ইয়াসমিন চালে উঠছে?
হ ওইযে দেখেন বইসা রইছে। কত কইলাম উইঠ না, পইড়া যাইবা, শুনল না। ইয়াসমিন মার ধমক খেয়ে নেমে আসে চালের চুড়ো থেকে আর ভাজা মাছটি উল্টো খেতে না জানা, অত উঁচু চাল থেকে পড়ে হাড় না ভাঙা, সামান্য আঁচড় না লাগা গীতা গোসলখানায় যায় শাড়ি পাল্টাতে। মা খিচুড়ি রেঁধে গীতার পাতে ঢেলে দুপুরবেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মেয়ে দুইটারে তুমি দেইখা রাখতাছ বইলা আমি নিশ্চিন্তে একটু নওমহল গিয়া কোরান হাদিস শুনতে পারি। গীতা বলল, মা আপনে কোনও চিন্তা কইরেন না, আমি এদেরে ঠিক দেইখা রাখতাছি, খেয়াল রাখি কোনও দুষ্টামি যেন না করে। গীতার পাতে দুটোর জায়গায় তিনটে মাংসের টুকরো দিলেন মা, পাতের কিনারে আমের আচার। গীতা খেতে খেতে বলল, মাংসটা দারুন রানছেন মা। আর আচার যে কেমনে এত ভাল বানান আপনে! মা আরও মাংস, আরও আচার ওর পাতে ঢেলে বিষম উৎসাহে বলে যান, তুমারে আচার বানানোটা শিখাইয়া দিব। একেবারে সোজা, আমটা ফালি ফালি কইরা কাইটা বয়মের মধ্যে সরিষার তেল, কিছু রসুনের কোয়া, আর কিছু শুকনা মরিচ দিয়া ডুবাইয়া রাখবা। মাঝে মাঝে রোদ্রে দিবা বয়াম। গীতা বিস্ফারিত চোখ করে বলে তাই নাকি! যে কোনও কিছুতেই গীতা আকাশ থেকে পড়ে। ছোটদার বাচপুানকা দোস্ত খোকন এলেন ঢাকা থেকে, বৈঠক ঘরে বসে আছেন, খবরটি দিলে চোখ কপালে তুলে বলল সে, খোকনভাই আইছে? কখন? কেমনে? হায় হায় কামাল তো নাই। খোকন এমন আচমকা এসে উপস্থিত হয়েছে যে গীতার বিস্ময়ের সীমা নেই, অথচ বৈঠকঘরে গিয়ে মিষ্টি হেসে খোকনকে বলল আরে আপনের জন্যই তো অপেক্ষা করতেছিলাম, কামাল বলে গেছে আপনেরে বসতে, এই তো কাছেই গেছে,এখনি ফিরবে। গীতাকে দুধের বাচ্চার মত দেখতেও লাগে, শুনতেও লাগে। কালো মখু টিতে বড় বড় চোখ, এই চোখকে কেউ কেউ বলবে পটল চেরা চোখ, মাথায় অতিঘন চুলের বোঝা, টিয়ার ঠোঁটের মত ধারালো নাক, আফ্রোদিতির ঠোঁটের মত ঠোঁট, অত দূর না গিয়ে লংকা চেরা ঠোঁটই বা নয় কেন, ইঁদুরের দাঁতের মত দাঁত, সারসের গলার মত সরু গলা। ছোট ছোট হাত, ছোট ছোট পা, ছোট শরীর। কালো মেয়েকে লোকে সুন্দরী বলে না, কিন্তু গীতাকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী বলে আমাদের মনে হতে থাকে।
পাড়ায় পুজোর ঢাকের বাজনা শুরু হয়ে গেলে দুধের বাচ্চাকে ফিসফিস করে বলি,আজকে দূর্গা পুজা। আকাশ থেকে পড়ে গীতা, তাই নাকি? জানি না তো! জিভে চুকচুক শব্দ করে ওর জন্য দুঃখ করি, মুসলমানের ঘরে বিয়ে হওয়াতে ওর আর পুজোর আনন্দ করা হচ্ছে না। আমরা যেমন বারো মাসের তেরো পুজোতেই পাড়ার মণ্ডপ দেখে বেড়াতে পারি, অষ্টমি আর রথের মেলায় চিনির খেলনা আর বিন্নি ধানের খই কিনতে পারি—হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়াতে গীতার পক্ষে এসব আর সম্ভব হবে না জেনে দুঃখ আমাদের শেষ হয় না, ছোটদা ছুটে আসেন বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল গীতা, তাড়াতাড়ি শাড়িটা পইরা ফালাও।
কোন শাড়িটা? গীতা অবাক হয়ে বলে।
কালকে যে কিইন্যা আনলাম, সেইটা।
কালকে কিইন্যা আনলা? কোনটা?
