গেছো গীতা কেবল গাছেই নয়, গাছের তলেও লাফায়। নাচ শেখাবে বলে পড়ার টেবিল থেকে আমাকে আর ইয়াসমিনকে উঠিয়ে নিয়ে সারা বাড়িতে তা তা থৈ থৈ করে বেড়ায়। আমি আর ইয়াসমিন খুব অচিরে বড় নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠছি এই বিশ্বাস আমার বা ইয়াসমিনের না থাকলেও গীতার আছে। বাবার বাড়ি আসার শব্দ পেলে নাচ রেখে দৌড়ে পড়ি কি মরি পড়ার টেবিলে গিয়ে বসি, বাবার গায়ে হাওয়া লাগে ছুটোছুটির। প্রায় রাতেই ঘুমোতে যাবার আগে আমাকে ডাকেন, ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করেন, খাওয়া দাওয়া হইছে?
দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে উত্তর দিই, হইছে।
পড়ালেখা হইছে?
হইছে।
খেলাধুলা হইছে?
প্রায় ঠোঁটের কাছে হইছে শব্দটি এসে যাচ্ছিল, গিলে অন্য এক শব্দজোড়া ব্যবহার করি, হয় নাই।
আড্ডা মারা হইছে?
হয় নাই।
বাবা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে বলেন, কেন হয় নাই?
শব্দজোড়া দূরে থাক, কোনও শব্দই তখন আমার মুখে নেই।
কেন হয় নাই আড্ডা মারা? বাড়িতে তো এখন সঙ্গী সাথীর অভাব নাই।
আমি দরজার পর্দা আঙুলে পেঁচাতে থাকি।
বাবা বলেন আড্ডা মারা তো ভাল, পড়ালেখা করতে হয় না, পরীক্ষায় পাশ করতে হয় না। দেখ না তোমার ছোটদা, কত সুন্দর জীবন তার! লেখাপড়ার মত বাজে কাজ তার আর করতে হয় না।
আঙুল থেকে দরজার পর্দা ছাড়াতে থাকি।
কাল সকালে যখন আমি বাইরে যাব, তখন তুমি গপ্প মারতে বসবা, বুঝলা! আমি বাড়ি ফিরা পর্যন্ত গপ্প মারতেই থাকবা, বুঝলা কি কইলাম?
সাধারণত বাবা যখন কিছু বোঝান, মাথা নেড়ে বলতে হয় বুঝলাম। কিন্তু এখন বুঝলাম বলাটা যে বিপজ্জনক সে বেশ বুঝি।
বাবার ভয় গীতার সঙ্গে সখ্য পেতে এই বুঝি আমাদের লেখাপড়ার বারোটা বাজল। আমার ঘরের লাগায়ো ছোটদার ঘরের দরজায় তিনি তালা লাগিয়ে দিয়েছেন, যাওয়া আসা ওরা বারান্দার দরজা দিয়ে করছে কিন্তু ছোটদার দোস্ত খোকন যে রাতে থেকে গেলেন বাড়িতে, শুলেন ছোটদার বিছানায়, অগত্যা গীতাকে শুতে হল আমার বিছানায়, এক রাতের ব্যাপার এ আর এমন কি, এমন কি আমাদের কাছে হলেও বাবার কাছে নয়, তিনি গভীর রাতে পানি খেতে উঠে এ ঘর ও ঘর পায়চারি করতে গিয়ে গীতাকে আমার বিছানায় আবিষ্কার করে চিবিয়ে চেঁচিয়ে হুংকারে গর্জনে নিঝুম রাতকে গনগনে দুপুর বানিয়ে ছাড়লেন। ছোটদা আর খোকনের সঙ্গে এক বিছানায় বাকি রাত কাটাতে হল গীতার। বাবা গীতাকে আমাদের আশপাশ থেকে দূর দূর করে তাড়ালেও তার প্রতি আমাদের আকর্ষণ দূর হয় না, বরং বাড়ে। তার মুখে হাসি ফোটাতে পড়াশোনা মাচায় তুলে তার সেবায় সদা সর্বদা নিয়োজিত থাকি। জুতো চাইলে জুতো এগিয়ে দিই, চিরুনি চাইলে চিরুনি,পানি চাইলে পানি, গীতা পানির গেলাস ভেঙে ফেললে মাকে বলি আমার হাত লেগে গেলাস ভেঙেছে। গীতাকে আরও দোষ থেকে মুক্ত করি, বিকেলবেলা আমাদের ছাদে ডেকে নিয়ে বিজয়দিবসের মোমবাতি জ্বেলে রেলিংএ, রেলিংএর ওপর দিব্যি সার্কাসের মেয়ের মত হেঁটে যায়, একটু হেলে পড়লেই পড়ে গিয়ে মাথা নিশ্চিত থেতলে যাবে জেনেও সে হাঁটে, আমাদেরও উসকানি দেয় হাঁটতে। রেলিংএ লম্বা হয়ে শুয়ে ব্লাউজের ভেতর হাত দিয়ে এক শলা সিগারেট আর একটি ম্যাচবাক্স বের করে আমাদের অবাক করে দিয়ে সিগারেটে আগুন