আর একবার তুমি বৃষ্টি দাও, দূরের আকাশ—
তরুণ শস্যের ক্ষেত জ্বলে যাচ্ছে করাল খরায়।
চাষাবাদে অনভিজ্ঞ কৃষকের নেই কোনও সেচ,
কেবল হৃদয় জুড়ে অকৃত্রিম শস্য-ভালবাসা।একবার মেঘ দাও, ক্ষমা দাও বৃষ্টির ভাষায়,
জীবনের একমুঠো শস্য তুমি বিনাশ করো না।
আমাকে ফলতে দাও নৈরাজ্যের দুষিত দুপুরে,
হতে দাও শস্য ভার-অবনত সোনালি খামার।ফিরে নাও বিরহের তপ্ত খরা, অনল দূরত্ব
মেঘ দাও, বৃষ্টি দাও জীবনের ব্যথিত শরীরে।
দহনে চৌচির হিয়া, ও আকাশ, মরমিয়া হাত
ছোঁয়াও মেঘের বুকে জল হয়ে ঝরুক আদোর।লাঙলে হৃদয় চিরে বীজ বুনে ভালবাসা-ধান
একদিন অপেক্ষায় ছিল এক বিরান প্রান্তর,
তুমি তাকে মেঘ দিলে, বৃষ্টি দিলে, দিলে সম্ভাবনা,
ফসলের স্বপ্ন হল খরাজীণর্ অনাবাদি মাটি—অনুতপ্ত অন্ধকার হল স্নিগ্ধ সকালের রোদ।
যে মাটি পুড়েছে দীর্ঘ সময়ের স্বপ্নহীন ক্লেদে,
প্লাবনের পরাজয় জমে জমে যে হয়েছে ভূমি—
দিয়েছিলে মেঘ তাকে, বৃষ্টি, জল, সকল আকাশ।দিয়েছিলে সম্ভাবনা, দিয়েছিলে প্রথম প্রকাশ,
উড়বার স্বপ্ন শুধু দিয়েছিলে, দাও নাই ডানা।
সমস্ত জীবনটারে তুলে এনে দিয়েছিলে হাতে,
দাও নাই অতি তুচ্ছ নিভৃতের একান্ত ঠিকানা।
আমার যা ছিল, সব রুদ্রকেই দিয়েছিলাম আমি। অতি তুচ্ছ নিভৃতের ঠিকানাও। এ সম্ভবত তার সান্ত্বনা যে কিছু একটা তাকে দেওয়ার আমার অভাব ছিল, তাই এমন গোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু কিছু একটা তাকে দিইনি বলেই সম্পর্কটির এই দশা আজ। অথচ কোনও গোপন কিছু ছিল না আমার। নিজের জন্য কিচ্ছু ছিল না। উকিলের কাগজে আমি সই করেছি, দাবি মত টাকাও দিয়ে এসেছি। এরপর আর খোঁজ নিইনি কি ঘটেছে। শুধু এটুকু জানি, রুদ্রর সঙ্গে জীবন যাপন সম্ভব নয় আমার, আবার এও জানি রুদ্রকে আমি ভালবাসি, রুদ্র ছাড়াও জীবন যাপন করা অসম্ভব। যে রকম হুট করে বিয়ের কাগজে সই করেছিলাম, তালাকের কাগজেও তেমন করে করেছি। স্বপ্নহীন ধূসর জীবন নিয়ে বসে থেকে থেকে নিজেকে বারবার বলছি, যে তোমাকে অপমান করেছে, তার কাছে আর যেও না মেয়ে, আর কষ্ট পেও না। তোমার প্রেমের এতটুকু মূল্য সে দেয়নি। কোনওদিনই সে দেবে না। মুক্ত দাম্পত্যে সে বিশ্বাস করে, যে দাম্পত্যে কোনও প্রতিশ্রুতি থাকে না। সে যে কোনও ঘাটের জল খাওয়া ছেলে, যে করেই হোক সুখের −স্রাতে গা ভাসাবে সে, পাড়ে কে একা দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়, ফিরে তাকাবে না। রুদ্রকে ত্যাগ করেছি, কিন্তু তার স্মৃতিগুলোই আমাকে দুবেলা গুছোতে হয়। রুদ্রকে ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু নির্জন দুপুরে বাড়ির বারান্দায় বসে উঠোনের খাঁ খাঁ রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে যে মানুষের কথা ভাবি, না ভেবে পারি না, সে রুদ্র। বুক মুচড়ে একটি অসহ্য কষ্ট উঠে আসে চোখে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি যেন রুদ্র নামক দুঃস্বপ্নটি, পেছনে ফেলে আসা আমার কালো অতীতটি আমাকে আর স্পর্শ করতে না পারে। আমি ব্যর্থ হতে থাকি। আমি বুঝি, খুব গোপনে গোপনে বুঝি, রুদ্রর জন্য ভালবাসা আমার আজও ফুরোয়নি। কিন্তু আমিই কি চাই এ ফুরোক!
