কেন দূরে দূরে থাকছো? তোমার কি ইচ্ছে করে না? কী হয়েছে তোমার?
কি হয়েছে সে ঘটনাটিও সে বলে মাঝরাতে। তার আবার অসুখ করেছে।
সে দেখায় তার শিশ্নের গোড়ার লাল গোটা। আমাকে সে কিছুতেই এবার সংক্রামিত করতে চায় না। তার বিশ্বাস সেদিন টানবাজার থেকেই অসুখ টি সে বয়ে এনেছে।
পুরুষাঙ্গটি আড়াল করে অসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলি, না তুমি টানবাজার থেকে আনোনি এটি। এত দ্রুত এই অসুখ ফুটে বেরোবে না। তুমি কি টানবাজারের আগে আর কোনও বাজারে যাওনি?
কি বলতে চাইছ?
কি বলতে চাইছি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।
রুদ্রর বুঝতে না পারার কোনও কারণ নেই। অনেকক্ষণ বিমূঢ় বসে থেকে সে বলে আগে দএু কবার দুর্ঘটনা ঘটেছে হঠাৎ হঠাৎ।
কোথায়? বানিশান্তায়?
মাথা নাড়ে ধীরে। বানিশান্তায় ঘটেছে। বানিশান্তায় যে সে নিয়মিতই যায় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ঢাকায় আমি যখন তার পাশে থাকি, পতিতালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন সে বোধ করে না। কিন্তু ঢাকা ছেড়ে যখনই সে মোংলা বন্দরে যায়, বানিশান্তার লোভ সম্বরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। রুদ্রর কাছে আমি একটি শরীর ছাড়া, এক খণ্ড মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছু নই। নিজের ওপর ঘৃণা হয় আমার।
তুমি তো বলেছিলে সেই তিরাশির পর আর ঘটেনি কিছু কেবল সেদিন টানবাজারেই ঘটল!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। দীর্ঘশ্বাস আমিও ফেলি।
সেই পরিচয়ের শুরু থেকে আমাকে মিথ্যে বলে আসছ। ঘা না বেরোলে তো এবারও তুমি মুখোশের আড়ালেই থাকতে আর বলতে তুমি সম্পণূর্ আমার আছ, শুদ্ধ আছ। টানবাজারের ঘটনার কথাও লুকোতে।
রুদ্রর মুখ টি খুব করুণ দেখায়। কোনও পতিতাকে আমি কি ঘণৃা করি? নিজেকে প্রশ্ন করি, বারবার করি। উত্তর মেলে, না। রুদ্রকে কি ঘৃণা করি? না। করি না। বরং রুদ্রর জন্য মায়া হয় আমার। পরদিন তাকে শাহবাগে নিয়ে যাই পেনিসিলিন নিতে। সেই একই ওষুধের দোকানের একই কর্মচারি রুদ্রকে ভেতরের ঘরে নিয়ে টেবিলে উপুড় করে শুইয়ে নিতম্বে ইনজেকশনটি দেয়। সুঁইএর যন্ত্রণায় বেশিক্ষণ ভোগে না রুদ্র। দুজন আগের মত বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, শাহবাগে, সাকুরায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই দিয়ে রাত করে ঘরে ফিরি। পরদিন সকালে যখন আমি আমার কাপড় চোপড় সুটকেসে ভরছি, রুদ্র আকাশ থেকে পড়ে।
কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছে!?
ময়মনসিংহে।
ময়মনসিংহে কেন?
যাচ্ছি।
কবে ফিরবে?
জানি না।
জানো না কবে ফিরবে?
না।
কবে ফিরবে ঠিক করে বল।
হয়ত ফিরবই না।
তার মানে?
তার কি মানে, তা তাকে বুঝে নিতে বলি। বলি যে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি।
চলে যাচ্ছি মানে?
চলে যাচ্ছি মানে চলে যাচ্ছি। এক মাস পর উকিলের কাছে গিয়ে কাগজ সই করব।
তাহলে এসব করলে কেন? ইনজেকশন দেওয়ালে কেন?
সে তো তোমার জন্য। তোমার ভালর জন্য।
আমার ভালর জন্য যদি ভাবনা কর, তবে আমার সঙ্গে থাকো।
ভাবনা করলেই বুঝি থাকতে হয়!
কেন নয়?
দূরে থেকেও তো তোমার ভাল চাইতে পারি আমি। পারি না?
কি দরকার! দূরেই যদি থাকো, তবে আর আমার কিসে ভাল হবে তা নিয়ে ভাববে কেন!
হেসে বলি, তাতে কি? এত দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, তোমার প্রতি আমার ভালবাসা হঠাৎ ফুরিয়ে গেছে না কি? সে তো আছেই।
তবে আর যাচ্ছে! কেন! চল নতুন করে শুরু করি সব।
নাহ।
নাহ কেন।
আমি একটা মেয়েমানুষের শরীর, আমি আর কিছু নই, তোমার এই ধারণাটি, তোমার এই বিশ্বাসটি আমি অস্বীকার করতে চাচ্ছি।
কে বলল এটা আমার বিশ্বাস?
