প্রথম দিন বাংলা পরীক্ষা, বাংলার জন্য আমার কোনওরকম ভয় হয়নি কখনও আগে, কিন্তু পরীক্ষার দিন মনে হতে থাকে আমার পাশ হবে না। মা প্রতিদিন সকালে ডিম ভাজা খেতে দেন, বলেন ডিম খাওয়া ভাল। কিন্তু পরীক্ষার দিন ডিম খাওয়া চলবে না, ডিম খেলে ডিম জোটে পরীক্ষায়, সুতরাং সাবধান। কলাও চলবে না। কচওু না। পরীক্ষায় কলা পাওয়া কচু পাওয়া রসগোল্লা পাওয়ার মতই। যদিও কলা কচু রসগোল্লা আমার প্রিয় খাবার, কিন্তু পরীক্ষা চলাকালীন এগুলো আমাকে পরিত্যাগ করতেই হয়। আমার পরীক্ষা, অথচ বাবা ছটফট করেন আমার চেয়ে বেশি, আগের রাতে ঘুমোননি একফোঁটা। দেখে মনে হয়, বাবারই আজ পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। বারবার জানতে চাইছেন বইএর আগাগোড়া আমি মখু স্ত করেছি কি না। বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে রাধাসুন্দরী ইশকুল। আমি পথ চিনি, কিন্তু আমাকে একা যেতে দেওয়া হবে না। বাবা আমাকে রাধাসুন্দরীতে নিজে নিয়ে যাবেন রিক্সা দিয়ে, পরীক্ষা শেষ হলে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবেন। সকালে মা যখন চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন আমার, বাবাই তখন সেটি দিলেন মার হাতে,কাগজটি। কাগজটি ভাঁজ করে সুতো দিয়ে বেঁধে আমার চুলে লাগিয়ে দিতে হবে। কাগজে আরবিতে কিছু লেখা, লেখাটি মাথার ওপর থাকলে বাবাকে কে একজন বলেছেন পড়া মনে থাকে। আমি যেন কিছু ভুলে না যাই পরীক্ষার খাতায় লিখতে গিয়ে, তাই এই কাগজ, কাগজে পড়া মনে থাকার দোয়া। আমি ছিটকে সরে যাই, পড়া ভুলে যাওয়ার কোনও রোগ আমার নেই যে চুলে দোয়া দরুদ লাগিয়ে আমাকে পরীক্ষায় বসতে হবে! মা প্রতিদিনই আমার মাথায় ঠাণ্ডা নারকেল তেল দিচ্ছেন মাথা ঠাণ্ডা থাকার জন্য। সেই তেলে-মাথার তেলে-চুলে দুটো কলাবেণী করে দেন মা, এখন সুতো বাঁধা কাগজটি কেবল চুলের সঙ্গে গিঁট দিয়ে দিলেই হয়। লজ্জায় চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছে আমার, তবু বাবা আমাকে ধরে বেঁধে কাগজের পুঁটলিটি আমার চুলে লাগিয়ে দিলেন। দেখে ছোটদা হেসেই বাঁচেন না, ফিকফিক ফিকফিক। ইয়াসমিনও ফিকফিক। ছোটদা বললেন, তর তো মেট্রিক পাশ করা হইব না, তাবিজের গুণে যদি পাশ করস।
হাতে একটি দুটি নয়, চারটে নতুন ঝরনা কলম দিলেন বাবা, আর নতুন একটি পেলিকেন কালির বোতল। লিখতে লিখতে কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে কালি ভরে যেন লিখি। পরীক্ষার্থীর মন মেজাজ বুঝে সবাই চলছিল, পরীক্ষার্থী হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, না বললে না, কিন্তু তাবিজের ব্যাপারে আমার কোনও না খাটেনি। সেই তাবিজ তেলে মাথায় খলসে মাছের মত ভেসে ওঠে। চন্দনাও রাধাসুন্দরী ইশকুলে পরীক্ষা দিয়েছে। শেষ ঘন্টা পড়ার পর বারান্দায় বেরোতেই দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে, ওর খাতা জমা দেওয়া আগেই হয়ে গেছে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে ভাল না মন্দ কিছুই না জিজ্ঞেস করে ও জানায়, বিচিত্রায় ওর একটি লেখা ছাপা হয়েছে। এরপরই চক্ষু চড়কগাছ, কি রে মাথায় এইডা কি বানছস?
ধরণী দ্বিধা হও, এ উচ্চারণ জীবনে দ্বিতীয়বারের মত করেছি, ধরণী দ্বিধা হয়নি।
পাশ করলে এমনি পাশ করাম, তাবিজের কারণে পাশ করতাম না। বাড়ি ফিরে চুলের তাবিজ একটানে খুলে ফেলে দিয়ে বলি।
মা বললেন, পড়াডা মনে থাকব।
পড়া আমার এমনি মনে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলি। ভেতরে ফোপাঁনো কান্না।
বাবা ধমকে বলেন, এইডা মাথায় আছে বইলা মনে থাকে, নাইলে থাকত না।
আমি অবাক তাকাই, দোয়া দরুদ তাবিজ কবজে বিশ্বাস করা লোকটিকে আমার বিশ্বাস হয় না যে আমার বাবা।
প্রতিটি পরীক্ষার দিন আমার মাথায় ওই তাবিজ লাগিয়ে দেওয়া হয়, আমার কোনও বাধাই টেকে না। মাথা ভরা লজ্জা নিয়ে আমাকে মাথা নত করে প্রতিদিনই যেতে হয় রাধাসুন্দরী ইশকুলে। প্রতিদিনই আমাকে সতর্কে থাকতে হয়, মাথার লজ্জাটি আবার দাঁত কপাটি মেলে প্রকাশিত না হয়ে পড়ে। প্রতিদিনই বারবার মাথায় হাত দিয়ে লজ্জাটি চুলের আড়ালে ঢাকতে হয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে তো বটেই উত্তরপত্র থেকেও বারবার মন মাথায় গিয়ে ওঠে। মাথা আমার জন্য বিশাল একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। মাথার লজ্জায় আমি মাথা নত করে পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরি। ইচ্ছে করলে খুলে ফেলে দিতে পারি, কিন্তু আবার ভয়ও হয়, যদি সত্যিই স্মৃতিশক্তি লোপ পায় আমার! যদি পাঁচ আর সাত যোগ করলে যে বারো হয়, এই সহজ জিনিসটি ভুলে যাই অঙ্ক পরীক্ষার দিন! যদি ইংরেজি পরীক্ষার দিন গরুর রচনা লিখতে গিয়ে প্রথম বাক্যটিই আর মনে না করতে পারি, দ্যা কাউ ইজ এ ডমেস্টিক অ্যানিম্যাল !
