গায়িকা পিলু মমতাজের ছোট বোন।
তা তোমার সাথে পরিচয় কেমনে?
ফ্লাইটে পরিচয়। প্রায়ই বিদেশ যায়।
ও।
মেয়েটা খুব ভাল। আমাকে কিছু গাহেক দিছে। ধান্দার জিনিস বেচি।
বিমানের ক্রুরা দেশে বিক্রি করার জন্য বিদেশ থেকে কিনে আনা তাদের জিনিসপত্রকে বলে ধান্দার জিনিস। ওগুলো নিজের ব্যবহারের বলে কাস্টম পার করে লাভে বিক্রি করেন মানুষের কাছে। নির্দিষ্ট কিছু লোক কেনে। এগুলা কর কেন? ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আরে ধান্দাই ত আসল। ধান্দাতেই তো পয়সা। বেতন আর কত পাই! ছোটদা ঠোঁট ওল্টান।
শোন, গীতার কাছে কিন্তু কোনওদিন কইস না এই মেয়ের কথা।
কেন, কি হইব কইলে?
উপায় নাই। আমি কোনও মেয়ের সাথে কথা কইলে গীতা কোনওদিন সহ্য করে নাই। সর্বনাশ হইয়া যাবে জানলে।
ছোটদা সে দিনই চলে যান ঢাকায়। তাঁর ময়মনসিংহে আসার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল গীতাদের পিয়নপাড়ার বাড়িতে টাকা দিয়ে যাওয়া। ওখানে ভাঙা টিনের ঘর ভেঙে দিয়ে এখন দালান তোলা হচ্ছে।
বাবা আগের মত প্রতাপ নিয়েই আছেন। বড়দাদা মারা যাওয়ার পর বড়দাদার নামে যত জমি বাবা কিনেছিলেন, নিজের এবং ভাইদের নামে সমান ভাগ করে দেবেন উদ্দেশ্য নিয়ে যখন গ্রামে গিয়েছেন, তাঁর সুযোগ্য ভ্রাতা রিয়াজউদ্দিন তাঁর সুযোগ্য পুত্র সিরাজউদ্দিনকে সঙ্গী করে বাবার মাথা মুলি বাঁশের আঘাতে ধরাতলে ফেলে ফের যদি গ্রামমুখো হন তবে জীবন নিয়ে আর ফিরতে হবে না হুমকি দিয়ে শহরের আপদকে শহরে বিদেয় করেন। বাবা বাড়ি ফিরে সাতদিন যত না শরীরের তার চেয়ে বেশি মনের অসুখে ভগু তে থাকেন। সারা জীবন আমি এ কি করলাম হায় হায় করেন, মা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ওদের ভালর জন্যই তো করছেন, এখন আর পস্তাইয়া কি হইব! শরীর সারে বাবার, মনের হাহারবও দূর হয়। জমির নেশা ধাঁ করে ছুটে এসে আবার তাঁকে কামড়ে ধরে। নানির বাড়ির পাশে কড়ইতলা, তার সামনে বিশাল খোলা মাঠ, ছোটবেলায় যে মাঠে আমরা গোল্লাছুট ডাংগুলি চোর চোর ক্রিকেট ইত্যাদি রাজ্যির খেলা খেলতাম, যে পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম, বস্তির মেয়েরা গোসল করত কাপড় ধুতো, মাঠের কিনারে বেড়ার যত ঘর ছিল সব কিনে নিয়ে ভেঙে চুরে বুজে সাফ করে পঁচিশটি বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন বাবা। দেয়াল তুলে দিয়েছেন রজব আলী কলোনির চারদিকে। দেয়াল তুলতে গিয়ে নানির বাড়ি থেকে বেরোবার রাস্তা গেছে বন্ধ হয়ে। নানি অনুযোগ করেন। কি গো নোমানের বাপ, রাস্তা যে বন্ধ কইরা দিলাইন! বাবা নানিকে কৈফিয়ত দেন না। কেবল আকুয়ায় জমি কিনে তাঁর আশ মেটে না। অবকাশের দেয়াল ঘেঁষা বাড়ির মালিক প্রফুল্ল ভট্টাচার্য মরে যাওয়ার পর যেদিন টপু করে তাঁর বউটিও মরে গেলেন, একটিই মেয়ে বোম্বে থাকে, সে মেয়ে মায়ের সৎকার করতে আসেনি, ঘর বাড়ি জিনিসপত্র জায়গাজমির দায়িত্ব নিতেও না, বাবা তক্কে তক্কে রইলেন