গোটা শহরে ছোটদার বন্ধু। বাড়িতে ছোটদার খোঁজে এলে ছোটদা সাধারণত ওদের নিয়ে বাইরে চলে যান। কখনও সখনও ছোটদা বাইরের বারান্দা-ঘরে বন্ধু নিয়ে বসেন। মাকে বলেন চা দিতে। মা চা বানিয়ে জরির মার হাতে পাঠিয়ে দেন। ঘরে সবসময় চায়ের সরঞ্জাম থাকে না। চিনি বা দধু না থাকলে এম এ কাহহারের বাড়ি পাঠিয়ে এক কাপ চিনি বা দুধ ধার করে আনা হয়। এম এ কাহহারের মত ধনীর বাড়ি থেকেও লোক আসে মাঝে মাঝেই চিনি বা দধু ধার করতে। এক কাপ চিনি বা দধু ধারের ব্যাপারটি আমাদের কাছে ডালভাত। চায়ের সংগে দুটো টোস্ট বিস্কুট নয়ত নাবিস্কো বিস্কুট দিতে হয়, বাড়িতে বিস্কুট সবসময় থাকে না, তখন শুধু চা তেই আপ্যায়ন সারতে হয়। এক রাতে, বলা যায় গভীর রাতে, প্রায় সাড়ে বারোটায় ছোটদার এক বন্ধু যখন দরজার কড়া নাড়ল, ছোটদা তখন কেবল শুতে যাচ্ছেন। বাবা নেই বাড়িতে,বাড়ির আর সবাই ঘুমিয়ে। আমার ঘুম ভেঙে যায় দরজার শব্দে। বৈঠকঘরের পর্দা সরিয়ে দেখি হরিণ হরিণ চোখের মিষ্টি মিষ্টি হাসির এক ছেলের নিভাঁজ নিটোল মুখে চাঁদের আলো চুমু খাচ্ছে। আমার ওই উঁকি দেওয়া মুখের অর্ধেকখানি দেখেই ছেলেটি বলল, নাসরিন না! কত বড় হয়ে গেছ তুমি! ছেলেটির দীপ্ত চোখ আমার মখু থেকে সরে না। আমি সংকোচে নত করি চোখ।
আমাকে মনে নাই তোমার? আমি জুবায়ের।
আমি কোনও উত্তর দিই না। জুবায়ের জিজ্ঞেস করে, তুমি গান পছন্দ কর? মৃদু কণ্ঠে বলি হ্যাঁ করি। দাঁড়িয়েই ছিলাম, ছোটদা বললেন, যা ভেতরে যা, মারে চা দিতে ক ত দুই কাপ। মা ঘুমিয়ে ছিলেন, ঠেলে উঠিয়ে বলি, ছোটদার বন্ধু আইছে, দুই কাপ চা দেও। মা পাশ ফিরে বলেন, জরির মারে ক। জরির মা মেঝেতে কুকুর কুণ্ডুলি, জাগিয়ে বলি, দুই কাপ চা কর। জরির মা ঘুমচোখে রান্নাঘরে গিয়ে শুকনো কাঁঠাল পাতা চুলোয় গুঁজে আগুন ধরিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে দেয়। পানি গরম হল বটে, কিন্তু চা পাতা কই, চিনি কই, দধু ই বা কই! মা জানেন কই। মাকে আবার ডাকি, উইঠ্যা চা বানাইয়া দেও। পানি গরম হইয়া গেছে।
মা আবারও পাশ ফিরে শুলেন, এত রাইতে আমারে জ্বালাইস না। আমার শইলডা বালা না।
মা উঠলেন না। জিজ্ঞেস করলেন বাবা ফিরেছেন কি না। ফেরেনি বলাতে বললেন ওই মাগীর বাড়িত রাইত কাডাইতাছে। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকি। চমৎকার গলায় গান গাইছে জুবায়ের। নৈঃশব্দের সুতোয় ভর করে গানের সুর ভেসে আসছে ঘরে, সে সুর ঘুমন্ত কাউকে জাগায় না, আর জেগে থাকা আমাকে ঘুমোতে দেয় না। ইচ্ছে করে পুরো রাত গান শুনি, জুবায়েরের পাশে ঘন হয়ে বসে পূর্ণিমায় ভিজে ভিজে তন্ময় হয়ে শুনি, জগত সংসার ভুলে শুনি। রাত দুটোর দিকে আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে গানটি গেয়ে জুবায়ের চলে গেল।
পরদিন ছোটদা বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে রইলেন চপু চাপ।
কি এই অসময়ে শুইছ কেন?
