আলাওল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে মুহম্মদ নূরুল হুদাকে। কিছু তরুণ কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হল। রুদ্রকেও। সে ফরিদপুরেও গেল আমাকে সঙ্গে নিয়ে। দল বেঁধে গ্রামে গিয়ে কবি জসিমুদ্দিনের বাড়ি দেখে এলাম, এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে র বিখ্যাত ডালিম গাছটিও। রুদ্রর সঙ্গ এবং জীবনের এই প্রচণ্ড গতি ও ছন্দ আমাকে অপার আনন্দে ডুবিয়ে রাখে। জীবন তো আমার আর সাধারণ দশটি বাঙালি বধূর মত হতে পারত। তেল ডাল নুনের হিসেব করে সংসার কাটতে পারত। সমাজের কুসংস্কার আর বিধি নিষেধ অমান্য করেই তো আমরা এতদূর এসেছি। তবে আর অত বেশি সামাজিক হওয়ারই বা স্বপ্ন দেখা কেন! রুদ্রর সঙ্গে আলাদা করে একটি সংসার হল না বলে আমার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা একটি আক্ষেপকে আমি ঝেঁটিয়ে বিদেয় করি। রুদ্র এখন নিজের সংসারটিকে চাইছে অন্য যে কোনও সংসার থেকে সম্পণূর্ আলাদা। জগত থেকে আলাদা হয়ে, মানুষ থেকে আলাদা হয়ে দুজনে স্বাথর্প রের মত কোনও খাঁচা তৈরি করার নাম সংসার নয়। বাইরের মুক্ত জগতে আমরা বাস করব, একটি বৈষম্যহীন সুস্থ সুন্দর সমাজের জন্য আমরা লড়াই করে যাবো, এভাবেই আমরা যাপন করব বিশ্বাসে ও ভালবাসায় আমাদের যৌথ জীবন। পরষ্পরের আমরা সহযাষনী বা সহযোদ্ধা হব। ক্ষুদ্র স্বা−র্থর লেশমাত্র যেখানে থাকবে না। রুদ্রর ভাইবোনেরা মোংলা বন্দরের স্যাঁতসেঁতে সম্ভাবনাহীন পরিবেশ থেকে ঢাকায় এসে নিজেদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে এক একজন বিশাল ব্যক্তি হয়ে দেশ ও দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবে। ওদের আমরা আমাদের আদর্শে গড়ে তুলব।
ঢাকায় চন্দনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। স্বামী নিয়ে ও তার স্বামীর বোনের বাড়িতে ছিল ও। যতক্ষণ আমি ও বাড়িতে ছিলাম, চন্দনা আমার সঙ্গে কথা বলেছে গলা চেপে। স্বামীসহ একদিন এসেও ছিল আমাদের বাড়িতে, ইচ্ছে ছিল কোনও রেস্তোরাঁয় খেতে যাবো সবাই মিলে। কিন্তু স্বামী বলল তার সময় নেই। আমার সঙ্গে সময় কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও স্বামীর কারণে চলে যেতে হয়েছে চন্দনাকে। চন্দনার জীবনটি দেখে আমার কষ্ট হয়েছে, এরকম একটি জীবনের স্বপ্ন কি ও দেখেছিল! না দেখলেও এ জীবনটিতেই ও এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। গলা চেপে কথা বলা কুণ্ঠিত জীবনে। চন্দনার, আমার ধারণা হয়, আকাশ দেখারও অবসর জোটে না হয়ত। অথবা দেখতে হলেও স্বামী বা স্বামীর কোনও আত্মীয়ের অনুমতি নিতে হয়।
ফেব্রুয়ারির উৎসব ফুরোলে রুদ্র আমাকে জিজ্ঞেস করে এই সংসারে তোমার কনট্রিবিউশান কি? শুনে আমি লজ্জায় বেগুনি রং ধারণ করি। প্রতি মাসে রুদ্র যেমন টাকা ঢালছে সংসারে, আমি কেন ঢালছি না! আমার এই না ঢালার কারণটি খুব সহজ, আমার হাতে কোনও টাকা পয়না নেই ঢালার, সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করছি, চাকরিটি পেলেই, যেহেতু আমি নারী পুরুষে বৈষম্যহীন জীবনের পক্ষপাতি, আমি যে স্বামীর ওপর অর্থ নৈতিক নির্ভরতা চাই না সে আমি প্রমাণ করতে পারব তার ওপর সংসারের খরচ অর্ধেক যোগাড় করতে পারব। কিন্তু