ছোটদা মখু ছোট করে বললেন না মা, আমি খাইছি বাইরে।
মা উদাস বসে থাকেন খাবার টেবিলে সামনে ছোটদার না খাওয়া ভাত তরকারি নিয়ে।
মার চোখের পুকুরে ছোট ছোট ঢেউ।
ছোটদাকে উঠোনের রোদে পিঁড়ি পেতে বসিয়ে গা মেজে এই সেদিন গোসল করিয়ে দিতেন মা। এখন ছোটদা নিজেই নিজের গোসল সারেন। মা প্রায়ই বলেন কি রে তর গোড়ালিতে এত ময়লা জমছে কেন, মাজস না নাকি? ছোটদার চুল সরিয়ে কানের পেছন, ঘাড়ে, গলায় আঙুল ডলে মা বলেন, কড় পইড়া গেছে। মা নাক কুঁচকে উঠোনে থুতু ফেলেন। ছোটদা না গোড়ালির দিকে, না মার দিকে ফিরে তাকান। তিনি তাকিয়ে থাকেন গীতার দিকে। গীতার মখু টি বিষণ্ন লাগছে কেন! গীতার মখু টি কিছুক্ষণ আগে বিষণ্ন ছিল না, গীতা ইয়াসমিনের সঙ্গে লুডু খেলছিল আর ডিমের পুডিং খাচ্ছিল। অনেকদিন নাকি পুডিং খায়নি ও, অনুযোগ করাতে মা সাততাড়াতাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। পুডিংএর পর চেয়েছিল খেঁজুরের গুড় দিয়ে বানানো পায়েশ খেতে, মা তাও দিয়েছেন। দিয়ে মা ফুঁকনি ফুঁকে খড়ি নেই শুকনো পাতায় রান্না করেছেন, খেতে দিয়েছেন টেবিলে, ছোটদা গীতাকে কোলের ওপর বসিয়ে ঠোঁটে চুমু খাচ্ছেন, চুমু খাচ্ছেন আর বলছেন মনডা বেজার কেন, কি হইছে? গীতা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কোনও উত্তর দেয় না। ছোটদা বাড়ি এলেই গীতার হাসি মখু টি হঠাৎ কান্না কান্না হয়ে থাকে। মখু টি এমন যেন সারাদিন খায়নি, জল অবদি পান করেনি, যেন বাড়ির মানুষগুলো গীতাকে সারাদিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন ছোটদা, গীতার শুকনো মখু ভেজা করতে, কান্না কান্না মুখে হাসি ফোটাতে দিন রাত উপুড় হয়ে পড়ে থাকেন গীতায়। মা লক্ষ করেন। আমরাও। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন গোপনে। গল্প উপন্যাস বা সিনেমা থিয়েটারের প্রেম কাহিনীর চেয়ে আমাদের বাড়িতে ঘটতে থাকা প্রেম কাহিনীতে আমরা বিভোর হয়ে থাকি। চোখের সামনে কাউকে কি এ যাবৎ দেখেছি এক বাড়ি মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরতে, ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে! না।
আমি আর ইয়াসমিন গীতাকে বিস্ময় চোখে দেখি। গীতা ইস্ত্রি করা শাড়ি ভাঁজ খুলে খুলে পরে, উঁচু জুতো পরে, লিপস্টিক লাগায় ঠোঁটে, কপালে টিপ পরে, সগু ন্ধি লাক্স সাবান নিয়ে গোসলখানায় যায়। ওর সব কিছুই অন্যরকম। আমাদের চুল প্রথম বাংলা সাবান দিয়ে ধুয়ে পরে গোসলের সাবান দিয়ে ধুই। ছোটবেলা থেকেই মা এভাবে ধুতে শিখিয়েছেন। চুলের ময়লা দূর করতে গোসলের সাবান খরচ করলে সাবান ফুরিয়ে যাবে বলেই এই কপৃ ণতা। কারণ বাবা বাংলা সাবানই বেশি বাড়িতে পাঠান, গোসলের সগু ন্ধি সাবান কদাচিৎ। মাকে চারদিকে কাপর্ণ ্য করতেই হয়। বাবার ধন তো, মা বলেন, এক সংসারের জন্য নয়, গ্রামে তাঁর বাবা মা ভাই বোনের সংসার আছে, শহরে তাঁর দ্বিতীয় বউ এর সংসার। মাকে দু রকম খাবারও রাধঁ তে হয়। বাড়ির সবার জন্য এক রকম, মা আর কাজের মানুষগুলোর জন্য আরেকরকম। সেই আরেকরকমে বাসি ডাল, শুটকির তরকারি আর নিরামিষ ছাড়া অন্য কিছু যদি জোটে সে কাঁচকি মাছ নয়ত টেংরা-পুঁটির ঝোল। মাছ মাংস রান্না হলে সে আমাদের জন্যই থাকে। আমাদের মানে বাবা, ভাই বোন আর নতুন আসা গীতা। গীতাকে আগে থেকেই চিনি, এ নতুন গীতা নয় কিন্তু কামালের বউরূপে আসা গীতাকে অবকাশে অন্যরকম দেখতে লাগে। বাবার সামনে মাথায় কাপড় দেওয়া, মার সামনে মাথার কাপড় ফেলে দেওয়া, আমাদের সামনে ধেই ধেই করে নেচে বেড়ানো, ছোটদার সামনে গাল ফুলোনো গীতার সব ব্যাপারে আমার আর ইয়াসমিনের বেড়ালি কৌতুহল। স্বামী স্ত্রীর