ভিটামিনে বেশিদিন পড়ে থাকেন না ছোটদা। কাশির ওষধু , জ্বরের ওষুধ, এমনকি কঠিন কঠিন রোগের কঠিন কঠিন ওষধু সরাতে শুরু করলেন। কেন? বন্ধুরা চাইছে। কেন? বন্ধুরা ওষুধ চাইছে, কারও কাশি কারও জ্বর কারও পেটের ব্যারাম, কারও আলসার। কিন্তু বন্ধুদের কি অসখু লেগেই থাকে বছরভর!
আমার কি একটা দুইটা বন্ধু নাকি!
তা ঠিক, ছোটদার বন্ধুর সীমা নেই। বাড়িতে ছোটদার খোঁজে সাংবাদিক বন্ধু কবি বন্ধু নাট্যকার বন্ধু, চিপাচস বন্ধু ছাত্র, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, বেকার—নানা রকম বন্ধু আসেন। গোঁড়ালি থেকে মাথা, মাথা থেকেও চার পাঁচ হাত উঁচু বয়সের বন্ধু ওঁদের পর্দার আড়াল থেকে দেখি, দেখি আর ইচ্ছে করে ছোটদার মত আমিও ওঁদের সঙ্গে আড্ডা দিই। আমার সে সাহস শক্তি সুযোগ কোনওটাই যে নেই, তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই অবশ্য।
তোমার বন্ধুদের এত অসখু হয়। দেখলে ত মনে হয় দিব্যি সুস্থ।
খালি কি বন্ধুদেরই। বন্ধুর বাবার অসুখ, মার অসখু । ওদের কি কম আত্মীয় স্বজন !
কি কর ছোটদা ওষুধ নিয়া, সত্যি কইরা কও তো! একদিন বলি।
ছোটদা রহস্যের রসে ঠোঁট ডুবিয়ে হাসেন।
কেন, কি হইছে?
কিছু হয় নাই। কিন্তু আগে কি কর কও, নাইলে দাদার কাছে কিন্তু কইয়া দিয়াম। আমার হুমকিতে কাজ হয়। ছোটদা বলেন বেচি রে বেচি।
ছোটদার কথায় কাজ হয়, আমি গলে যাই মায়ায়। নিজেই দাদার বাক্স থেকে দামি ওষধু দএু কটি সরিয়ে ছোটদার হাতে দিই, ইয়াসমিনও দেয়। দাদা বাড়ি থেকে যেই না বেরোন, ছোটদা সঙ্গে সঙ্গে ও ঘরে ঢুকে ওষধু তো আছেই, টাকা পয়সা দাদা কোথাও ভুলে রেখে গেলেন কি না খোঁজেন, শেষে আলনা থেকে একটি শার্ট গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরোন। দাদার অগুনতি শার্ট, টের পান না। হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে গেলে কালো ফটকের মুখে বা রাস্তায়, দাদা মখু কালো করে বলেন কী রে কামাল আমার শার্ট পরছস কেন? ছোটদা বলেন,পরছিলাম,খুইলা থইয়ামনে, চিন্তা কইর না।
একদিন,আইচ্ছা আমার টেট্রনের নীল শার্টটা কইরে? প্যাণ্টের ওপর গেঞ্জি গায়ে মোজা পায়ে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বোকা বোকা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলতে থাকেন দাদা।
কী জানি, মা ধুইতে নিছে বোধহয়!
আরে না, ওইটা ধোয়া ইস্ত্রি করা ছিল।
তাইলে জানিনা।
শাদা শার্টটাই বা কই! পকেটে যে শীলা ফুলের কাজ কইরা দিছিল!
সেইটা না তুমি কালকে পরলা!
আরে না, কালকে ত আমি লাল শার্ট পরছি।
মারে জিগাস কর, আমি জানি না।
দাদা মাকে জিজ্ঞেস করেন, মাও জানেন না।
ক্যাঁটকেঁটে লাল কুচরিমুচরি একটি শার্ট পরে মন খারাপ করে বাইরে চলে যান দাদা। তাঁর ব্যস্ততা অনেক, ফাইসন্স কোম্পানীর রিপ্রেজেনটেটিভ তিনি, আজ টাঙ্গাইল যাচ্ছেন, পরশু নেত্রকোণা, নেত্রকোণা থেকে ফিরেই আবার জামালপুর। দাদার ফর্সা মুখ রোদে ঘুরে ঘুরে কালো হয়ে যেতে থাকে। দাদার জন্যও আমার মায়া হয়।
ছোটদাকে বলি, ওষধু বেইচা অনেক টাকা পাও, তাইলে আমার থেইকা আর দুই তিন টাকা নেও কেন!