সরকারি চাকরি না হওয়াতক আমি কেন উপার্জন করার চেষ্টা করছি না, না করে নিজের শরীরটিকে একটি মেদবহুল মাংসপিণ্ড তৈরি করছি! রুদ্র বলে, যদিও আমার শরীরে মেদের ছিঁটেফোঁটা নেই বরং পিঠে পড়া লম্বা চুলগুলো গীতার প্রেরণায় ঘাড় অবদি কেটে ফেলে আরও হাড়সর্বস্ব লাগে দেখতে। রুদ্রর উৎসাহে সিদ্ধেশ্বরীতে তার বন্ধু সেলিমের ওষুধের দোকানের ভেতর ডাক্তারের চেম্বারটিকে রোগি দেখার জন্য আমার বসার ব্যবস্থা হয়। শান্তিনগর মোড়ে বি এন মেডিকেল হলে
ডাঃ তসলিমা নাসরিন,
এম বি বি এস, বিএইচ এস আপার,
রোগী দেখার সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা
লেখা একটি সাইনবোডের্ ঝুলিয়ে দেয় সেলিম। ওখানে বিকেলে প্রজেশ কুমার রায় বসেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকেই পাশ করেছেন প্রজেশ, দাদার সহপাঠি ছিলেন ইশকুলে। প্রজেশ পিজি হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে চাকরি করেন, বিকেলে রোগী দেখতে বসেন বিএন মেডিকেল হলে। আমি প্রতিদিন হাতে স্টেথোসকোপ আর রক্তচাপ মাপার যন ্ত্র নিয়ে ফার্মেসিটিতে যাই। বসে থাকি চপু চাপ। রোগী আসার নাম গন্ধ নেই। রুদ্রকে বলি, ধুর রোগী আসে না, খামোকা বসে থাকা! রুদ্র বলে, উফ এমন বাচ্চাদের মত করো না তো! বসে থাকো, ধীরে ধীরে রোগী পাবে। দিন যায়, দু একটি রোগী যা মেলে তাতে আমার রিক্সাভাড়ার অর্ধেকও ওঠে না। কোনও একটি ক্লিনিকে চাকরি খুঁজতে থাকি। পত্রিকার পাতা দেখে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো খুঁজতে খুঁজতে ইস্কাটনের একটি ক্লিনিকে চাকরি পেয়ে যাই। ডিউটি রাতে। মাসে দেড়হাজার টাকা। প্রশিক্ষণ থেকে মাস মাস ভাতাও এই পেতাম। এ টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয় জানি। বাড়ি ভাড়াই বারোশো টাকা। কিন্তু তারপরও নিজে উপার্জন করার আনন্দই আলাদা। এ টাকায় নিজের হাত খরচ হবে, বাড়ির বাজার খরচাও হবে। ক্লিনিকে ঢোকার পর দেখি বাড়তিু উপার্জনের ব্যবস্থাও এখানে আছে। আমি যদি অপারেশনে এসিস্ট করি, তবে পাঁচশ থেকে একহাজার টাকা পেতে পারি। যদি রোগীর মেন্সট্রুয়েশন রেগুলাশেন অর্থাৎ এবরশন করি, তবেও পাঁচশ টাকা পাবো। রাতে যদি রোগী আসে সে রোগী দেখা আমার দায়িত্ব। রোগি যে টাকা দেবে ক্লিনিকে, তার থেকেও পারসেনটেজ পাবো। বাহ! বেশ তো। চাকরিটি চমৎকার চলছিল। মালিক ভদ্রলোকটি বেশ আন্তরিক। তিনি আমাকে এবরশান এর কটি রোগী দিয়ে এ কাজে হাত পাকানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু রোগীর ভিড় নেই এমন এক রাতে, দশটার দিকে, মালিক আমাকে দোতলায় তার আপিসরুমে ডেকে পাঠান। খুব জরুরি হলেই সাধারণত মালিক ডেকে পাঠান। কি কারণ ডাকার? না কোনও কারণ নেই, তিনি গল্প করবেন। আমি বলি আমার নিচে যেতে হবে, কারণ যে কোনও সময় রোগি আসতে পারে। আরে বাদ দেন, রোগী এলে নাসর্ আপনাকে ডাকবে, চিন্তু করবেন না। চিন্তা আমি ও নিয়ে করি না, কারণ জানি রোগী এলেই নাসর্ আমাকে খবর পাঠাবেন। চিন্তা করি মালিকের উদ্দেশ্য নিয়ে। মালিক কি কারণে আমাকে ডেকেছেন এখানে, কোনও জরুরি কথা কি আছে? থাকলে তিনি জরুরি কথাটি না বলে আমাকে বসতে বললেন কেন! বসলে ইন্দিরা রোডের রাজাবাজারে ঠিক কোন গলিতে আমার বাড়ি, তিনি প্রায়ই ওদিকে যান বলে কোনও