রাজাবাজারের মোড় থেকে একটি রিক্সা নিয়ে মহাখালি বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে থাকি। রুদ্রহীন ঢাকা শহর আমার কাছে ধু ধু মরুর মত লাগে। মহাখালি থেকে হঠাৎ ধুত্তরি বলে রিক্সা ঘুরিয়ে নয়াপল্টনের দিকে যাই। ভাল লাগে না ময়মনসিংহ যেতে। অবকাশে আমি অনাকাঙ্খিত অতিথি। মা প্রায়ই বলেন, বাপ মার অমতে বিয়া করছস। খুব সুখে না থাকবি কইছিলি! এখন এত বাপের বাড়ি আসতে হয় কেন? বাবার চোখের সামনে পড়লে কঠোর দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন, মাকে ডেকে বলেন, ওই ছেড়ি আমার বাসায় আইছে কেন? ওরে বাসা থেইকা ভাগাও। আমার বাসায় আসার ওর কি অধিকার আছে? আমি কি কামাই করি আরেক বেডার বউরে খাওয়ানির জন্য নাকি? ওরে খাওন দিবা না। নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়িতে উদাস বসে রুদ্রকে ভাবি, দিন রাত কি অক্লান্ত পরিশ্রম করছে বেচারা। নিশ্চয়ই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। নিশ্চয়ই বউটির কথা মনে করে যত শীঘ্র সম্ভব ফিরে আসতে চাইছে। পারছে না বলে নিশ্চয়ই তার কষ্ট হচ্ছে খুব। ইচ্ছে করে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিই আঁচলে। আমার এই মগ্নতায় টোকা দিয়ে গীতা বলে, কি রে, কি ভাবস? তর জামাই কই? তারে লইয়া আইলি না কেন?
আমার বুঝি একলা আসা মানা? সবসময় জামাই লইয়া আইতে হইব?
কি, রাগারাগি হইছে নাকি!
নাহ! রাগারাগি হইব কেন!
তাই তো মনে হইতাছে। জামাই আছে ঢাকায়?
নাহ।
গীতার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। টুলুর ঠোঁটেও হাসি। এ বাড়িতে গীতার ছোট ভাই টুলু থাকে। কালো-ছেলে মোটা-ছেলে, নাকের-নিচে-শুঁয়োপোকা-মোচ- ছেলে টুলুকে বাংলাদেশ বিমানে চাকরি দিয়ে ঢাকায় এনে ছোটদা নিজের বাড়িতে রাখছেন। বাঁকা হাসিটি নিয়েই টুলু হাঁক দেয় এক গেলাস জল দে তো নার্গিস। নার্গিস গেলাসে পানি নিয়ে টুলুর হাতে দেয়। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয় একটি মুহূতর্। চোখ সরিয়ে নেয় ও। কেন সরালো চোখ ও! ওর চোখে কি একটি তিরতির ভয় কাপঁ ছিল। পরমার কাজকর্ম করার জন্য অবকাশ থেকে ওকে এনেছে গীতা, পরমার কাজ তো আছেই, বাড়ির আর সব কাজ একাই ও করছে। পরমাকে কোলে নিয়ে বসে ভাবছিলাম নিজের একটি সন্তানের কথা, কোনও একদিন সন্তানের মা হব আমি, রুদ্র নিশ্চয়ই তখন নিজের বাচ্চা রেখে এমন দূরে দূরে পড়ে থাকবে না। ভাবনাটি ছিন্ন করে নার্গিসের উসকোখুসকো চুল, আধোয়া ছেঁড়া মলিন জামা, শুকনো মুখ ।
বিকেল ফুরোতে থাকে, খেয়ে ঘুমিয়ে আড়মোড়া ভেঙে পরমাকে আবার কোলে নিয়ে বসেছি সোফায়, নার্গিস বালতির পানিতে ত্যানা ডুবিয়ে জল চিপে ঘর মুছছে। এখনও সে গোসল করেনি, খায়নি। গীতা ভাত খেতে বললে তবে সে খাবে।
কি রে নার্গিস, আছস কেমন?
আপা, ময়মনসিং থেইকা আইছেন কবে? চাপা স্বরে নার্গিস জিজ্ঞেস করে।
আজকেই আইছি।
কবে যাইবেন?
জানিনা। তুই যাইবি ময়মনসিং?
হ।
নার্গিস চকিতে উঠে দাঁড়ায় উত্তেজনায়। গীতা ঘরে ঢুকতেই ও ত্রস্ত উবু হয় ত্যানায়। কি হইতাছে? গীতা প্রশ্ন চোখে নার্গিসের দিকে তাকায়।
ও তো এখনও খায় নাই! ওর তো খাওয়া দরকার! মিনমিন করি। চেঁচায় গীতা, সব কাজ শেষ হইলে পরে খাইব।
আমি নরম স্বরে বলি, ওর কি কোনও ভাল জামা টামা নাই নাকি? গোসল করে নাই কতদিন কে জানে!
