আচ্ছা শরাফ আইছিল এর মধ্যে? দাদা দুই ভুরুর মাঝখানে ঢেউ তুলে জিজ্ঞেস করেন।
কি জানি জানি না।
নিশ্চয় আইছিল।
কেমনে বুঝলা আইছিল?
আমার ওষুধ আমি গুইনা কম পাইতাছি।
শরাফ মামা নিছে নাকি?
ও একটা আস্তা চোর। ও নিছে নিশ্চয়।
শুনে চৌচির কণ্ঠে মা বলেন,দেখ নোমান, না জাইনা না শুইনা মাইনষেরে হুদাই দোষ দিস না। শরাফ এই বাড়িতে আজকে তিনমাস ধইরা আসেনা। আর ওরে যে চোর কস, ও কি চুরি করছে তর?
আরে জানেন না মা, ও আমার কাছ থেইকা পঞ্চাশ টাকা কর্জ নিছিল, কইল পরদিনই নাকি দিয়া দিব। পাঁচমাস হইয়া গেল, দেওনের নামগন্ধ নাই।
মা অন্য ঘরে চলে যান। অন্য ঘরে একা বসে থাকেন। অন্য ঘরের জানালা দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসে, মা সেই হু হু হাওয়ার সঙ্গে মনে মনে কী কথা বলেন কে জানে। মার কষ্টের কথা আমরা কেউ বুঝি না, দাদার সঙ্গে তাল দিয়ে বলি শরাফমামা আসলেই একটা চোর, সেইদিন সে আইল, আমি তারে ঘরে রাইখা একটু বাইরে গেলাম, ফির্যা আইসা দেখি আমার স্বর্ণের দুলটা নাই, রাখছিলাম টেবিলের উপরে।
তাইলে তর ওই দুল শরাফই নিছে। দাদা নিশ্চিন্ত।
দাদা অবশ্য তাঁর ওষধু থেকে থেকে নেই হয়ে যাওয়ার রহস্য উদ্ধার করেন পরে। ছোটদার ঘরে কখনও কোনও কারণে গেলে আলনাতেও চোখ পড়ে তাঁর। নিজের ছ সাতটা শার্ট ছোটদার আলনা থেকে তুলে নিয়ে বেরোন ঘর থেকে, বারান্দায় বেরিয়ে মাকে দেখিয়ে বলেন কামালের ঘর সিজ কইরা এইগুলা পাইলাম।
এসব দেখে গীতা ছোটদাকে বলে, মইরা যাইতে পারো না? এই জীবন নিয়া বাঁইচা থাকার তোমার কি দরকার! নিজের মুরাদ থাকলে শার্ট কিন্যা লও। না পারলে ল্যাংটা থাকো। শুনে ছোটদা কালো মাড়ি বের করে হাসেন। গীতা চাপা স্বরে বলে, হাসো? লজ্জা শরম কিছু কি তোমার আছে? বাড়ির সবাই তোমারে অপমান করতাছে, তাতেও তোমার শিক্ষা হয় না! আমারে কেন এই নরকের মধ্যে আইন্যা ফেলছ?
