মার প্যাঁচাল শোনার জন্য বাবা অপেক্ষা করেন না। তিনি চেম্বারে চলে যান রোগী দেখতে। তাঁর অনেক রোগী। আলাদা চেম্বার করার পর থেকে কিছু কিছু বাঁধা মেয়ে-রোগী নিয়ে চেম্বারের দরজা বন্ধ করতে শুরু করেছেন। মা একদিন বাবার পছন্দের গাজরের হালুয়া বানিয়ে বাটিতে করে নিয়ে গিয়েছিলেন চেম্বারে, বাবা যেন রোগি দেখার ফাঁকে হালুয়াটুকু খান। চেম্বারের বন্ধ দরজায় টোকা দিয়েছেন অনেকক্ষণ। টোকার পর টোকা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাবা যখন টোকার জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে দরজা খুলেছেন, প্যাণ্টের বোতামও তখনও খোলাই ছিল তাঁর, লাগাতে ভুলে গিয়েছিলেন। ওয়াক থু বলে বেরিয়ে এসেছেন মা। মার ওয়াক থুতে বাবার কিছু যায় আসে না। তিনি বাজার না পাঠালে বাড়িতে সবাইকে উপোস থাকতে হবে, তিনি বাড়ি থেকে বের করে দিলে সবাইকে রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে। তাঁর শক্তির কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মা প্রায়ই বলেন, মেট্রিকটা পাশ করলে একটা চাকরি করতে পারতাম। চাকরি করলে কবেই যে পারতাম এই বাড়ি থেইকা চইলা যাইতে! কোনও একটি চাকরি করতে পারলেই মা ভাবেন, মার আর পরোয়া করতে হতো না বাবাকে।
মা জ্বরে সাধারণত কাতর হন না, জ্বর নিয়েই সংসার ধর্ম পালন করেন, কিন্তু জ্বর মাকে একদিন এমনই কাবু করল তিনি বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারালেন। মার জন্য ভাল কোম্পানির এমক্সিসিলিন পাঠাতে বলেছি দাদাকে। এখন বাড়ির কারও ছোটখাট অসুখ বিসুখে আমিই চিকিৎসা করার উদ্যোগ নিই। আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি বলে দাদা তিনদিন পর দশটি ক্যাপসুল এনে মাকে দেন খেতে। মা ঘড়ি দেখে আট ঘন্টা পর পর ওষধু খাচ্ছেন। সাতদিন পরও জ্বর সারছে না মার, জ্বর নিয়ে উদাস তাকিয়েছিলেন জানালায়। কপালে হাত দিয়ে দেখি গা পুড়ে যাচ্ছে। কপালে রাখা আমার হাতটি নিজের হাতে নিয়ে মা বললেন, কাছে বসো মা, তোমারে একটা গোপন কথা বলি। মা কখনও কোনও গোপন কথা বলার জন্য এত কোমল কণ্ঠে আমাকে পাশে বসতে বলেন না। গোপন কথা তো মার আছেই একটি, বাবার সঙ্গে রাজিয়া বেগমের সম্পর্কে সত্যিকার কি, তা নতুন করে আবিষ্কার করে শোনানো। গোপন কথা শোনার জন্য আমার ভেতরে কোনও কৌতূহলের অঙ্কুরোদগম হয় না। নিস্পৃহ দৃষ্টিটি ঘুরতে থাকে মার মুখে, বালিশে, চাদরে, জানালায়, রঙিন কাচে। মা খুব ধীরে ধীরে বলেন, তোমার বাবার অত্যাচারে একদিন ভাবলাম আমি যাইগা এই বাড়ি থেইকা। সত্যিই সত্যিই ভাবলাম। কিন্তু কই যাই, কার কাছে যাই! যাই কইলেই তো যাওয়া যায় না। এই যে মাঝে মাঝে রাগ কইরা কই জঙ্গলে চইলা যাবো, জঙ্গলে কি আর সত্যি সত্যি চইলা যাওয়া যায়! যায় না। মা থামেন, জানালার ওপারে বুকে মেঘ জমা আকাশটির নীল নীল কষ্টের দিকে তাকিয়ে বলেন, ছোটবেলায় আমার এক মাস্টার ছিল, বাসায় আইসা আরবি পড়াইত। মাস্টারটা আমারে খুব পছন্দ করত। কয়েক বছর আগে তার খোঁজ নিছিলাম কই আছে সে, কি অবস্থা। শুনলাম সে বিয়া করছিল, বউটা মইরা গেছে। সেই মাস্টাররে একটা চিঠি লিখলাম একদিন। সোজাসুজিই জিগাস করলাম , আমাকে বিয়া করতে সে রাজি আছে কি না। খুব উৎসাহ নিয়া সে আসল আমার সাথে দেখা করতে। পার্কে গিয়া দেখা করলাম। জানে যে আমার বিয়া হইছে এক ডাক্তারের সাথে। ডাক্তারের বিরাট নাম। বড় বাড়ি। আমারে প্রথম কথা জিগাইল, তোমার জমি জমা কিরম আছে? জমিজমা? আমি ত অবাক। জমির কথা জিগাস করে কেন? আমি যা সত্য তাই কইলাম। কইলাম আমার কোনো জমিজমা নাই, টাকা পয়সা নাই। শুইনা সে আর উৎসাহ দেখাইল না।
তার মানে তোমার জমিজমা থাকলে তোমারে বিয়া করত!
