যদিও বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ছোটদা আর তাঁর বউএর মখু দর্শন তিনি করবেন না, কিন্তু ওরা অবকাশে পাকাপাকি বসত শুরু করার ঠিক দুদিন পর সকালে গোসল সেরে সার্টপ্যাণ্টজুতোটাই পরে, সর্ষের তেলে চোবানো মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলগুলো আঁচড়ে বৈঠকঘরে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন, বসে ডাকলেন আমাকে। বাবা ডাকছেন, এর অর্থ বাড়ির যেখানেই থাকো না তুমি, যে কাজই কর না, পড়ি কি মরি ছুটে আসতেই হবে। বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ওই দুইটারে ডাক। ওই দুইটা কোন দুইটা? এই প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল আমার, করিনি। বাবা যেহেতু আদেশ দিয়েছেন, আমাকে বুঝে নিতে হবে ওই দুইটা বাড়ির কোন দুইটা। কারণ এ আমার, কেবল আমার কেন, বাড়ির সবারই জানতে হবে বাড়ির কোন দুইটা কে এ সময় বাবা ডাকতে পারেন। ছোটদার ঘরে ঢুকে চাপা স্বরে বললাম, যাও, ডাক পড়ছে, একজনের না কিন্তু, দুইজনের। ছোটদার মখু মুহূর্তে বিবণর্ হয়ে উঠল, ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে লুঙ্গির গিঁট বাধঁতে বাধঁতে।
গীতাকে ,গীতা বিমূঢ় বসা বিছানায়, সঙ্গে আসার অনুরোধ করতে করতে একবার দরজার কাছে, আবার ফিরে বিছানার ধারে, হাঁটছিলেন। “নাসরিন”—বিকট শব্দে দ্বিতীয় ডাকটি এল বৈঠক ঘর থেকে, এর অর্থ হল ওই দুইটার এত দেরি হচ্ছে কেন! অবশেষে, দুজন যখন বড় হিম্মতের সঙ্গে নিজেদের হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে সাক্ষাৎ হুতাশনের সামনে দাঁড় করালো, দরজার ফাঁকে চোখ কান নাক সব পেতে থাকলাম। গীতা উবু হয়ে বাবার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করল। হিন্দু মেয়ের কদমবুসি, প্রণামের মতই, গীতার জন্য নতুন কিছু নয়। বাবা কেশে গলা পরিষ্কার করে, যদিও পরিষ্কারই ছিল গলা, এমন কোনও জমা কফ ছিল না গলায়, বললেন ছোটদার দিকে যতটা সম্ভব চোখ রঙিন করা সম্ভব,করে, জীবন কিরম বুঝতাছ? বিয়া করছ,লেখাপড়া চাঙ্গে উঠছে, গঞ্জে গিয়া সংসার করছ, একশ টাকা মাস চাকরি করছ, কী চাকরিডা করছ শুনি? কুলিগিরি। ঠিক না? কুলিগিরি ছাড়া তুমার ওই বিদ্যায় আর কি পাইবা! নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছ। তাতে কার কি ক্ষতি হইছে? আমার কিছু হইছে? আমার কিচ্ছু হয় নাই। হইছে তুমার। পাগলেও নিজের বুঝ বুঝে, তুমি বুঝ নাই। পাগলের কাছে গিয়া দেখ তার টাকা যদি নিতে চাস, দিবে? দিবে না। তার খাবার যদি নিতে চাস, দিবে? দিবে না।
বাবা খানিক থেমে, বুঝি না অপেক্ষা করে কি না মূর্তিমান দুইটার মখু থেকে নিদেনপক্ষে কোনও শব্দের, বলেন, আনন্দমোহনে ভর্তি হইয়া আয়, ইন্টারমিডিয়েটে তো থার্ড ডিভিশন পাইছস, চান্স তো পাইবি না কিছুতেই, তবু দেখ চেষ্টা কইরা। যাওয়ার সময় আমার চেম্বার থেইকা টাকা লইয়া যা। বাবা এবার গীতার দিকে চোখ নাক দাঁত সব কুঞ্চিত করে বলেন, কি ভাইবা এই কাজটা করছ? নিজের ভবিষ্যতের কথা তুমিও ভাব নাই? গীতার চোখদুটো দেখা যাচ্ছে না যেহেতু মেঝের দিকে চোখ, চুলের ডালি দৃশ্যমান নয় যেহেতু আঁচলে আবৃত মাথা, ঠোঁট এমনিতেই গীতার ছোট, ছোট মুখের ছোট ঠোঁট আরও ছোট হয়ে আছে। এবারও খানিক থেমে, কফ নেই তবু ঝেড়ে,বাবা বলেন গীতা, আমার মেয়ে দুইটার লেখাপড়া আছে, ওদের সাথে আড্ডা দিতে যেন না দেখি। কথা বুঝছ? গীতা মাথা নাড়ে, বুঝেছে সে। বাবা সশব্দে উঠে আমার ঘরের লাগোয়া ওদের দরজাটি সশব্দে বন্ধ করে ভেতর বারান্দার দিকের দরজা সশব্দে