গীতার মেজাজমজির্ বাড়ির কারও সাধ্য নেই বোঝে। এই নেচে বেড়াচ্ছে, হেসে বেড়াচ্ছে, এই আবার মখু গোমড়া করে বসে আছে। কখনও কখনও দরজার ছিটকিনি এঁটে সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে। খাবার সময় হলে মা বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকেন ও আফরোজা, আফরোজা! উঠ। খাইবা না? না খাইলে শরীর খারাপ হইব। উঠ আফরোজা, খাইয়া লও। গীতা মিত্র ওরফে আফরোজা কামাল মখু বিষ করে অনেক ডাকার পর উঠে খেয়ে দেয়ে আবার শুয়ে পড়ে। অনেকদিন পর মা তাঁর দেরিতে দুধ ছাড়া, দেরিতে কথা বলা, প্রায়-তোতলা প্রায়-কোলের ছেলেকে কাছে পেয়েছেন, ছেলে আর ছেলে-বউএর খাবার নিজে হাতে রেধেঁ বেড়ে ঘরে আনেন, ঘরেই ওদের, প্রায়-মুখে তুলে খাওয়ান। আধেক হিন্দু আধেক মুসলমান বউটির মন ভাল করার জন্য মা আদাজল খেয়ে লাগেন যেহেতু বউটির মন ভাল থাকলেই ছোটদার মন ভাল থাকে। অথবা গীতার মন পেতেই মা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন যেহেতু বাড়ির আর কারও মন পাওয়া দুরূহ ব্যাপার, অথবা বাবার হম্বিতম্বিতে অনভ্যস্ত গীতাকে মা আদরে আহলাদে সহনীয় করাতে চান এ বাড়ি। বাড়ি ফিরে ছোটদা, কোনওদিকে না ফিরে, সোজা ছোট ঘরটিতে ঢুকে যান। ভেজানো দরজা ঠেলে হঠাৎ ঢুকলেই দেখি গীতা দেয়ালের দিকে মখু করে শুয়ে আছে, ছোটদা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর ধ্যানমগ্ন ঋষির মত জপ করছেন, গীতা গীতা গীতা ও গীতা।
ছোটদার হাতে লিস্টি পড়তে থাকে, গীতার ব্লাউজ লাগবে, শাড়ি লাগবে, লিপস্টিক লাগবে, রুজ পাউডার লাগবে। শুকনো মখু ছোটদার আরও শুকনো লাগে, শুকিয়ে ঠোঁটের চামড়া ফেটে যেতে থাকে। বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গে কথা কোনও প্রয়োজন ছাড়া বলেন না। অন্যমন।
ছোটদার চাকরি করার খবর পেয়ে বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—নিজের কপাল নিজে খাইলে কার কী বলার থাকে। না,কারও কিছু বলার থাকে না। ছোটদা নিজের কপাল রীতিমত চিবিয়ে খাবার ব্যবস্থা করলেন। সাংবাদিক হয়ে গেছেন, হাতে একটি ডায়রি নিয়ে সকালে বেরিয়ে যান, দুপুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে আবার বেরোন, সন্ধেয় ফেরেন বউ এর জন্য কোনওদিন শাড়ি, কোনওদিন ব্লাউজ, কোনওদিন রুজপাউডারলিপস্টিক নিয়ে। ছোটদা বাড়ি এলেই মা রান্নাঘরে চলে যান খাবার আনতে। যেদিন ফিরতে ছোটদার বিকেল হল, টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছেন মা, ছোটদা ঘর থেকে শুকনো মুখে বেরিয়ে খেতে আসেন,না একলা নয়, গীতার কোমর জড়িয়ে টেনে আনছেন সঙ্গে খেতে। গীতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলছে, আমার আবার খাওয়া কি! আমার না খাইলেও চলবে। অথচ গীতা আমাদের সঙ্গে খেয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছিল, কিন্তু মুখ এমন শুকনো যে ছোটদা ধারণা করেন তাঁর সুন্দরী বউখানা না খেয়ে কাঁটা হয়ে যাচ্ছে। গীতা খাবে না বলে ছোটদাও খাবেন না। মা বললেন ও যখন কইতাছে, ওর সাথে আরেকবার খাও আফরোজা।
না। না। আমি খাব না।
ছোটদা গীতাকে টেনে এনে কাছে বসিয়ে ভাত তরকারি মেখে গীতার মুখে তুলে দেন। গীতা মুখে ভাত নিয়ে নাক কপাল কুঁচকে রাখে, যেন বিষ দেওয়া হয়েছে মুখে। মুখের বিষ মুখেই রেখে দেয় সে, চিবোয় না, গেলে না। ছোটদা গীতার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন সোনা আমার, মানিক আমার, অল্প একটু খাও। তুমি না খাইলে আমি খাব না।
গীতা বিষ গিলল না, ছোটদাও খেলেন না। উঠে গেলেন। মা রান্নাঘর থেকে প্রায় দৌড়ে এসে উঠলেন খাবার ঘরে, হাতে বাটি, বাটিতে মাংস,কী রে আমি আরও তরকারি লইয়া আইলাম তুই উঠলি কেন? খাইয়া ল। সারাদিন খাস নাই, কামাল!