জীবন চোখের সামনে যা সবচেয়ে বেশি দেখা আমাদের,তা বাবা মার। বাবা মার সম্পর্কে তেল নুন চাল ডালের হিশেবের মধ্যে বাঁধা, এক সঙ্গে দুজনকে আমি কোনওদিনই ঘনিষ্ঠ দেখিনি,মধুর কোনও বাক্যালাপও ঘটতে দেখিনি, একসঙ্গে কোথাও দুজন বেড়াতে যান নি, এক ঘরেও এখন ঘুমোন না, এক বিছানায় তো নয়ই। মার ছোট ঘরটি ছোটদা আর গীতার জন্য গুছিয়ে দেওয়ার পর মা উদ্বাস্তুর মত থাকেন, কোনওদিন আমার ঘরে, কোনওদিন বৈঠকঘরের মেঝেয় বিছানা পেতে। বাবা হচ্ছেন বাড়ির কর্তা, বাবা যেভাবে আদেশ করবেন, সংসার সেভাবে চালাতে হবে মাকে, এরকমই নিয়ম। এই নিয়মে অভ্যস্ত আমাদের সামনে এক দম্পতিকে আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করি, স্ত্রী সেবায় সদা সর্বদা সজাগ স্বামী। অন্যরকম বৈকি। মার নজরে পড়ে ঘটনা, আমাদেরও পড়ে। আমাদের কৌতূহল বাড়ে, আমার আর ইয়াসমিনের। মার কমে। মা অচিরে টের পান মার কোলের ছেলে মার তোতলা ছেলে মার কোল ছাড়া হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ছোটদার জগত জুড়ে জীবন জুড়ে এখন গীতা। গীতাকে সুখী করতে যা কিছু করতে হয় করবেন। মা বাবা ভাই বোনের মূল্য তাঁর কাছে আর নেই। মা উদাস বসে থাকেন একা বারান্দায়, থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কামাল যে কহন বাসাত আসে, কহন যায়, কিছুই টের পাই না। আমারে আর মা মা কইরা ডাকে না, ডাইকা কয় না মা যাই, মা আইছি।
গীতা হঠাৎ একদিন ঢাকা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গীতার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর হাত আমাদের তো নেই-ই, ছোটদারও নেই। বাক্স পেটরা নিয়ে সে যেদিন অবকাশ ছেড়ে যাচ্ছে, কালো ফটক ধরে আমরা করুণ চোখে তাকিয়ে ছিলাম তার চলে যাওয়ার দিকে। ঢাকায় আমানুল্লাহ চৌধুরির বাড়িতে যাচ্ছে গীতা। আমানুল্লাহ চৌধুরির বাপের বাড়ি ময়মনসিংহে, গীতার বাড়ির কাছেই, সেই সূত্রে চেনা। চৌধুরির বউ রাহিজা খানম নাচের ইশকুল খুলেছে, সেই ইশকুলে নাচ শিখবে গীতা। রাহিজা সুযোগ দিলে গীতা বড় নৃত্যশিল্পী হতে পারবে। নাচের অনেক মেয়েই চৌধুরির বাড়িতে থাকে, চৌধুরির বাচ্চা কাচ্চাদের দেখে রাখে। গীতাও তাই করবে। বউকে ঢাকায় রেখে ময়মনসিংহে ফিরে আসেন ছোটদা। পরের সপ্তাহে বাবা ছোটদার হাতে টাকা দিয়ে ঢাকা পাঠালেন আবার, গীতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর আদেশ। গীতাকে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি করিয়ে দিয়ে ছোটদা ফেরেন। নিজের বাংলায় অনাসর্ পড়া গোল্লায় গেলেও গীতাকে বিদূষী বানাবেন, এই স্বপ্ন ছোটদার। ছোটদার কাজ এখানে নিজের ভবিষ্যত তৈরি করা, ভাল চাকরি জোটানো টাকা পয়সা যতটা পারেন কামিয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া। বাড়িতে যতক্ষণ তিনি থাকেন, বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরে বসে লম্বা লম্বা চিঠি লেখেন, বিয়ের আগে যেমন লিখতেন, সেই সব বত্রিশ পৃষ্ঠা চিঠির মত চিঠি। ওদিক থেকে চিঠি আসে, ছোট চিঠি, চিঠির সঙ্গে লিষ্টি আসে। লিস্টি পকেটে নিয়ে ছোটদা বেরিয়ে যান, জিনিসপত্র কিনে কাগজে মুড়ে বাড়ি নিয়ে এসে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে বড় বড় প্যাকেট করেন ঢাকা পাঠাতে। মা দেখেন, আড়ালে চোখের জল মোছেন। এই যে কামাল টাকা কামাইতাছে, বউরে কত কিছু জিনিস কিন্যা দিতাছে, কোনোদিন তো কইল না মার হাতে কিছু টাকা দিই। পাঁচটা টাকাও ত সাধে নাই কোনওদিন। মার এই হাহাকার কাউকে স্পর্শ করে না। মা একাই ছিলেন, আরও একা হতে থাকেন। অন্ধকারে বারান্দায় বসে থাকা মার হাতের তসবিহর গোটা স্থির হয়ে থাকে।