ফিরে এসো নিশ্চয়তা, ফিরে এসো সর্বগ্রাসী প্রেম।
ব্যথিত স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছি নিরুদ্দেশ খেয়া,
কোথাও বন্ধন নেই, স্নেহময় শীতলতা নেই,
কোথায় আশ্রয় নেই, ক্ষমা নেই, সুবিপুল ক্ষমা।সারাদিন অন্ধকার চাষ করে ফিরে আসি ঘরে,
সারারাত বেদনার বীজ বুনি বুকের ভেতর—
তুমি তো আশ্রয় জানি, ফিরে আসবার স্নিগ্ধ নীড়,
মায়ের আঁচল তুমি—ফিরে এসো নিকষিত হেম।আমাকে ভাঙছে ঋতু প্রকৃতি ও বিরুদ্ধ সময়,
মানুষের নৃশংসতা, ক্ষমাহীন চেতনার নোখ।
আমাকে ভাঙছে প্রেম, একই সাথে প্রেমহীনতাও—
না পেয়ে কেঁদেছি যত, পেয়ে বুঝি তারচে অধিক।আমাকে জবাই করে নৈরাজ্যের নিরাকার চাকু
অস্থির অ−শ্বর ক্ষুর অবিশ্বাস আমাকে পোড়ায়।
সভয়ে গুটিয়ে রাখি বিশ্বাসের সুকোমল ডানা,
আশ্বিনের চাঁদ ওঠে, জেনে যায় অবিশ্বাসী নাম।চারপাশে ফণা তোলে অন্ধ জল—ফিরে এসো তীর,
ফিরে এসো খড়কুটো, ভাসমান কাঠের শরীর।
পরিত্রাণ ফিরে এসো, তুলে নাও আমার সকল,
আমার ব্যর্থতা, পাপ, ভালবাসা, ঘণৃা ও আদোর।
রাতের সুতীব্র স্রোত হু হু করে টেনে নিয়ে যায়,
ফিরে এসো নিশ্চয়তা, ফিরে এসো রোদের সকাল।
কিন্তু কার কাছে ফিরব! সে তো আমাকে দুঃখ দেবে আরও। দুঃখ দেবে জেনেও যখন তাঁর শ্মশান কবিতাটি পড়ি, চোখে জল জমে। আমি ভেঙে পড়ি ভালবাসায়, বেদনায়।
বাড়াই তৃষ্ণার হাত, ফিরে আসে শূন্যতাকে ছুঁয়ে
তুমি নেই, নিষ্প্রদীপ মহড়ায় জ্বলে থাকে একা
পাথরের মত ঠাণ্ডা একজোড়া মানবিক চোখ,
তৃষ্ণাতর্ শরীর জুড়ে জেগে থাকে ব্যথিত রোদন।নরম আলোর চাঁদ মরে যায় অঘ্রাণের রাতে,
বেঁচে থাকে ভালবাসা, নক্ষত্রের আলোকিত স্মৃতি।
তোমার শূন্যতা ঘিরে দীর্ঘশ্বাস, বেদনার ঘ্রাণ,
তোমার না থাকা জুড়ে জেগে থাকে সহস্র শ্মশান।
জীবন গুছিয়ে নিয়েছি ময়মনসিংহে। অবকাশে নিজের ঘরটি আবার নতুন করে গুছিয়েছি। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। ঘরের মেয়ে তো ঘরেই ছিল, কেবল হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেত। সেই উধাও হওয়ার পাট চুকেছে। পুরোটাই কি চুকেছে! হঠাৎ একদিন এক মন-খারাপ-করা বিকেলে ঢাকায় এসো, আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য, টেলিগ্রামটি পেয়ে উতল হাওয়ায় ভাসি, আমি যে রুদ্রর কেউ নই আর, সব সম্পর্ক যে চুকে বুকে গেছে, ভুলে গিয়ে, দুদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকা ছুটি। দরজায় কড়া নাড়ি, রুদ্র দরজা খুলে দেয়। যেন জানতই আমি আসব। কথাহীন নিঃশব্দে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকি দুজন। একটি উষ্ণ হাত আমাকে আলতো স্পর্শ করে। একটি স্পর্শই বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেয় সমস্ত শরীরে। আমাকে সে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে রাখে অনেকক্ষণ। কাঁদে। আমার কাঁধে, বুকে ফোঁটা ফোঁটা জল। কণ্ঠের নিচে কষ্ট জমে থাকে, কেঁদো না, এই ছোট্ট কথাটি জমা-কষ্টের তলে চাপা পড়ে। চোখের জল মুছিয়ে দিই তার। ঘরটি দেখি, সেই আগের মত সব, যেভাবে ছিল। দুচোখে সংসার দেখি আমার। রুদ্র আমার ঘাড়ে গলায়, আমার চিবুকে বুকে, ঠোঁটে, চোখের পাতায় চুমু খায়, সারা শরীরে আগের মত চুমু। দীর্ঘদিনের না-স্পর্শ শরীর রুদ্রর স্পর্শে তছনছ হয়ে যায়। যেন আগের মত জীবন আমাদের। যেন আগের মত আমরা যৌথজীবনের স্বপ্ন নিয়ে শরীর এবং হৃদয় বিনিময় করছি। পারিনি ভাবতে রুদ্র আমার কেউ নয়। মিলনে মিথুনে তৃপ্ত রুদ্র আমার চিবুক তুলে হেসে বলেছে, কি নিজেকে তো খুব শুদ্ধ মানুষ ভাবো তো! এবার? আমি তো তোমার পর পুরুষ, আমার সঙ্গে শুলে যে!