অবকাশ সেই আগের মত আছে। বেঁচে আছে। মা সুহৃদকে পরম আদরে মানুষ করছেন। নিজের রক্ত-যাওয়া-অসুখ টির কোনও চিকিৎসা নেই জানার পর তিনি আর অভিযোগও করেন না এ নিয়ে। এমএড পাশ করার পর বাবার আদেশে শহরের ভাল ইশকুলগুলোয় শিক্ষিকা হওয়ার আবেদন জানিয়ে দরখাস্ত করেছে হাসিনা। মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে তৃতীয় বিভাগে পাশ করা হাসিনার পক্ষে বিএড এমএড ডিগ্রি নিয়েও চাকরি জোটেনা ভাল। কিন্তু বাবা লেগে থাকেন নতুন নতুন ইশকুলের খোঁজ করতে। স্বজন খুঁজতে থাকেন প্রীতি পেতে। ইয়াসমিনের উদ্ভিদবিদ্যায় মন নেই। মন প্রাণীবিদ্যায়। কলেজের নানারকম বান্ধবী-প্রাণী নিয়ে তার সময় কাটে। দাদা আরোগ্য বিতানে ওষধু ব্যবসায় যতটুকু মন দেন, তার চেয়ে বেশি দেন চিঠি লেখায়। প্রতি সপ্তাহে বত্রিশ পৃষ্ঠা লম্বা চিঠি লেখেন শীলাকে। প্রেমের চিঠি। ঘরে ফিরে তিনি মুমু মুমু বলে কাছে ডাকেন হাসিনাকে। তার সদারাগ মুখে হাসি ফোটাতে প্রায়ই সোনার গয়না আর দামি শাড়ি কিনে আনেন। হাসিনার মুখে হাসি ফোটানো দুরূহ কাজ।
আমার নাম হাসিনা সস্তা আমার হাসি না প্রতিদিনই বস্তা বস্তা অভিযোগ নিয়ে বসে দাদার সামনে। দাদা দুপুরে ফেরার পর বলে সে, মাকে নাকি সে বলেছিল আলু দিয়ে মুরগির মাংস রাঁধতে, মা পটল দিয়ে রেঁধেছেন। তার যেভাবে ইচ্ছে করে সেভাবে যদি তার খাওয়া দাওয়া না হয়, তবে তার আর স্বামীর সংসার করার ইচ্ছে নেই। এ কথা শুনেই দাদা দৌড়ে ঘরবার হয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাড়ির সবাইকে শুনিয়ে লিলির মাকে ডেকে বলেন, রাত্রে যদি আলু দিয়া মুরগির মাংস না রান্ধ্যা তাইলে পিটাইয়া তোমার লাশ ফালাইয়া দিয়াম।
মা শুনে ঘর থেকে বের হয়ে চিল্লিয়ে বলেন, লিলির মারে কস কেন? আমারে ক। আমি পটল দিয়া মাংস রানছি। রাইন্ধা যে অন্যায় করছি তার শাস্তি দে আমারে। পিটাইয়া লাশ ফালাইয়া রাখ। এইটাই ত বাকি আছে করার। মার কথার উত্তর না দিয়ে লিলির মার মুখে থাপড় দিয়ে দাদা গলা ছাড়েন, মুমু যেইভাবে কইব, ঠিক সেইভাবে চলবা। উল্ডা পাল্ডা কর তো মরবা। লিলির মা ফুঁপিয়ে বলতে থাকে, আপনেরা নিজেগোর মধ্যে গোস্বা করেন। আর রাগ ঢালেন আমার উপরে। আমি এই বাড়িত আর কাম করতাম না। লিলির মার ঘাড় ধরে বেলগাছের দিকে ধাক্কা দিয়ে দাদা বলেন, যাও গা, এক্ষুনি বাইর হও বাড়ি থেইকা। লিলির মাকে বাধা দেন মা, বলেন, সুহৃদের দাদা আসুক, তারে সব কইয়া পরে তুমি বাড়ি থেইকা যাইবা। মা দাদার উদ্দেশ্যে গলা নামিয়ে বলেন, আমি যে মা, লেখাপড়া না জানলেও, আইএ বিএ না পাশ করলেও আমি তো তর মা। আমারে ত একটওু মায়ের সম্মান দেস না! দাদা উঠোন থেকে টিনের ঘরটির বারান্দায় উঠেছেন মাত্র, ভেতর থেকে হাসিনা বলে, কইতে পারো না, সম্মান আশা করে কেন! আপন দেওরের সাথে লীলা কইরা আবার ছেলের সামনে সম্মান আশা