হ।
তুমি মুন্সি বেডারে বিয়া করতে চাইছিলা? নাক সিঁটকে বলি।
তোমার বাপের শয়তানি আর দেখতে ইচ্ছা করে না। তাই রাগ কইরা ওই লোকরে ডাকছিলাম। তোমার বাপরে দেখাইয়া দিতে চাইছিলাম, আমিও চইলা যাইতে পারি। পারলাম না।
তুমি গেলে গা আমাদের কি হইব চিন্তা করছ?
তোমাদের কথা ভাইবাই ত কোথাও যাওয়ার চিন্তা কইরাও পারি না। তোমরা বড় হইয়া গেছ। তারপরও যাইতে পারি না। তোমরা ঘর সংসার করবা, ছেলেমেয়ে হবে। মা গেছে গা আরেক বেডার সাথে এইডা তো ছেলেমেয়ের জন্য কলঙ্ক। বাপে সাত বেডি নিয়া থাকলেও কোনও কলঙ্ক হয় না।
মার মলিন মুখ টির দিকে তাকিয়ে থাকি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন, আত্মহত্যা করলে গুনাহ হয় বইলা আইজও করি নাই। গুনাহ না হইলে কবেই করতাম!
মার মলিন মুখ থেকে চোখ সরিয়ে দিশি এমক্সিসিলিনের মলিন স্ট্রিপটি নাড়তে নাড়তে চোখ চলে যায় ওষুধের নামে, ওষধু তৈরির তারিখে, ওষধু বাতিল হওয়ার তারিখে। বাতিলের তারিখ তিন বছর সাত মাস আগের। দাদা কি ইচ্ছে করেই মাকে এই বাতিল ওষধু দিয়েছেন? আমার বিশ্বাস হয় না ইচ্ছে করে দিয়েছেন। মাকে বলি না যে এই ওষধু ওষুধ হিসেবে অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে, এ দিয়ে জ্বর সারবে না। মাকে বলি না কিন্তু দাদাকে গিয়ে বলি, ডেট এক্সপায়ারড হইয়া গেছে ওষুধের! ভেবেছিলাম তিনি বলবেন যে তিনি দেখেননি বাতিলের তারিখ, এক্ষুনি তারিখ পার হয়নি এমন ওষধু পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর নির্লিপ্ত মুখ এবং সে মুখে এক্সপাইরি ডেট পার হইলে কিচ্ছু হয় না, ওষধু ঠিক আছে, বাক্যটি শুনে আমি অনেকক্ষণ বাকশূন্য দাঁড়িয়ে থাকি। একটি হু হু হাওয়া এসে আমার ওপর আছড়ে পড়ে। আকাশের নীল নীল কষ্টগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে আমাকে ভেজাতে থাকে, ভাবি, ভেজা গা মুছে মার বালিশের পাশ থেকে নষ্ট ওষধু টি নিয়ে গোপনে ফেলে দেব, নতুন ওষধু কিনে মার বালিশের কাছে ঠিক আগের ওষুধের মতই গোপনে রেখে দেব। মা সুস্থ হয়ে উঠবেন, কোনওদিন জানবেন না তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রটি তাঁকে ঠকাতে চেয়েছিলেন। মার জীবনটির কথা ভাবার অবসর আমার কখনও হয়নি। ভাল ছাত্রী হওয়ার পরও মাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মার যখন দশ কি এগারো বছর বয়স। স্বামী সেই বিয়ের পর থেকে অন্য মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্কে করে যাচ্ছেন। চারটে ছেলেমেয়ের ওপর ভরসা করে সংসারের ঘানি টেনে গেছেন মা। দুটো ছেলে বিয়ে করে পর হয়ে গেছে। নিজের নাতিকে লালন পালন করছেন, এর বিনিময়ে বছরে দুটো শাড়ি পান। বাচ্চা রাখার জন্য দাসি নিযুক্ত করা হলেও শাড়ি দেওয়া হয়। মা কোনও ব্যতিক্রম নন। মার আসলে অভাবে থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে। কোনও শাড়ি গয়নার প্রয়োজন নেই মার। কোনও তেল সাবানের প্রয়োজন নেই। ডিম দধু কলারও প্রয়োজন নেই। মার প্রয়োজন সামান্য একটু ভালবাসা। সেটি পেতে চাতক পাখির মত বসে থাকেন। মার চোখের জলে লকলক করে বড় হচ্ছে একটি পদ্মফুল। দিন একদিন নিশ্চয়ই আসবে, কোনও মেয়ে মহিলা যেদিন আর ভিড়বে না, তখন নিশ্চয়ই স্থির হবেন বাবা। ষাট সত্তর পার হলে, আশি, নব্বই বছরে এসে হয়ত তিনি মার দিকে ফিরবেন। কিন্তু মা, মনে মনে বলি, জীবন ফুরিয়ে গেলে ভালবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়ে কি লাভ? ও কি আর ভালবেসে ফেরা! ও নিতান্তই সব হারিয়ে সব ফুরিয়ে কেবল বাকল টুকু নিয়ে আর কিছু করার নেই বলে ফেরা।