মাকে বলি নার্গিসের ওপর গীতার অকথ্য নির্যাতনের কাহিনীটি। শুনে কোনও মন্তব্য করেন না তিনি। মার নৈঃশব্দ আমাকে ধীরে ধীরে মার পাশ থেকে উঠিয়ে অন্য ঘরে নিতে থাকে। পেছন থেকে তিনি বলেন, কামাল কি একলা আইছিল সেদিন? নাকি গীতারে ওর বাপের বাড়িত রাইখা সুহৃদরে দেখতে আইছিল?
জানি না। খেয়ালি উত্তর আমার।
নার্গিসরে বাসায় একলা রাইখা আসা উচিত হয় নাই।
মন্তব্যটি আমাকে থামায়। কেন উচিত হয়নি জিজ্ঞেস করি। মা বলেন, টুলুটা ভাল না। আমি সুহৃদরে নিয়া কয়দিন ছিলাম না কামালের বাসায়? টুলু ত রাইতে গিয়া নার্গিসরে ধরছিল। গীতারে অনেক কইছি নার্গিসরে আমার সাথে দিয়া দেও। দিল না।
মার এ কথা শোনার পর আমি বেরিয়ে একটি রিক্সা নিয়ে কৃষ্টপুর নার্গিসদের বাড়ি গিয়ে তার মাকে বলি যেন ঢাকা থেকে তার মেয়েকে নিয়ে আসে, দেরি না করে। সে তার মেয়েকে নিয়ে আসতে প্রস্তুত কিন্তু গাড়িভাড়া নেই। কোনওদিন ঢাকায় যায়নি না নার্গিসের বাবা, না মা। কথা দিই কাল আমি টাকা নিয়ে আসব। টাকা হলে বাসে চড়ে বা ট্রেনে চড়ে যেন চলে যায়, দেরি না করে। ঠিকানা লিখে দেব। ঢাকায় নেমে কোনও রিক্সাঅলাকে বললে একেবারে নয়াপল্টনে বাড়ির সামনে থামাবে। ফেরার পথে চোখ্যে ভাসাতে থাকি টাকা যোগাড় করার উপায় কি কি আছে সামনে। ভাবনার জালে ঢিল ছোঁড়ে চড়পাড়া মোড়ের একটি জটলা। জটলার মুখ গুলো চেনা। শেষ বষের্ আটকে থাকা সাত আটজন পুরোনো সহপাঠী দাঁড়িয়ে। উদ্বিগ্ন মুখ সবার। রিক্সা থামিয়ে কি হয়েছে, র্যাগডের উৎসব মনে হচ্ছে! বলতেই রতিশ দেবনাথ বলল, রিজওয়ান মারা গেছে।
আমাদের রিজওয়ান?
হ্যাঁ আমাদের রিজওয়ান।
মারা গেছে মানে?
পেথিডিন নিত। বেশি নেশা করতে গিয়া মাসল রিলাক্সেন্ট নিছিল। চরপাড়া হোটেলের একটা রুম ভাড়া নিয়া থাকত। সকালে হোটেলের মালিক দরজা ভাইঙ্গা ঘরে ঢুইখা দেখে এই অবস্থা। সিরিঞ্জ আর এম্পটি ভায়াল পইরা রইছে। বোঝে নাই যে আর্টিফিসিয়াল রেসপিরেশান না থাকলে মাসল প্যারালাইসিস হইয়া লাংগস কাজ করবে না। আরে ডায়াফ্রাম যদি মুভ না করে, লাংগসের ফাংশান তো হবে না!