করে! দাদা সায় দেন হাসিনার কথায়, উচিত কথা শুনাইয়া দেওয়া দরকার ছিল। বাবা ফিরলে মা আদ্যোপান্ত বলেন ঘটনা। এও বলেন, হাসিনা মনে করতাছে আমার ছেড়ারে সে নিজে বিয়াইয়া লইছে। বাবা দাদাকে ডাকেন, হাসিনাকে ডাকেন। বৈঠকঘরে বসে নিচু গলায় কথা বলেন দুজনের সঙ্গে। মা অন্য ঘরে অপেক্ষা করেন এই আশায় যে বাবা এবার একটি আইন করে দেবেন বাড়িতে যেন মার সঙ্গে রয়ে সয়ে কথা বলে পুত্রবধূ। পুত্রবধূ আজ যদি শাশুড়িকে অসম্মান করে, কাল শ্বশুরকেও করবে। কিন্তু শলা পরামর্শ বিচার যা হয়, তা হল এখন থেকে হাসিনার দায়িত্বে সংসার চলবে। অনেকদিন পর হাসিনার সদারাগ মুখ টিকে এক চিলতে হাসি খেলে।
হাসিনার হাতে সংসারের ক্ষমতা যেদিন চলে গেল, ছোটদা ময়মনসিংহে আসেন। সংসারের হস্তান্তর দেখে মাকে বলেন, ঠিকই হইছে মা, আপনে এখন আর সংসারের ঝামেলায় যাইবেন কেন? বৌদিই সব সামলাক। কিন্তু ছোটদা একা কেন? বউরে কি তার বাপের বাড়িত রাইখ্যা আইছ না কি? না বউ আনেননি ছোটদা। একা এসেছেন। সুহৃদকে দেখতে এসেছেন। সুহৃদকে দেখা যদি মূল উদ্দেশ্য হত, তবে তিনি ছেলের সঙ্গে মাত্র দুমিনিট কাটিয়ে কি রে বেড়াইতে যাইবি নাকি চল বলে আমাকে নিয়ে বেরোতে চান? কই যাইবা? চল চল। তরে একটা নতুন জায়গায় নিয়া যাই। নতুন জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে ঘুড়ির মত ওড়ে। ছোটদা দিন দিন সুদর্শন হচ্ছেন। শরীরে কোনও মেদ নেই। লম্বা ছিপছিপে। দেখে মনে হয় বয়স কমছে তার। ছোটদাকে এমনই বালক বালক লাগে দেখতে যে যখন তিনি আমাকে ক্যান্টনমেণ্টের এক আর্মি অফিসারের বাড়িতে নিয়ে গেলেন সন্ধেয়, অফিসারের সুন্দরী কচি বউটি বলল, কি কামাল, উনি কি তোমার বড় বোন নাকি? ছোটদা বাড়িটিতে বেশ য়চ্ছন্দে পায়চারি করতে করতে বললেন, কি যে বল, ও আমার আট বছরের ছোট। ছোটদা গীতার সঙ্গে যে সূরে আর ঢংয়ে কথা বলেন, নীনার সঙ্গেও একইরকম করে বলেন। নীনার চিবুক তুলে ধরে বলেন, বাহ দারুণ লাগতাছে তো! আমার নিজের চোখ কান কিছুকে বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হয় না যে আমার সামনের মানুষটি সৈণ্ত্র হিসেবে নাম কামিয়েছেন। চা টা কিছু খাবা? নীনা জিজ্ঞেস করে। ছোটদা বলে ওঠেন, না না কিছু খাব না। তোমারে দেখতে আসলাম সুন্দরী। দেইখা মন জুড়াইল। এখন যাই। ছোটদার ঠোঁটে অবিকল একই হাসি গীতার সঙ্গে প্রেম করার সময় যে হাসিটি তাঁর ঠোঁটে শোভা পেত। নীনা না না করে ওঠে, কি বল, বোনরে নিয়া আসছ কিছু খাও। রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে ছোটদা হাত ধরে টেনে নিয়ে আসেন নীনাকে, প্রায় বুকের কাছে লেপ্টে থাকে ছোটদার সুন্দরীটি। যাও কই? কিচ্ছু খাবো না, কখন তোমার জামাই আইসা পড়ব, আজকে যাইগা, আরেকদিন আসব নে। বলে সুন্দরীর গালে আঙুলের আলতো আদর রেখে ছোটদা বেরোন। জিজ্ঞেস করি ছোটদাকে, কে এই মেয়ে?