নিজেকে জিজ্ঞেস কর। উত্তর পাবে।
সংসারের মায়া ত্যাগ করে পাকাপাকিভাবে ময়মনসিংহে ফেরার পথে একটি রাত কাটাতে থামি ছোটদার বাড়িতে। ছোটদার বিদেশ ভ্রমণের গল্প শুনে খেয়ে দেয়ে যেই না ঘুমিয়েছি, মুহুর্মুহু দরজা ধাক্কার শব্দে সবাই ঘুম ভেঙে জেগে উঠি মধ্যরাতে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। পাড় মাতাল।
কি হয়েছে, কি চাও?
রুদ্র চিৎকার করে, বেরিয়ে এসো।
কেন?
তুমি আমার বিয়ে করা বউ, আমি যা বলছি তাই তোমাকে শুনতে হবে, বেরিয়ে এসো, তা না হলে পুলিশ ডাকব। কোনও শুয়োরের বাচ্চাই আমাকে থামাতে পারবে না। চলে যাও। চিৎকার করো না।
আমি করবই চিৎকার। তুমি যতক্ষণ না বেরোচ্ছ, চিৎকার করব।
আমি বেরোবো না। চলে যাও তুমি।
কেন বেরোবে না? তোমাকে বেরোতেই হবে। আমি দরজা জানালা সব ভেঙে ফেলব বলে দিচ্ছি। এখনও বেরোও। বাড়ি চল। বেরোও বলছি।
রুদ্রর চিৎকারে পাড়া জাগে। দরজা ক্রমাগত লাথি মেরে ভাঙতে চাইছে সে।
ছোটদা আমাকে টেনে সরিয়ে আনেন জানালা থেকে। লজ্জায় আনত মুখটি বুকে চেপে আমাকে জড়িয়ে রাখেন দুবাহুতে, শুইয়ে দেন বিছানায়, পাশে শুয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন, ছোটদার এই আদর পেয়ে আমার ভেতরের জমে থাকা কান্নাগুলো সমস্ত বাধা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে তিনি রুদ্ধ স্বরে বলতে থাকেন, শক্ত হ, শক্ত হ। পরদিন সকালে গীতা নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে দিয়ে আসে কমলাপুর ইশটিশনে। ঝকঝকে লাল রঙের এই টয়োটা করোলাটি গীতার জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন ছোটদা।
আমি যে রুদ্রকে ত্যাগ করে এসেছি, অবকাশের কাউকে না বললেও বোঝে সবাই। সুটকেস থেকে আমার কাপড় চোপড় বের করে মা আলনায়, আলমারিতে গুছিয়ে রাখেন। বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে দেন। এলোমেলো কাগজ সরিয়ে টেবিলটি সাজিয়ে দেন। ফুলদানিতে তাজা একটি গোলাপ এনে রাখেন। দুদিন পর চাকরির কাগজ আসে। নকলা উপজেলা স্বাস্থ্যকে−ন্দ্র মেডিকেল অফিসার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পদে আমার চাকরি। কাগজ পাওয়ার পরদিন বাবা আমাকে ট্রেনে করে জামালপুর নিয়ে যান। জামালপুর থেকে বাসে করে শেরপুর, ওখানে সিভিলসার্জনের আপিসে বসে চাকরিতে যোগদানের কাগজে সই করি। সাতদিনের মধ্যে আমাকে নকলার স্বাস্থকে−ন্দ্র কাজ শুরু করতে হবে। বাবাই আমাকে আর আমার সুটকেসটিকে ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে শম্ভগু ঞ্জ, শম্ভগু ঞ্জ থেকে বাসে চড়ে ফুলপুর, ফুলপুর থেকে রিক্সায় করে নকলা স্বাস্থ্যকে−ন্দ্র দিয়ে আসেন। গ্রামের ভেতর ধান, পাট, কড়াইশুঁটির ক্ষেতের মধ্যিখানে একটি হাসপাতাল। হাসপাতালের কিনারে কয়েকটি শাদা দোতলা বাড়ি, ডাক্তারদের সরকারি আবাস। স্বাস্থ্যকে−ন্দ্রর বড় ডাক্তার আবদুল মান্নান। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন সরকারি বাড়িতে। আবদুল মান্নান দাড়িঅলা লম্বা পাঞ্জাবি পরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ডাক্তার। তাঁর বাড়িতে আপাতত আমার থাকার ব্যবস্থা করা হল। বাবা হয়ত তাঁকেই ভেবেছেন সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু সারাদিন হাসপাতালে রোগী দেখে রাতে আমার আশ্রয়ে ফিরতেই আবদুল মান্নানের চোখ নেকড়ের চোখের মত জ্বলে, দেখি। তাঁর থাবা থেকে গা বাঁচাতে আমাকে বেশিদিন সন্ত্রস্ত থাকতে হয়নি, নকলা থেকে বদলি ঘটিয়ে আমাকে ময়মনসিংহ শহরে এনেছেন বাবা। শহরের সদর স্বাস্থ্য আপিসে কাজ বলতে কিছু নেই। আমি কাজ চাই। ব্যস্ততা চাই। কাচারির পাশে লাল দালানে অলস বসে থাকা ডাক্তার নূরুল হককে অনুরোধ করি তিনি যেন আমাকে পাঠিয়ে দেন এমন জায়গায় যেখানে প্রচুর কাজ, যেখানে সকালদুপুরবিকেলরাত কেবল কাজ। যেখানে এতটুকু শ্বাস ফেলার সময় আমি পাবো না।