জ্বেলে টান দেয়, রাস্তার মানুষেরা হাঁ হয়ে দেখে এসব। গীতা বলে, দেখুক, আমার কী! আমার ইচ্ছা আমি সিগারেট খাইয়াম। কার কী কওয়ার আছে! এ বাড়িতে কেউ সিগারেট ফোঁকে না, কোনও পুরুষ আত্মীয়কেই আমি সিগারেট ফুঁকতে দেখিনি, সেখানে মেয়ে হয়ে রাস্তার আর পাড়ার লোককে দেখিয়ে বাড়ির নতুন বউ ছাদের রেলিংএ শুয়ে সিগারেট ফুঁকবে, বাবার কানে গেলে সর্বনাশ তো হবেই, সর্বনাশের সীমাছাড়া রূপটির কথা ভেবে আমার হিম হয়ে আসে শরীর। গীতা বলে, আরে কিচ্ছু হইব না, টান দেও ত! আমার কাপাঁ কণ্ঠ, বাবা জানলে মাইরা ফেলব! গীতা পরোয়া করে না বাবা জানলে কী হবে না হবে সেসবকে। কি করে সিগারেটে টান দিতে হয় শিখিয়ে দেয়। মখু গহ্বরে ধোঁয়া ঢুকিয়েই ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিই নীলাকাশ ঢেকে দেওয়া ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের দিকে। হিম শরীরে অল্প অল্প করে পুলকি উষ্ণতা। অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করি নিষিদ্ধ জিনিসে। সিগারেট কোত্থেকা পাইছ? গীতা বলে,পাইছি। পাইছি, এর বেশি কিছু সে বলে না,ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখে শুধু সিগারেটের আর রহস্যের ধোঁয়ায় গীতাকে দেবী দুর্গার মত মনে হয়। ছাদ থেকে নেমে কুলকুচা করে ধোঁয়ার গন্ধ দূর করে ধোয়া মুখে কুলপু এটেঁ বসে থাকি। সংসারের এসব ছোট ছোট ঘটনাদুর্ঘটনায় গীতাকেই যে শুধু বাঁচিয়ে দিই, তা নয়, ছোটদাকেও বাঁচাই। ছোটদা অভাবের তাড়নায় আনন্দমোহন কলেজের দিকে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দুশ টাকা বেতনে সাপ্তাহিক বাংলার দপর্ণ পত্রিকায় সাংবাদিকের কাজ নিয়েছেন, এতেও তাঁর অভাব ঘোচে না। প্রতিদিনই নাকি সুরে খাকি স্বরে বলতে থাকেন দে না পাঁচটা টাকা দে না, পাঁচ টাকা নাই, তাইলে চারটাকা দে, চারটাকা তো নাই, ঠিক আছে তিন টাকাই দে। তিন টাকা না হলে দুটাকাই। দুটাকা না হলে একটাকা। তাও না হলে আটআনা, চারআনাও ছোটদা ছাড়েন না। চিলের ছোঁ দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দাদার ওষুধের বাক্স থেকেও গোপনে ওষধু সরিয়ে নিয়ে যান ছোটদা। আমরা তা জেনেও, পেটের ভেতর গুঁড়োক্রিমির মত লালন করি ঘটনা। দাদা সকালে গোসলখানায় যান, দাদার গোসলখানায় যাওয়া মানে পেচ্ছাব পায়খানা দাড়িকামানো গোসল সব সেরে আসতে ঘন্টা পার হওয়া, নিশ্চিন্তে দাদার পকেট থেকে তখন আলগোছে টাকা তুলে নেন ছোটদা। বাবার পকেট থেকে টাকা নিতে গেলে বড় একটি ঝুঁকি নেওয়া হয়, কারণ বাবা এত দ্রুত গোসল সারেন যে হুট করে কখন বেরিয়ে আসবেন ঠিক নেই, আর গোসলখানার দরজার মুখেই বাবার ঘর। সে তুলনায় দাদার ঘর অনেকটাই দূরে, বারান্দা পেরোও, দুটো ঘর পেরোও তারপর। ছোটদার প্রয়োজন কিছুতে ফুরোয় না। বেলগাছের তল দিয়ে বেলের গাছপাতা মাটিপাতাও যেন না জানতে পারে এমন নিঃশব্দে হেঁটে পাঞ্জাবি বা ঢিলে শার্টের তলে নয়ত বড় ঠোঙায় নয়ত বাজারের থলেয় ওষুধ নিয়ে সনপ্তর্ ণে কালো ফটক খুলে বেরিয়ে যান ছোটদা। প্রথম প্রথম বলতেন ওষধু তাঁর নিজের দরকার, তাঁর শরীরে অসুখের সীমা নেই। কিন্তু বাড়ির বাইরে ওষধু নেওয়া দেখে যখন প্রশ্ন করি, কই নিয়া যাও ওষুধ? ছোটদার উদাসীন উত্তর বন্ধু বান্ধবরা চায়। ভিটামিন চায়।