কি যে কস! বেশি টাকা পাই না তো! এইগুলা তো স্যাম্পল,ডাক্তারদেরে দেওয়ার জন্য, দেখস না লেখা আছে বিক্রয়ের জন্য নহে! যা দাম, তার অর্ধেকের চেয়ে কম দাম দেয় দোকানদাররা। ছোটদা বুঝিয়ে বলেন।
ওষুধের থলে হাতে করে প্রায়ই বেলগাছের তল দিয়ে ছোটদার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মাও লক্ষ্য করেন, বাবাকে কোমল কণ্ঠে বলেন, কামালরে একটা ভাল চাকরি টাকরির ব্যবস্থা কইরা দেওয়া যায় না!
বাবারও কোমল কণ্ঠ, হ,দিতে পারি। কুলিগিরি করার একটা ব্যবস্থা কইরা দিতে পারি।
এইসব কি কন!
কেন? কুলিগিরি তো ভাল চাকরি। কুলিগিরি কইরা মাইনষে থাকতাছে না? ও করুক। কুলিদের তো লেখাপড়া না করলেও চলে। বস্তাডা মাথায় উঠাইয়া হাঁটলেই হয়, ফিজিক্স জানতে হয় না, কেমেস্ট্রি জানতে হয় না।
কোমল থেকে দৌড়ে কণ্ঠ রোষের দিকে যাচ্ছে, লক্ষ করে সরে যান মা।
গীতা নতুন নতুন শাড়ি পরে বাইরে যাচ্ছে ছোটদার সঙ্গে, নতুন নতুন সাজার জিনিস ওর। মা আড়ে আড়ে এসব দেখে ছোটদাকে বলেন তা কামাল, তর ত একটা ভাল প্যান্ট নাই, শাটর্ও নাই, নোমানের শাটর্গু লা পরস, তুই নিজের লাইগা শার্ট প্যান্ট কিনতেও ত পারস! ঘরের মধ্যে ছিঁড়া লঙ্গি পইরা থাকস। নিজেরে শাতাস ক্যা?
টাকা আছে নাকি কিনব? ছোটদা মলিন মখু করে বলেন।
টাকা নাই কেন? চাকরি করস না?
যে টাকা পাই চাকরি কইরা, রিক্সাভাড়াও হয় না।
বউএর লাইগা ত ঠিকই কিন্যা আনস।
গীতার লাইগা? গীতারে ত আমি কিচ্ছু দিতে পারি না। ওর যা আছে, ওর নিজের। ওর মা দিছে।
শুন বাবা কামাল। তোমার কাছে আমরা কিছু চাই না। তুমি তোমার বউরে কিন্যা দিবা তা ত ভাল কথা। বউরে তুমি দিবা না তো কে দিব! আমার কথা হইল, নিজেরেও তুমি কিছু দিও। তোমার একজোড়া ভাল সেন্ডেল নাই। সেন্ডেল কিনো।
পইসা দেন, কিনি। ছোটদা বলেন।
অনেকক্ষণ নৈঃশব্দের পুকুরে একা একা সাঁতার কেটে পাড়ে ওঠেন মা।
আমার টাকা থাকলে তো তোমারে দিতামই। আমারে টাকা পয়সা কে দেয়! মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বলতে বলতে,লেখাপড়া যদি করতে পারতাম, তাইলে তো একটা চাকরি করতে পারতাম। আমার কি কারও ওপর নির্ভর করতে হইত!
এরপর দু সপ্তাহ ধরে বাবার কাছে হাত পেতে পেতে টাকা নিয়ে মা ছোটদার জন্য একটি লুঙ্গি, দুটি শার্ট আর একজোড়া বাটার সেন্ডেল কিনে আনলেন। ছোটদার অভাব তবু শেষ হয় না। তিনি সকাল বিকাল ওষধু সরাতে থাকেন।