এ কথা শুনেই গীতা ওর উবু হওয়া শরীরে একটি লাথি কষিয়ে বলে, বাথরুম মুইছা দেস নাই কেন? ও গোসলখানার মেঝে মুছে এসেছিল, টুলু গিয়ে ভিজিয়েছে আবার। এ কথা নার্গিস বলে না, বলি আমি। আমার এই নাক গলানোয় সে নার্গিসের চুলের মুঠি ধরে উঠিয়ে খাবার ঘরের মেঝেয় ওকে ফেলে শক্ত শক্ত লাথি মারতে থাকে বুকে মুখে। ঘর থেকে হেলে দুলে বেরিয়ে এসে টুলু বলে, দে এইডারে আরো দে, ছেড়িডা বড় শয়তান। আমি দৌড়ে গিয়ে নার্গিসকে গীতার লাথির তল থেকে টেনে সরিয়ে নিই।
গীতা আমার কোল থেকে পরমাকে ছিনিয়ে নিয়ে চেঁচাতে থাকে, আমার বাড়িতে থাকস, আমার খাস, আবার আমার নামে মানুষের কাছে বিচার দেস? কারও কি ক্ষমতা আছে আমার বিচার করার?
নার্গিসের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি, ও আমার কাছে বিচার দেয় নাই। আমিই কইছি।
যেই না বলেছি, পরমাকে টুলুর কোলে দিয়ে গীতা নার্গিসকে টেনে নিয়ে জানালার শিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চুলের মুঠি ধরে ওই শিকেই বার বার মাথা ঠোকাতে থাকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিই, চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ইচ্ছে করে এ বাড়ি থেকে এমুহূর্তে নার্গিসকে নিয়ে বেরিয়ে যাই, পারি না। ইচ্ছে করে ঠেলে সরিয়ে দিই গীতাকে, পারি না। এ বাড়ি আমার নয়, গীতার। তার আদেশ নির্দেশ মেনে চলতে হবে নার্গিসকে। জঘন্য দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে আমার আর ইচ্ছে করে না বাড়িটিতে দুদণ্ড থাকার। আমার সকল অক্ষমতা নিয়ে আমি বেরোই।
বাসে ময়মনসিংহ যেতে যেতে দেখি তিনটে ট্রাক রাস্তার কিনারে উল্টো পড়ে আছে। দুটো বাস খাদে। বাসদুটোর পাশে দশ বারোটি মৃতদেহকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। মনে হয় এ বাসটিও বুঝি খাদে পড়বে। এভাবে আমিও হয়ত আজ মরে পড়ে থাকব রাস্তার পাশে। কেউ জানবে না কি আমার নাম, কোথায় আমার বাড়ি। অজ্ঞাত পরিচয় মেয়েকে কোনও এক গণকবরে শুইয়ে দেওয়া হবে। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কেউ জানে না আমি আজ বাসে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যাচ্ছি। ঢাকা-ময়মনসিংহ বাসের দুর্ঘটনার খবর তারা জানলেও কেউ জানবে না দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যু হয়েছে। ভাবতে ভাবতে হাত ব্যাগ থেকে ছোট একটি কাগজ বের করে নিজের নাম ঠিকানা লিখে কাগজটি ব্যাগে ভরে, নতুন একটি ভাবনার শিকার হই, কি লাভ মৃতদেহের সৎকারে! মরে গেলে কি আর আমি বুঝবো আমার সৎকার মহা আড়ম্বরে করে হচ্ছে কি হচ্ছে না! হলেই বা আমার কি লাভ! গ্রামে পড়ে থাকা আমার লাশটি যদি শেয়াল শকুনে খায়, অথবা যদি সিল্কের কাফনের কাপড়ে আর আতর লোবানের ঘ্রাণে মুড়ে আমাকে ভাল একটি কবরে রাখা হয়, যদি শ্বেত পাথরে বাঁধিয়ে দেওয়া হয় কবর—কি পার্থক্য দুটিতে! মৃত্যুর পর আমার তো বোঝার শক্তি থাকবে না আমাকে কেউ ভালবাসছে কি বাসছে না। তখন যত্ন আত্তি পেলেই কি না পেলেই কি! মা বলেন, কবরে রেখে আসার ঠিক চারদিন পরই নাকি মানুষ ভুলে যায়, যত বড় স্বজন বা বন্ধু হোক সে। ভাবনাটি পাশে বসে থাকে, আমি ব্যাগ থেকে কাগজটি নিয়ে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে দিই জানালার ওপাশের হাওয়ায়। সন্ধের অন্ধকারের ছেঁড়া কাগজের টুকরো গুলো হারিয়ে যেতে থাকে।