খুলে যাওয়া আসা এ দরজা দিয়েই করার আদেশ দিয়ে সশব্দেই বেরিয়ে গেলেন। আদেশ মানা ছাড়া আর উপায় নেই ছোটদার। তিনি বাংলা অনাসের্ আনন্দমোহনে ভর্তি হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাবা তাঁর বাংলায় ভর্তি হওয়ার ঘটনাটি শুনে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে সাতদিন কাটালেন আর বলে বেড়ালেন বাংলায় পইড়া কয়ডা বেডা মানুষ হইছে? বাংলা বিশারদেরা বড়জোর বুদ্ধি কইরা গরুর গাড়ি চালাইতে পারে, আর কিছু না। ওই বলাটুকুই, অনেকটা হাল ছেড়ে দেওয়া বাবা ছোটদাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বিজ্ঞানের কোনও বিষয়ে ভর্তি করিয়ে আনেন না। ছোটদা নিরাপদে তাঁর বিবাহিত জীবন কাটাতে থাকেন অবকাশে। মাঝে মাঝে হাতে একটি খাতা আর পকেটে একটি ঝরনা কলম ঢুকিয়ে কলেজে যান, বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফেরেন।
বাবার কড়া নিষেধের পরও গীতার সঙ্গে আমার আর ইয়াসমিনের সখ্য বেড়ে ওঠে। বড়রা বাড়িতে কেউ না থাকলে সাধারণত আমিই হতাম দুষ্টের শিরোমণি লংকার রাজা। মাঠে খেলতে নামা, ছাদে উঠে বিশ্ব দেখা, বিশ্ব বলতে রাস্তার বারো রকম লোক আর প্রতিবেশিদের ঘরবাড়িউঠোন, তুলসীতলা, সন্ধেধপূ , মন্দিরা বাজিয়ে কীর্তন গাওয়া, ভাড়া করা ব্যান্ড পার্টির সামনে এক প্যাঁচে রঙিন শাড়ি পরে কাঁসার লোটা হাতে মিছিল করে ব্রহ্মপুত্রের দিকে যাওয়া, গঙ্গার জল মনে করে ব্রহ্মপুত্রের ঘোলা জল দিয়ে বাড়ির পবিত্র উৎসব সারা দেখা, নয়ত অপাঠ্য পড়া। গীতা আমার রাজত্ব এক তুড়িতে দখল করে আমাকে ছাড়িয়ে মাড়িয়ে তরতর করে উঠে যায় কাঁঠাল গাছে, ডালে বসে কাঁঠালের মুচি খায়, আমি নিচ থেকে বাঁশের কঞ্চির আগায় কাপড়ের পুঁটলিতে নুন আর লংকাগুঁড়ো বেঁধে ওর নাগালে দিই। আতা গাছে লাফিয়ে ওঠে। বেল গাছেও। সবরি গাছে উঠতে পারবা? পারমু না মানে? শাড়ি পরেই সবরি গাছ বেয়ে একেবারে মগডালে গিয়ে বসে, নাগালের পেয়ারাগুলো মগডালে বসেই খায়। পাড়ার লোক রাস্তা থেকে গাছে ওঠা বাড়ির নতুন বউকে দেখে। গীতার দস্যিপনা আমাদের হাঁ করা মগ্ধু তা দেয়। আমরা ওর পেছনে লেজের মত লেগে থাকি। গাছে চড়ার কোনও বিদ্যে আমার ছিল না, গীতার কাছে হাতেখড়ি হয়। গীতার কাছে হাতেখড়ি হয় আরও অনেক কিছুর। হাতেখড়ি, পায়েখড়ি, বুকেখড়ি, পেটেখড়ি, পিঠেখড়ি—খড়ির শেষ নেই। উঠোনের খড়িগুলো গীতার প্রেরণায় ছুঁড়ে আর ছিঁড়েই ফুরোতে লাগল। বৃষ্টি হলে আমাদের পুরোনো অভ্যেস, উঠোনে মাঠে দৌড়ে দৌড়ে বৃষ্টিতে ভেজা, সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গিয়ে ভিজে ভিজে রাজ্যির নাচ নাচা। গীতা বৃষ্টিতে দৌড়ে আর নেচে তুষ্ট হয় না, কাকভেজা হয়ে চৌচালা টিনের ঘরের মাথায় উঠে বসে থাকে। আমি বারান্দায় বসে দেখছিলাম যেদিন পড়ল ও, কালো ফটকের শব্দ শুনে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে পড়ল তো পড়ল একেবারে ভাঙা ইট ফেলা উঠোনে, ভেজা চাল থেকে পা পিছলে, বোঁটা ছিঁড়ে যাওয়া পাকা চাল কুমড়োর মত গড়িয়ে। ইয়াসমিন চালের মাথায়,গীতার পড়ে যাওয়া দেখে হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে না পারা আমি বড় ঘরের বারান্দায়, ফ্যাকাসে মুখে ভিজে চপু সে থাকা শাড়ি গায়ে উঠোনে বসে থাকা গীতা আর এর মধ্যে মা এসে ভিজে বোরখা খুলে বারান্দার দড়িতে ঝুলিয়ে খোয়ার ওপর বসে থাকা বাড়ির বউকে দেখে অবাক, আফরোজা তুমি ওইখানে কি কর! গীতা বলল, না মা কিছু করি না, ইয়াসমিন চালে উঠছে তো, এইখানে বইসা বইসা ওরে দেখতাছি।