ভাল্লাগতাছে না।
কি হইছে?
কালকে যে জুবায়ের আইছিল, আমার বন্ধু অনেক বছর পরে তার সাথে দেখা।
ছেলেডা খুব সুন্দর দেখতে। গানও ত সুন্দর গায়।
আজকে ভোরে জুবায়ের আত্মহত্যা করছে।
বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা কি জানি কি সারা গায়ে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। জুবায়েরের সঙ্গে যে মেয়েটির প্রেম ছিল, সে মেয়েকে মেয়ের বাবা ধরে বেঁধে অন্য এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ছোটদা খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন। কাল রাতে জুবায়ের ওই মেয়ে সম্পর্কে একটি কথাও বলেনি। বলেছে, এত চমৎকার পূর্ণিমায় তার ইচ্ছে করেনি একা একা ঘরে বসে থাকতে, তাই বেরিয়েছে সে, তার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে। জুবায়ের যখন গান গাইছিল, ছোটদা পাশে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। জুবায়ের আরও গান গাইতে চাইছিল, কিন্তু ছোটদাই জুবায়েরকে বলেছেন চলে যেতে, কারণ বিছানায় তাঁর তখন না গেলেই নয়। প্রেমের সঙ্গে আত্মহত্যার সম্পর্কে বড় নিবিড়। ছোটদাও তাঁর বিয়ের আগে বিষ খেয়েছিলেন। চটজলদি হাসপাতালে নিয়ে পেটে নল ঢুকিয়ে বিষ বের করে নেওয়া হয়েছিল বলে বেঁচেছেন।
এরপর বেশ কয়েকটি রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। কেবলই মনে হয়েছে রাত ফুঁড়ে একটি গান ভেসে আসছে, আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভূলিতে।
০৪. ছোট ছোট দুঃখ কথা
মার কোনও কিছু বাবার পছন্দ না হলেও মার বলা একটি ছড়া বাবার খুব পছন্দ। মন ভাল থাকলে মাকে তিনি ছড়াটি বলতে বলেন। মা হেসে দুলে দুলে বলেন,
এক পয়সার তৈল,
কিসে খরচ হৈল,
তোমার দাড়ি আমার পায়,
আরও দিলাম ছেলের গায়,
ছেলেমেয়ের বিয়ে হল,
সাতরাত গান হল,
কোনও অভাগী ঘরে গেল,
বাকি তেলটুক নিয়ে গেল।
মার উড়োখুড়ো চুল, তেল সাবান পড়ে না চুলে। ফিনফিনে চুলগুলো পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন, ফিতে জোটে না সবসময়। আমাদের, আমার আর ইয়াসমিনের চুলের ফিতে পুরোনো হয়ে গেলে তা দিয়ে বাঁধেন, তাও না থাকলে দড়ি। গোসল করে ভেজা চুলও পেছনে বেঁধে রাখেন, চুল ঝরে পড়ে আরও। মার ঘন দীর্ঘ কেশ ছিল এককালে, এখন নেই। নেই বলে আফসোস করেন, কিন্তু যা আছে তা হেলাফেলায় ঝরে, তিনি ফিরে তাকান না। মা যখন আমাকে আমার চুলের যত্ন নিতে বলেন, আমি বলি, আর যত্ন কইরা কি হইব, চুল ত তোমার চুলের মত হইছে, পাতলা। নিজের ছোট চোখ নিয়েও দুঃখ করে বলি, ইয়াসমিনের চোখ কত সুন্দর, বাবার চোখ পাইছে। আমার গুলা হইছে তোমার চোখের মত। নাক নিয়েও কথা, নাকটা খাড়া হইল না। হইব কেমনে, তোমার নাক পাইছি ত! যেটুকু ফর্সা হয়েছি তা বাবার কারণে, যেটুকু কালো তা মার কারণে। শরীরের যা কিছু খুঁত, তা সব মার কাছ থেকে পাওয়া, এরকমই এক বিশ্বাস আমার গভীরে ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকে। ভাগ্য ভাল যে বাবার থুতনি পাইছি। থুতনির মধ্যে একটা ভাঁজ আছে, মেয়েরা কয় এইডা আছে বইলা আমারে সুন্দর লাগে দেখতে। বাবার কিছু পাইছি বইলা মাইনষের মত দেখতে লাগে। একদিন মার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বলি, মা তোমার গলা কই?