এক বিকেলে আমার বাড়িতেও যাবেন, বলেন কেন! একজন কবিকে কি কারণে বিয়ে করেছি, কবিকে বিয়ে করে মোটেও বুদ্ধির কাজ করিনি, বলেন কেন! স্বামীকে আমার পাশে একদমই মানায় না, স্বামী নিয়ে আমি আদৌ সুখে আছি কি না ইত্যাদিই বা কেন! আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাঁর এত ভাবনা কেন! আমি নিশ্চিত, এগুলো কোনও জরুরি কথা নয়। কথা বলতে বলতে যে মাঝে মাঝেই চুমুক দিচ্ছেন গেলাসে, না বললেও আমি বুঝি তিনি মদ্যপান করছেন। নিশ্চিন্তে বসে, মালিক যা চাইছেন, সুখ দুঃখের গল্প করা আমার হয় না। আমি তাঁর অবাধ্য হয়ে নিচে নেমে আসি। নিচে নেমে শাদা একটি কাগজে বড় বড় করে লিখি সজ্ঞানে য়ইচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিচ্ছি আমি।
২৫. দূরত্ব
ছিয়াশি সালের শেষদিকে ঘটনাটি ঘটে। দেড়মাস পর ফিরবে বলে রুদ্র মোংলায় চিংড়ির ব্যবসা দেখতে গেলে যেহেতু আমার কিছু করার নেই ঢাকায়, ময়মনসিংহে চলে যাই। ময়মনসিংহ থেকে দেড়মাস পর ফিরে দেখি রুদ্র ফেরেনি এখনও। কবে ফিরবে জানতে চাইলে মেরি বলে আরও দুসপ্তাহ দেরি হবে। রুদ্রহীন ঘরটিতে একলা বসে থাকি, ঘরটি খুব খালি খালি লাগে। টেবিলে কবিতার খাতা পড়ে আছে, যেন লিখছিল, এই মাত্র উঠে সে অন্য ঘরে গেছে, এক্ষুনি ফিরে আবার লিখবে কবিতা। আমি চোখ বুজে অন্য ঘর থেকে রুদ্রর ফেরার অপেক্ষা করি মনে মনে। মনে মনে তার একটি হাত রাখি আমার কাঁধে, শুনি একটি খুব চেনা কণ্ঠস্বর, কখন এলে? সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি তোমার! কাঁধের হাতটি ক্রমশ নেমে আসছে বুকে, আরেকটি কাঁধেও আরেকটি উষ্ণ হাত, সেই হাতটিও নেমে আসছে। গা শিথিল হয়ে আসছে আমার, আমার গালে তার দাড়ি- গাল ঘসতে ঘসতে বলছে, সোনা আমার মানিক আমার, বউ আমার, তোকে ছাড়া আমি বাঁচি না রে! আমার তৃষ্ণাতর্ ঠোঁট জোড়া সিক্ত হতে চাইছে, ঠোঁটে তার দীর্ঘ দীর্ঘ উষ্ণ সিক্ত চুম্বন। অভূত এক শিহরণ আমার গা কাপাঁচ্ছে। মাথাটি এলিয়ে পড়ে টেবিলের খাতায়। অনেকক্ষণ ওভাবেই পাওয়ায় না পাওয়ায় চণূর্ হই। খাতাটির শেষ পাতায় লিখি, আমার ভাল লাগছে না, ভাল লাগছে না। কেন আসোনি তুমি। বউ ছেড়ে এত দীর্ঘদিন কি করে থাকো তুমি। বড় একা লাগে আমার। তুমিহীন একটি মুহূতর্ও আমার কাছে অসহ্য। আমার আপন কেউ নেই এক তুমি ছাড়া। আমার জীবন কাটে না তুমি ছাড়া। হয় আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও, নয় তুমি আমার কাছে চলে এসো। গোছানো বিছানাটির দিকে তাকিয়ে থাকি এক শরীর তৃষ্ণা নিয়ে। একটি বেদনার্ত হাত এগিয়ে যায় বিছানার চাদরে রুদ্রর ফেলে যাওয়া স্পর্শ পেতে, বুলোতে থাকে চাদর। ফেলে যাওয়া ঘ্রাণ পেতে বালিশে মুখ চেপে তার ছিঁটেফোঁটা শুঁকতে শুঁকতে বলি, কবে আসবে তুমি, আমার আর ভাল লাগে না একা থাকতে। তুমি ফিরে এসো প্রাণ। আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার নিতিসুখ ফিরে এসো। আমার সর্বসুখ তুমি ফিরে এসো। বালিশ ভিজে যায় শব্দহীন কান্নায়। সচকিত হই বাড়ির মানুষদের সম্ভাব্য কোতূহলের কথা ভেবে, দুহাতে চোখ মুছে, মেরিকে ডেকে, আমি না হয় দুসপ্তাহ পর ফিরব, বলে দরজার দিকে এগোতে নিলে ও বলে, এক্ষুনি যাচ্ছ বৌদি? বসো, চা খেয়ে যাও। শুষ্ক-হাসি ঠোঁটে, বলি, না চায়ের তৃষ্ণা নেই।