বেচারা।
মৃত্যু এত সহজে ঘটে যায়। এই বেঁচে থাকছি, মুত্যুর ভাবনা ছিঁটে ফোঁটা নেই, হঠাৎ মৃত্যু এসে বলল, চল। সময় ব্যয় না করে বাড়ির দিকে যাই। কেউ সুখে মরে, কেউ দুঃখে মরে। সুখে যারা মরে, তাদেরই ভাল। জীবনের কোনও যন্ত্রণাই তাদের পাওয়া হয়নি। রিজওয়ানের হয়ত কোনও যন্ত্রণা পাওয়া হত না। ডাক্তার হয়েছে, তার ওপর আবার পুরুষ মানুষ। কেউ তাকে ঠকাবার ছিল না। কেউ তাকে ধর্ষণ করবারও ছিল না। রিজওয়ানের বাবার অঢেল টাকা, বাবা নিশ্চয়ই পুত্রের সুখের জন্য টাকা ব্যয় করতেও কোনওরকম দ্বিধা করতেন না। বাড়ি ফিরে আমি টাকার কথা ভাবি আবার। মার কাছে টাকা নেই। বাবার কাছে চাওয়ার প্রশ্ন আসে না। তিনি আমাকে পারলে বাড়ি থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেন। দাদা তো বদলে গেছেন, তিনি আমার হাত পাতার দিকে বড় জোর থুতু ছিটোতে পারেন। ইয়াসমিনকে কথা দিয়ে যে চাকরির প্রথম বেতনের টাকা পেলে ওকে আমি নতুন একটি হারমোনিয়াম কিনে দেব, ওর হারমোনিয়ামটি নিয়ে যাই ছোটবাজারে সুর তরঙ্গ দোকানটিতে, যে দোকান থেকে এটি কিনে ছিলাম। পাঁচশ টাকায় কিনছি, বেচলে কত দিবেন? সুর তরঙ্গে খাটো ধুতি পরা গোল ফ্রেমের চশমা চোখের বুড়োটি বললেন, দেড়শ দিতে পারি। দরাদরি করে তিনশ টাকা পাওয়া গেল। সেই টাকা নিয়ে কালের জন্য দেরি করিনি আমি। সেদিনই কৃষ্টপুর গিয়ে নার্গিসের মার হাতে টাকা কটি দিয়ে আসি। বারবার করে বলে আসি যেন কাল ভোরেই চলে যায় তারা ঢাকায়, দেরি না করে। ঠিকানা লিখে দিয়ে আসি কাগজে। বাড়ি ফিরে এলে মা জিজ্ঞেস করেন, হারমোনিয়াম কই থইয়া আইছস?
আমি কোনও উত্তর দিই না।
রুদ্রর চিঠি পাওয়ার পর ঢাকা ছুটি। সকালে ইন্দিরা রোডের বাড়িতে পৌঁছে দেখি সে ঘরে নেই। ঘরে তার ঘ্রাণ আছে, সে নেই। একটু আগেই নাকি বেরিয়েছে। সারাদিন অপেক্ষায় বসে থাকি। রুদ্র ফেরে না। রাত হয়। ফেরে না। অপেক্ষায় রাত জেগে থাকি, যদি গভীর রাত্তিরে হলেও ফেরে,যদি শেষ রাতের দিকেও ফেরে। কোথাও হয়ত আড্ডায় বসে গেছে, কোথাও হয়ত রাজনীতি নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে তুমুল জমে উঠেছে। দীর্ঘ দিন পর ঢাকায় এসে ঢাকার আড্ডা থেকে নিজেকে তুলে আনা কঠিন, এ বুঝি আমি। ভোরের আলো আমার গা স্পর্শ করে। চোখচুলচিবুক স্পর্শ করে। বুক থেকে কিরণ ছড়িয়ে যায় বাকি শরীরে। রুদ্রর স্পর্শ নেই। একা বিছানায় তার মাথার বালিশটিকে বুকে চেপে শুয়ে থাকি। সকাল চলে যায়। রুদ্র আসে দুপুরবেলা। ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে একটু চমকায় সে।
কখন এলে?
আজ নয়, কাল এসেছি।
কাল?
হ্যাঁ কাল।
রাতে বাড়ি ফেরোনি কেন? কোথায় ছিলে?
ছিলাম কোথাও।
কোথাওটি কোথায়?
ছিলাম।
কোথায়?
রুদ্র কোনও উত্তর না দিয়ে তোয়ালে আর লুঙ্গি নিয়ে গোসলখানায় ঢোকে। এত সময় নিয়ে গোসল করতে তাকে এর আগে দেখিনি। গোসল সেরে এসে সগু ন্ধি সাবানের ঘ্রাণ নিয়ে শরীরময়,বলে, খেয়েছো?
হ্যাঁ, খেয়েছি।
তাহলে বসো তুমি। আমি খেয়ে আসি।
রুদ্র খাবার টেবিলের দিকে চলে যায়। আমি বিছানায় শুয়ে ভাবি, কেন সে বলল না কোথায় ছিল! কেন শুধু ছিলাম শব্দের আড়ালে ঢেকে রাখল কোথায় ছিল! ভাবনা আমাকে কোথাও নিয়ে পৌঁছয় না। এত সময় নিয়ে খেতে রুদ্রকে এর আগে আমি দেখিনি। তার স্পর্শ পেতে আমার শরীরের প্রতিটি কণা উন্মুখ হয়ে আছে। ইচ্ছে করে খাবার টেবিলে তার পাশের চেয়ারে বসে দেখি কি করে খাচ্ছে সে। নিশ্চয়ই কাল রাতে খায়নি। তা না হলে আমাকে একটুও স্পর্শ না করে সে কেন এমন চলে গেল খেতে! অভিমান আর আশঙ্কা আমাকে জাপটে ধরে রাখে। রুদ্র খেয়ে ফিরলে পাশে বসতে বলি। তার হাতখানি হাতে নিয়ে বলি, তুমি মনে হয় এড়িয়ে যাচ্ছে! আমাকে।