প্রফুল্লর জমিটি সস্তায় কারও কাছ থেকে কিনতে পারেন কি না। বাবার তক্কে তক্কের মাথায় চাটি মেরে একদিন পরিমল সাহা প্রফুল্লর বাড়িতে বাস শুরু করলেন। প্রফুল্লর উত্তরাধিকারি জমি নিতে আসেনি, অনাত্মীয় প্রতিবেশি পরিমল সাহা প্রফুল্লর জায়গা দখল করে নিয়ে, বাবার বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে গা লাগিয়ে নতুন ঘর তোলার স্পর্ধা দেখিয়েছে। কেন তুলবে ঘর, বাবা পরিমলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। মা বলেন, এ তো আর এমন না যে আপনের জায়গার উপরে ঘর তুলছে, আপনের কোনও ক্ষতি করছে! খামাকা মানুষের বিরুদ্ধে লাগেন কেন! বাবার কটমট করে তাকানো চোখের দিকে তিক্ততা ছুঁড়ে দেন,ছোটলোকের পয়সা হইলে মানুষরে আর মানুষ জ্ঞান করে না। মা ঠিক বলেননি, বাবা কিন্তু কিছু মানুষকে নিজের ভাইয়ের ছেলেদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে জামাইদের চাকরি যোগাড় করে দিয়েছেন। আমানউদদৌলা গফরগাওঁ এ চাকরি করতে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন, গফরগাওঁ থেকে নেত্রকোনা বদলি হয়ে ওখানেও আরেকটি বিয়ে করেছেন। ভাইদের একাধিক বিয়েতে বাবার কোনও আপত্তি নেই। নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহে এলে চেম্বারে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আমানউদদৌলা, চাকরি বাকরি কেমন চলছে, টাকা পয়সা কেমন রোজগার হচ্ছে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন বাবা, কখনও তাঁর বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করেন না। আমানউদদৌলার ছেলেমেয়েদের তিনি লেখাপড়া করার সমস্ত খরচ দিচ্ছেন। প্রতি মাসেই আমানউদদৌলার বড় বউ এসে ছেলেমেয়ের ইশকুল কলেজের বেতন, মাস্টারদের বেতন, বই খাতা কেনার টাকা, বাড়িভাড়া এমনকি খাওয়ার দাওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়ে যান বাবার কাছ থেকে। বংশ প্রতিপালনে বাবার কোনও না নেই। হাসিনাকে বিএডএমএড পাশ করিয়ে ইশকুলের শিক্ষিকা বানানোর জন্য বাবার অতি-আবেগ দেখে মা একদিন বলেছিলেন, ছেলের বউএর লাইগা এত যে করতাছেন, ইয়াসমিনের কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়াডাও তো ঠিক মত দেন না! মানুষ তো নিজের মেয়ের জন্য করে, মেয়ে বাদ দিয়া ছেলের বউরে লইয়া পড়ছেন কেন?
বাবা ধমকে থামান মাকে, ছেলের বউ লেহাপড়া শিইখা নাম করলে কার লাভ? ইশকুল কলেজের মাস্টার হইলে কার লাভ? মাইনষে কি কইব হাসিনা মমতাজ অমুক ইশকুল বা অমুক কলেজে মাস্টারি করে? কইব ডাক্তার রজব আলীর ছেলের বউ মাস্টারি করে। ছেলের বউ আইছে আমার বংশে, মেয়ে ত যাইব গা পরের বংশে। মার গলায় ধিক্কারের সুর ওঠে, বংশ বংশ বংশ। বংশ ধুইয়া পানি খাইবাইন? আপনের মেয়ের আপনের প্রতি যে দরদ, সেই দরদ কি ছেলের বউএর কাছ থেইকা পাইবাইন? নিজের নামের কথা এত ভাবেন, নিজের বউরে যে কিছু দেন না, এই সব যদি মানুষে জানে, আপনের নাম কই যাইব?