০৩. তা তা থৈ থৈ
অবকাশে ছোটদার সস্ত্রীক প্রবেশ আমার পরীক্ষার আগেই ঘটেছে। ঘটেছে মার কারণে। পুত্রশোকে যখন তিনি যারপরনাই কাতর,বাবার কাছে আবেদন নিবেদন করে ব্যথর্ হয়ে অতঃপর নিজেই হাশেমমামাকে পাঠিয়ে ছোটদা আর তাঁর বউকে ইসলামপুরের কোন এক গ্রামের কোনও এক কুড়েঘর থেকে শহরে আনলেন। কিন্তু শহরে এসে পৌঁছোনোর মানে এই নয় যে ওরা অবকাশে ঢোকার কোনওরকম অনুমতি পাবে। বাবা সোজা বলে দিলেন, কস্মিনকালেও যেন অবকাশমুখো না হয় ওরা। নানিকে বলে কয়ে নানির উঠোনে কুয়োতলার পাশে একটি ঘর, যে ঘরটি এককালে আমাদের খাবার ঘর ছিল, পয়পরিষ্কার করে একটি চৌকি পেতে দেওয়া হল ওদের থাকার জন্য। ছোটদা বউ নিয়ে ওখানে থাকতে শুরু করার পর বাবার আদেশে নানির বাড়ি বেড়াতে যাওয়া অন্তত আমার আর ইয়াসমিনের জন্য বন্ধ হয়। মা কিন্তু নিয়মিত ছোটদার সংসারে যেতে লাগলেন। মা তো আর খালি হাতে যান না, পুত্রধনের জন্য চাল ডাল আনাজপাতি অবকাশ থেকে যা যোগাড় করতে পারেন নিয়ে যান। বাবা যখন বাড়ি থাকেন না, ছোটদা ঢুঁ মারেন অবকাশে। ঢুঁ অবশ্য অহেতুক মারেন না, প্রয়োজন হলেই। বাবার নিষ্ঠুরতার কথা মা ভাবেন আর বলেন, এই মানুষটা মানুষ নাকি পাথর? মার অক্লান্ত সাধ্য সাধনার পর বাবাকে খানিক নরম করে মা একদিন অন্তত এইটুকু রাজি করালেন যে ছোটদা বউ নিয়ে অবকাশে ঢুকবেন কিন্তু কোণের একটি ছোট ঘরে ওরা বাস করবেন,সারা বাড়িতে অবাধ পদচারণার কোনও অধিকার ওদের থাকবে না। বিয়ে যখন করেইছো, বউ যখন আর ছাড়বেই না মনস্থ করেছো, যদিও এ বয়সে বিয়ে করার কোনও যুক্তি নেই, পেটালে গাধাও মানুষ হয়, তুমি হওনি—এখন দেখ লেখাপড়া শেষ করে ভবিষ্যতে ডাল ভাতের যোগাড় করার ব্যবস্থা করতে পারো কি না, এরকম ভেবেই বাবার রাজি হওয়া। মা ওঁদের জন্য দাদার ঘরের পেছনে একটি ছোট ঘর যে ঘরে মা নিজে থাকতেন গুছিয়ে দিলেন, কাপড় চোপড় রাখার একটি আলনা দাদার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া দরজাটি বন্ধ করে দরজার সামনে রাখলেন। ছোটদার পুরোনো খাটটি দাদার ঘর থেকে এনে ছোটঘরে পাতা হল। ছোটদা বললেন আয়নার টেবিলটি তাঁর ঘরে যে করেই হোক নিতে হবে। মার বিয়ের সময় খাট পালঙ্ক ইত্যাদির সঙ্গে নানা এই টেবিলটি মাকে উপহার দিয়েছিলেন। কাঠের ফুল পাতার নকশাঅলা বহিরাবরণ, অন্তস্তলের আয়নাটি সামনে পেছনে দোল খায় নাড়লে, দুপাশে ছোট দুটো তাক, দুটো ড্রয়ার—সিংহি সিংহি এই চারপেয়ে টেবিলটি বাবার ঘর থেকে নিজে টেনে ছোটঘরে দিয়ে এলেন মা। আঁচলে মুছে দিলেন আয়নায় জমা ধুলো। গীতা টেবিলের সামনে বসে ঘন্টা খরচ করে সেজে ছোটদার সঙ্গে প্রায় বিকেলে বাইরে যান। ওঁদের বাইরে যাওয়ার দিকে আমি তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকি। এরকম আমিও যদি যেতে পারতাম!