আরে তোমার পূজার শাড়ি!
পূজার শাড়ি মানে? এইসব কি বল!
আমার উপস্থিতি আড়চোখে লক্ষ্য করে ছোটদা অপ্রস্তুত হেসে বলেন, ওই যে একটা নীল শাড়ি আছে না, তুমার মা যে দিছিল, সেইটা পর।
সেইটা বল। সেইটা না বইলা কেন বল যে তুমি কিন্যা আনছ? তোমার কি টাকা পয়সা আছে নাকি যে কিনবা! এক পয়সার মুরদ নাই আবার বড় বড় কথা!
তাড়াতাড়ি কর। দেরি হইয়া গেল।
কিসের দেরি? কই যাইবা?
বাবুয়ার বাসায় আমাদের দাওয়াত আছে, ভুইলা গেছ?
গীতাকে নীলাম্বরি পরী সাজিয়ে নিয়ে ছোটদা বেরোন। এরকম প্রায়ই বেরোন। পুরোনো বন্ধুর বাড়ি, চিপাচস-সদস্যদের বাড়ি, গোলপুকুর পাড়ে আড্ডা দিতে গিয়ে নতুন গজিয়ে ওঠা বন্ধুদের বাড়ি,কেবল বাড়ি বাড়ি ঘুরেই সময় কাটান তা নয়, নানান অনুষ্ঠানেও আনন্দ করে আসেন, গানের অনুষ্ঠান, নাচের অনুষ্ঠান, নাটক, সিনেমা, পারলে যাত্রাও বাদ দেন না। দেখে আমার চোখজিভ সব সচল সজল। ছোটদা নিজের গিটারখানা বিক্রি করে দিয়েছেন, শহরের ভাল গিটারবাজিয়ে হিসেবে যে নাম ছিল, সে নাম যে তুলোর মত হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে, সে দিকে তিনি বড় একটা ফিরে তাকান না। বউ নিয়ে তিনি বাপের হোটেলে থাকছেন খাচ্ছেন, কিন্তু থাকা খাওয়ার বাইরে আরও একটি জীবন আছে, সেই জীবনের জন্য হন্যে হয়ে একটি চাকরির খোঁজ করেন তিনি।
পুজোর পর ইশকুল থেকে ফিরে আমাকে গোপনে একটি খবর দেয় ইয়াসমিন, তার ইস্কুলের এক বান্ধবী দেখেছে পুজোর দিন পিওনপাড়ায় গীতার বাড়িতে সন্ধেবেলা ঢুকছে গীতা, পেছনে ছোটদা। ছোটদাকে ঘটনা জানালে তিনি আমাকে সাবধান করে দেন যেন কাক পক্ষী না জানে এই খবর। কাক পক্ষী জানে নি। কাক পক্ষী এও জানে না যে বাবা গোসলখানায় ঢুকলে প্রায়ই সকালে বেড়াল-পায়ে বাবার ঘরে ঢুকে যেন ও ঘরে কিছু একটা ফেলে এসেছেন ফেরত আনতে যাচ্ছেন অথবা বাবার সঙ্গে এক্ষুণি তাঁর জরুরি বৈঠক আছে এমন ত্রস্ত অথচ শান্ত ভাব মুখে, আলনায় ঝুলে থাকা প্যাণ্টের পকেট থেকে আলগোছে তুলে নিয়ে আসেন দশ টাকা হলে দশ টাকা, কুড়ি টাকা হলে কুড়ি টাকা, পঞ্চাশে হাত দিতেও হাত কাঁপে না ছোটদার। মা দেখেন এসব, দেখেও না দেখার ভান করেন। ছোটদার বুকের পাটা দেখে ভয়ে বুক কাঁপে আমার। ধরা পড়লে ঘটনা কি দাঁড়াবে তা অনুমান করতে যে সাহস প্রয়োজন হয়, তা আমার বা ইয়াসমিনের কারওরই নেই।